বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
আদালত চত্বরে মমতাজের উপর ডিম নিক্ষেপ, প্রশাসন নীরব  » «   রোমে সেন্তসেল্লে ঐক্য পরিষদের বর্ণাঢ্য বৈশাখী উৎসব  » «   তর্ক-বিতর্কে মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এআই: গবেষণার এই ফল উদ্বেগের  » «   অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মৌলিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করেছে, জানালো হিউম্যান রাইটস ওয়াচ  » «   মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা: সেনাপ্রধান  » «   কক্সবাজারে কেন মার্কিন সেনা?  » «   করিডর নয় এবার `ত্রাণ চ্যানেল’র কথা জানালেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা  » «   বানু মুশতাক পেলেন বুকার পুরস্কার  » «   সুরমা-কুশিয়ারায় বাড়ছে পানি, আপাতত বন্যার আশঙ্কা নেই  » «   স্টারলিংক সংযোগ কীভাবে নেবেন?  » «   রেমিটেন্সে ট্রাম্পের কর প্রস্তাব, বড় ধাক্কার মুখে বাংলাদেশ  » «   ‘শুনানির’ দুই দিন আগেই জামিন পেলেন নুসরাত ফারিয়া  » «   বাংলাদেশে স্টারলিংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা, খরচ কত?  » «   অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া বিমানবন্দর থেকে কারাগারে: ইন্টেরিমের প্রতি শিল্পীদের ক্ষোভ ও তিরস্কার  » «   বিশ্বরেকর্ড গড়ে এভারেস্ট জয় করলেন বাংলাদেশি শাকিল  » «  

বিচ্ছেদেই এখন ব্রিটেনের আনন্দ



গত শুক্রবার সংসদে ব্রেক্সিট বিল পাস হয়েছে। তাও ছিল নিরঙ্কুশ সাংসদদের ভোটে। এমনকি লেবার পার্টির ৬ এমপিও ব্রেক্সিটের পক্ষেই সংসদে ভোট দিয়েছেন। পুনর্নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সংসদে ৩৫৯ ভোট নিয়েই ব্রেক্সিটের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গেলেন। সত্যি কথাটা হলো, ব্রিটেনের মানুষ এই ব্রেক্সিটই চাইছিলেন। আর সেজন্যই ছিল কনজারভেটিভ পার্টির ভ‚মিধস বিজয়।

আবারো বরিস পুনর্ব্যক্ত করেছেন, ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই তিনি ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘটাবেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। লেবার পার্টির এবারের পরাজয় দলটিকে আরেক নতুন সংকটের দিকেই এগিয়ে দিচ্ছে। জেরেমি করবিনের সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর আবার নতুন নেতৃত্বে কে আসছেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিস্তর আলোচনা। আবারো কি পার্টির ভেতরের বামপন্থিদের ভোটেই পার্টি নেতা নির্বাচিত হবেন, নাকি ব্রিটেনের রাজনৈতিক উত্তাপ বিবেচনা করে নতুন কেউ আসবেন, তা-ই এখন দেখার পালা। কারণ গত নির্বাচনে দেশের জনগণ ব্রিটেনের রুট লেবেলের ইস্যুগুলোর প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর একটা অংশ মাত্র শিক্ষার্থী। একটা অংশ অভিবাসী। এবং বিরাট জনগোষ্ঠী কিন্তু দারিদ্র্যপীড়িত নন। আর সেজন্যই তারা জেরেমি করবিনের কিংবা লেবার পার্টির অতি মানবিক ইস্যুগুলোকে গুরুত্বের চোখেই দেখেনি।

নির্বাচনে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক অনুদানের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবিক ইস্যুগুলো সামনে নিয়ে এসেছিলেন করবিন, সংখ্যা লঘিষ্ট শ্রেণির মানুষদের তিনি আশাবাদী করে তুলেছিলেন। করবিনের কথায় লাখো মানুষ সারা ব্রিটেনেই রাস্তায় নেমেছে, দাবি আদায়ের জন্য বরিসের বিপরীতে গিয়ে এমনকি মিছিলও করেছে। কিন্তু সবকিছুই ম্লান হয়ে গেছে বিচ্ছেদ নামক বহু উচ্চারিত শব্দের কাছে। কারণ ব্রিটেনের মানুষ মনে করে এসব ইস্যু তৈরিই হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে। ইউরোপের মানুষের ঢল নেমেছে ব্রিটেনে, বিভিন্ন শহরের স্কুলগুলোতে ইউরোপীয় কমিউনিটির মানুষের সন্তানদের জন্য নতুন জায়গা তৈরি করতে হয়েছে। নতুন স্কুল পর্যন্ত তৈরি হয়েছে বিভিন্ন অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়। তারা মনে করছে, এনএইচএস অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতে বহিরাগতের কারণেই সেবা প্রদান বিঘ্নিত হচ্ছে।

ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যখন ধারণা এ রকম, ঠিক এ রকম সময়েই দেখা যাচ্ছে, ৫ লাখ ৯০ হাজার ৩০০ ইউরোপীয় নাগরিক গত অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটেনে বসবাসের জন্য আবেদন করেছে। এই আবেদনকারী আইনগতভাবেই ব্রিটেনের নাগরিকদের মতো সুযোগ-সুবিধা ভোগের অধিকার রাখেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আসা একেকটা পরিবারের প্রায় সবাই এসেই ব্রিটেনে সামাজিক অনুদানের অধিকার উপভোগ করে। আইনিভাবেই স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হয় ব্রিটিশ সরকারকে। যদিও এসব সুযোগ-সুবিধা একজন মানুষের জন্মগত অধিকার এবং উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন এর বাইরে যেতে পারে না। মানবিক এসব কাজ করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করতে হচ্ছে প্রতি মাসে। ব্রিটেনের বিপুল জনগোষ্ঠী মনে করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই অভিবাসীদের কারণেই তারাই ক্রমেই বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে রোমানিয়া থেকে আসা বিপুলসংখ্যক লোক বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে গোটা পরিবেশটাকেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ব্রিটিশদের অধিকাংশ মানুষই মনে করেছে সব সমস্যার মূলেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সে কারণে করবিনের মানবিক ইস্যুগুলোকে খুব একটা গুরুত্বের চোখে দেখেনি ব্রিটিশ জনগণ গত নির্বাচনে।

ব্রেক্সিট ইস্যুটা নতুন নয়। ব্রিটেনের আরেক জনপ্রিয় এবং বহু সমালোচিত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের আমল থেকেই ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ইস্যুটি আলোচিত, যা লেবার পার্টির (টনি ব্লেয়ারের) সময়কালীন ঢাকা পড়ে গেলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নির্বাচনী প্রচারণায় তা গুরুত্ব পেয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়েই ব্রেক্সিট গণভোট। চড়াই-উতরাই পেরুতে হয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের। ক্যামেরন থেকে থেরেসা মে, দুজনই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, শেষ পর্যন্ত ব্রেক্সিটে লেগে থাকা পাগলা টাইপ মানুষটাকেই ব্রিটেনের মানুষ নির্ভর করল। ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেন কোন দিকে এগোচ্ছে। সাধারণ মানুষ যে ‘এবস্ট্রাক্ট’ ধারণা নিয়ে ব্রেক্সিটের জন্য ভোট দিল, তাতে কি কোনো সুফল নিয়ে আসবে, নাকি রাজনীতির মাঠে শুধুই ভোটের বৈতরণী পাড়ি দিলেন বরিস জনসন, তা এখন পর্যালোচিত হচ্ছে।

দীর্ঘদিন থেকে ব্রিটেনে বসবাস করা মানুষের মাঝে কোনো আতঙ্ক না থাকলেও কিছুটা হলেও উৎকণ্ঠায় আছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে আসা মানুষগুলো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্যাম্পেইনার গ্রুপ আশঙ্কা প্রকাশ করছে, ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করা ৫ লাখ ২৫ হাজার ২০০-এরও বেশি মানুষের দরখাস্ত এখনো সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। এদের ভাগ্যে কী আছে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে এবারের ভোট প্রমাণ করেছে, ব্রিটিশ জনগণ নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে আনতে, ইইউর ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে নিরাপত্তা এবং আইনি সিদ্ধান্ত তাদের দেশের অভ্যন্তরেই রাখতে ব্রেক্সিট সমর্থন করেছে। এক ধরনের ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ অর্থাৎ ‘গ্রেট ব্রিটেন’ কনসেপ্টটা তারা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছে তাদের রায়ের মধ্য দিয়ে। সাম্প্রদায়িকতা কিংবা বর্ণবাদকে এ নির্বাচন উসকে দেয়নি বলেই আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি। ব্রিটিশ জনগণ এ কথাটা তাদের নির্বাচনে কোনো সময় ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করেনি। আর সেজন্যই এশিয়ান কমিউনিটির বিপুলসংখ্যক ভোটার এমনকি নেতারাও কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি আস্থা রেখেছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভ‚ত কনজারভেটিভ দলের নেতারা এ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এবং দলটার প্রতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশির সমর্থনও আছে।

৩১ জানুয়ারি কী চুক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসছেন বরিস, কী বাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছেন তিনি, নাকি কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই বেরিয়ে আসছে ব্রিটেন সেদিকেই চোখ রাখছে মানুষ, কিন্তু উৎকণ্ঠায় নেই তারা। তাই রাজনীতির মাঠে এসব কথা উচ্চারিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিপুলসংখ্যক জনগণ, যারা কনজারভেটিভ পার্টিকে ভোট দিয়েছে, তাদের মাঝে এ নিয়ে খুব একটা উদ্বেগ নেই। তারা নির্ভর করেছে, এই নির্ভরতায়ই তাকিয়ে আছে ৩১ জানুয়ারির দিকে।
সব মিলিয়ে শুধু ইইউর ৩.৪ মিলিয়ন নাগরিকই ব্রিটেনে বাস করছেন না, ব্রিটেনেরও ১.৩ মিলিয়ন নাগরিক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, কর্মক্ষেত্রে কিংবা কেউ কেউ অবসর সময়ে সেই দেশগুলোতে থিতু হয়েছেন। এদের ভাগ্যও নির্ধারণ করবে ব্রেক্সিট। সে কারণেই এখন ‘ব্রেক্সিট’র একটা সুরাহা হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ব্রেক্সিট নিয়ে এখন আর রাজনৈতিক ইস্যু বানানোরও কোনো অবকাশ নেই। ব্রিটেনের এখন যেন বিচ্ছেদেই আনন্দ। ভাগ্যে যা-ই থাকুক বিচ্ছেদ-আনন্দের জন্যই তাকিয়ে আছে ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আগামীর দিকে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

"এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব " -সম্পাদক

সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন