ব্যবসার জন্য বেরিয়েছিলেন তিনি, গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। ১৯৭২ সালে সেই যে বেরিয়ে যাওয়া, তারপর ১৯৭২ থেকে ২০২০ সালের মধ্য জানুয়ারী—সময়ের পরিক্রমায় সেতো ৪৮ টা বছর।এই সময়ে একজন হাবিবুর রহমানকে আর দেখে নি তাঁর পরিবার। এ সময়ের মধ্যে তিনি তরুন থেকে বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী জয়গুন নেছা প্রহর গুনেছেন দিনের পর দিন। আগলে রেখেছেন চার সন্তান, এরা বেড়ে উঠেছিলেন বিয়ানীজারের (সিলেট) বেজগ্রাম নামক গ্রামে। স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদ নাড়াচাড়া করে আর হারিয়ে যাওয়া মানুষটির পথ চেয়ে চেয়ে জয়গুন নেছাও একদিন এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া স্বামীর গল্প তাদের সন্তানদের কিংবা নাতি-নাতনীদের হৃদয় জুড়ে ছিল অহর্নিশ।
এই ৪৮ বছরে যেমন হাবিবুর রহমান সাজবেলায় পৌছেছেন, ঠিক তেমনি তাঁর সন্তানদেরও কেউ কেউ এখন মধ্যগগণে। চার ছেলেরই আছে সন্তান-সন্ততি। স্বামীর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকা জয়গুন নেছা মারা গেছেন ২০০০ সালে। গ্রামের সেই পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এখন জয়গুন নেছার পরিবারের আবাস বিয়ানীবাজার পৌরসভার কসবা গ্রাম।তার মৃত্যুর আঠারো বছর পর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন স্বজনহীন কাতরাচ্ছিলেন তিনি, সেসময়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমেই তিনি আবারও গোচরে আসেন তাঁর পরিবারের। হাবিবুরের বয়স এখন ৭৮ বছর।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, হাবিবুর রহমানের চার ছেলে। তাঁরা হলেন সাহাবুদ্দিন (৬০), মাহাতাব উদ্দিন (৫৮), জালাল উদ্দিন (৫০) ও আলীম উদ্দিন (৪৮)। তাঁদের মধ্যে মাহাতাব উদ্দিন ও আলীম উদ্দিন পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে থাকেন। সাহাবুদ্দিনের বড় ছেলে তাহির হোসেনও স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। হাবিবুর রহমানের হারিয়ে যাওয়ার কথা তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানতেন। তাঁরাও বিভিন্নভাবে তাঁকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে হাবিবুর রহমানের নাতি তাহির হোসেনের স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক বৃদ্ধের ভিডিও দেখতে পান। বিষয়টি তিনি স্বামীকে জানিয়ে বাংলাদেশে পরিবারের স্বজনদের ভিডিওটি কাছে পাঠান। সেই ভিডিওর সূত্র ধরে জালাল উদ্দিন গতকাল শুক্রবার সকালে চলে যান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। জালাল উদ্দিন নিশ্চিত হন, হাবিবুর রহমানই তাঁর হারিয়ে যাওয়া বাবা। দীর্ঘদিন পর বাবাকে ফিরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন জালাল উদ্দিন।জালাল উদ্দিন জানান, তাঁর বাবা ৪৮ বছর আগে চট্টগ্রামে যান ব্যবসা করতে। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এরপর থেকে হাবিবুর রহমানের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।
হাসপাতালে জালাল উদ্দিন বলেন, ‘রাজিয়া বেগমের কাছ থেকে শুনেছি, হারিয়ে যাওয়ার পর আমার বাবা মাজারে মাজারে ঘুরেছেন। দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর মৌলভীবাজারের শাহাবুদ্দিন মাজারে বসবাস করতেন। মাজরসংলগ্ন রায়েশ্রী গ্রামের বাসিন্দা রাজিয়া বেগম প্রায় ১২ বছর ধরে নিজের বাবার মতো হাবিবুর রহমানকে দেখাশোনা করেছেন। কিছুদিন ধরে কিছুটা অসুস্থ ছিলেন হাবিবুর রহমান। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিছানা থেকে পড়ে ডান হাতে আঘাত পান তিনি।’
হাবিবুর রহমানকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন রাজিয়া বেগম। যাঁকে বাবা বলে ডেকেছেন, তাঁকে একা ফেলে যেতে মন মানছিল না রাজিয়া বেগমের। হাসপাতালে হাবিবুর রহমানের পাশে চিকিৎসাধীন অন্য এক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় রাজিয়া বেগমের। পরিচয়ের একপর্যায়ে তাঁদের হাবিবুর রহমানের হারিয়ে যাওয়া ঘটনা বলেন তিনি। পরে ওই রোগীর স্বজনরাই হাবিবুর রহমানের ভিডিও করে সহযোগিতার জন্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে তুলে ধরেন। সামাজিক যোগযোগমাধ্যমেই আকস্মিক হারিয়ে যাওয়া বাবাকে ফিরে পাওয়ার পর তাঁর সন্তান জালাল উদ্দিন এবং স্বজনরা পরে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট নগরের সোবহানীঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
শনিবার ছিল আনন্দে উদ্বেল স্বজনদের ভীড় হাসপাতাল জুড়ে। বেসরকারি ওই হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার একটি কক্ষে চিকিৎসা চলছে হাবিবুর রহমানের। তাঁকে দেখতে কক্ষটিতে ছিল স্বজনদের ভিড়। ছেলে জালাল উদ্দিন ব্যস্ত বাবার চিকিৎসার ওষুধপথ্য সংগ্রহে। বড় ছেলে সাহাবুদ্দিনের ছেলে জামিল হোসেন ব্যস্ত স্বজনদের সামাল দিতে। শয্যাশায়ী হাবিবুর রহমানকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। তিনি কথা বলছেন অল্প। স্ত্রী, নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা বলছেন হাবিবুর রহমান। তবে বেশির ভাগ সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন তিনি।
হাবিবুর রহমানের নাতি জামিল হোসেন বলেছনে, ‘দাদা আমার দাদির নাম, বাড়ির ঠিকানা এবং শ্বশুরের নাম মনে করতে পারছেন। দাদা যখন নিখোঁজ হয়েছিলেন, তখন বাবার বয়স ছিল ১২-১৩ বছর। তিনিও দাদার চেহারা দেখে নিশ্চিত হয়েছেন। ছোটবেলা থেকে গল্প শুনে এসেছি, আমাদের দাদা হারিয়ে গেছে। আজ ফিরে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন ডান হাতের হাড় ভেঙেছে। অস্ত্রোপচারের পর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি।