‘গেট ব্রেক্সিট ডান’- কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নির্বাচনের প্রধান স্লোগান এটি। সত্যি কথাটা হলো, ব্রিটেনের মধ্যবর্তী নির্বাচনের কারণটাও হলো মূলত ব্রেক্সিটই। যেহেতু টোরি পার্টির হাতেই ব্রেক্সিটের জন্য রেফারেন্ডাম হয়েছে, সেহেতু টোরির ওপরই দায়িত্ব ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে দেশটাকে বের করে নিয়ে আসার। কিন্তু ব্রেক্সিট ইস্যুর কারণেই ব্রিটেনে খুবই কম সময়ে ৩ জন প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা নিতে হয়েছে। রেফারেন্ডামে ডেভিড ক্যামেরুনের ব্যর্থতার দায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন, তারপর থেরেসা মে কিংবা বরিস জনসন কেউই পার্লামেন্টকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। লেবার পার্টির এমপিরা তো বটেই, এমনকি টোরি এমপিরা পর্যন্ত ‘ব্রেক্সিট ডান’ এর বিভিন্ন ইস্যুতে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেননি পার্লামেন্টের ভেতরেই। একদিকে লেবার পার্টির বিরোধিতা, অন্যদিকে পার্টির এমপিদের ব্রেক্সিটের বিভিন্ন ইস্যুতে এক হতে না পারায় শেষ পর্যন্ত এ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছেন বরিস জনসন। আগামী ১২ ডিসেম্বর ব্রিটেনের এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে, ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ। আর সেজন্যই বরিস কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিসেবে তার এমপিদের মনোনয়ন দিয়েছেন তার নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শের বলয়ের মধ্য থেকেই। বরিস জনসনের এ রাজনৈতিক চালাকি ধারণায় রেখে প্রায় অর্ধশত এমপি পার্টির মনোনয়ন চাননি। এর মাঝে সাবেক স্পিকার পর্যন্ত আছেন। কারণ তারা ব্রেক্সিট নিয়ে বরিস জনসনের বিরোধিতায়ই ছিলেন গত সময়গুলোতে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে লেবার পার্টি ব্রিটেনের চলমান বিভিন্ন সংকটগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন। লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি কমানোর এমনকি মওকুফের ঘোষণায় তরুণ-তরুণীরা আকৃষ্ট হচ্ছে। বিশেষত তরুণ ইউনিভার্সিটিপড়–য়া ভোটাররা একবাক্যে করবিনের প্রশংসায় তাকেই ভোট দিতে চাইছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নেরও প্রতিশ্রুতি আছে তার।
জাতীয় স্বাস্থ্য খাত এনএইচএস নিয়ে লেবার পার্টির নির্বাচনে ইশতেহারে ৪.৭ শতাংশ প্রতি বছর বৃদ্ধির অঙ্গীকার করেছে। এনএইচএস এখন ব্রিটেনের সবচেয়ে জ্বলন্ত ইস্যু হিসেবেই পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই ভোটাররা আকৃষ্ট হচ্ছে জেরেমি করবিনের কথায়। সর্বনিম্ন মজুরি ঘণ্টায় ৮ পাউন্ডের জায়গায় ১০ পাউন্ডে নিয়ে যাওয়ায় তরুণরা আরো বেশি আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু তারপরও করবিন কি ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারবেন কাক্সিক্ষত বিজয়? এ প্রশ্ন আছে দেশব্যাপী এমনকি লেবার পার্টির অভ্যন্তরেও। জেরেমি করবিনের মানবতাবাদী স্লোগান মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হলেও সারা ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে কি তার এসব স্লোগান প্রভাবিত করতে পারছে? ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ করবিনের বার্তায় আন্দোলিত হচ্ছে, তারা এবার বুথমুখী হবে। ভোট দেবে নিশ্চিত। কিন্তু লেবার পার্টির অভ্যন্তরেই অনেক এমপি প্রার্থী আছেন, যারা নিজেরা তাদের বিজয় চাইছেন, কিন্তু করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসুক, সেটা চাইছেন না। লেবার পার্টির এমপি প্রার্থীদের মাঝে বাংলাদেশি-পাকিস্তানি বংশোদ্ভ‚ত এমপি প্রার্থীরাও আছেন, যারা করবিনের নেতৃত্ব মেনে না নিয়েও নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন এবং করবিনের সমর্থিত ভোটারদের ভোটের মধ্য দিয়েই তারা বিজয়ী হবেন। আর সেজন্য এমনকি নির্বাচনে বিজয়ী হলেও নির্বাচন-পরবর্তী করবিন তার পার্টির অভ্যন্তরের রাজনীতিতে সংকট কাটিয়ে উঠতেও হিমশিম খেতে পারেন। যেটা হয়েছে বরিস জনসনের ক্ষেত্রে তার গত টার্মে। অর্ধশতাধিক এমপি তার বিরোধিতা করায় এমনকি তিনিও পার্লামেন্টে বারবার পরাজিতই হয়েছেন।
জেরেমি করবিনের মানবিক ইস্যুতে ব্রিটেনের মানুষের সমর্থন থাকলেও রেফারেন্ডাম ইস্যুটা জনগণের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। আর সেজন্যই এমনকি দ্বিতীয় টিভি ডিভেইটের পরও জেরেমি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাচ্ছেন না। প্রতিদিনই বিভিন্ন জরিপ আসছে, কিন্তু কোনো জরিপেই এখনো জেরেমি নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। যদিও তিনি আগাচ্ছেন, জনসমর্থন আদায়ে। প্রতিদিন কচ্ছপ গতিতে হলেও বরিস জনসনকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে করবিনের এই এগিয়ে আসা।
ব্রিটেন যে সবসময়ই ভালো সময় কাটিয়েছে তা নয়, চরম দুর্যোগ অতিক্রম করতে হয়েছে মাঝে মাঝে। গত শতকে এরকম ৩টি বছরের কথা উল্লেখ করে বরিস তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ১৯০৬ সালে লিবারেল ডেমোক্রেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার যেমন দেশটাকে নতুন নির্দেশনা দিয়েছিল, ঠিক তেমনি ১৯৪৫ সালে কনজারভেটিভ তাদের ক্ষমতা হারিয়ে লেবারের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে আবারো নতুন জোয়ার এনেছিল দেশটাতে লেবার পার্টি। পার্টির নেতা আটলির নেতৃত্বে সেসময়েই বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ রাজনীতির অন্যতম প্রধান অর্জন এনএইচএস কিংবা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করে দেশটি। টোরি নেতা মার্গারেট থ্যাচার ঠিক এভাবেই ১৯৭৯ সালে সারা ব্রিটেনকে নিয়ে এসেছিলেন অর্থনৈতিক মন্দার গর্ত থেকে।
বরিস মনে করেন, ২০১৯ এরকমেরই একটি সাল, রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার এই সময়ে দেশের জনগণ তার ওপরই আস্থা রাখবে। তিনি এখন উল্লেখ করছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সরকার ৫০ হাজার নার্স নিয়োগ দেবে। দেশের জনগণের একটা বড় ধরনের সংকট হলো ডাক্তারদের (জিপি) সাক্ষাৎ পেতে অপেক্ষা করতে হয়। বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীকে অপেক্ষায় থাকতে হয় দিনের পর দিন। বরিস বলছেন, তিনি তার আগামী দিনগুলোতে অন্তত জিপির সাক্ষাৎ যাতে কমিয়ে আনা যায় তার একটা ব্যবস্থা করবেন। তিনি জনগণের কাছে আবেদন করেছেন, এমনকি গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া টেরোরিস্ট আক্রমণের মতো যে কোনো আক্রমণ তিনিই ঠেকাবেন।
সব মিলিয়ে ব্রিটেনের মানুষও এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। ব্রিটেনের সব মানুষই লেবার কিংবা কনজারভেটিভ কিংবা লিবারেল ডেমোক্রেটদের সমর্থক না। অর্থাৎ রাজনীতির বাইরেও আছে অসংখ্য মানুষ। আর সেজন্যই এ নির্বাচনে নতুন কি পেতে যাচ্ছে দেশটা, তা নিয়ে শঙ্কায় কিংবা এক ধরনের ধোঁয়ার মাঝে আছে দেশের জনগণ। কেউ বলে বরিস মিথ্যাবাদী, তিনি এবং ব্রেক্সিট পার্টির নাইজেল ফারাজ ব্রেক্সিট নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন ২০১৬-এর রেফারেন্ডমের সময়, তার ওপর এখনো আস্থা রাখা যায় না। বরিস ৫০ হাজার নার্স নিয়োগের কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু এনএইচএস তথা স্বাস্থ্য খাত প্রাইভেটাইজেশনের চলে যাওয়ার শঙ্কা এক ধরনের চাউর হয়ে গেছে সারা ব্রিটেনে। বরিস ক্ষমতায় গেলে ব্রিটিশদের অহংকার বলে খ্যাত এনএইচএস তার গৌরব হারাবে, অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাত আর সরকারের থাকবে না। আবার কেউ মনে করছে, জেরেমি করবিন সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষার কথা বললেও তা বাস্তবায়ন করা সহজ নাও হতে পারে।
বরিস জনসনের পাল্লা ভারী হলেও স্কটল্যান্ড তার জন্য দুঃসংবাদই বয়ে আনতে পারে। কারণ স্কটল্যান্ডের প্রধান পার্টি এসএনপির সমর্থন করবিনের দিকেই। সে হিসেবে করবিন কম আসনের ভোটে পরাজিত হলে এসএনপি তার জন্য সহায়ক শক্তি হিসেবেই সরকার গঠনে সহায়তা করতে পারে। সঙ্গে থাকবে হয়তো লিবারেল ডেমোক্রেট। আর এরকম কিছু হলে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা কতটুকু সম্ভব তাও ব্রিটেনের মানুষ ধারণায় রাখছে। কারণ তখন পার্লামেন্ট হয়ে উঠবে সব দলেরই নিজস্ব দাবি আদায়ের দাবার ঘুঁটির মতো। আর সেজন্যই জেরেমি আর স্টারজনের কথায় যেন ১৩ ডিসেম্বরের ভোরে জেগে না উঠতে হয় ব্রিটেনের জনগণের, সেকথাটিই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তিনি তার কথায়।
কোন দিকে এগুচ্ছে ব্রিটেন? আসলেই ব্রিটেন কি এগুচ্ছে সেই শব্দগুলোর দিকে, যে শব্দগুলো বহু উচ্চারিত এবং সত্যি কথা হলো জনগণের ভোটে নির্ধারিত ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’। মানবিক আবেদন নিয়ে ব্রিটেনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে পথ হাঁটা একজন করবিনকে কি বেছে নেবে, জনগণ কি বেছে নেবে লেবার পার্টির এবারের নির্বাচনের স্লোগান ‘ইটস টাইম ফর রিয়েল চেঞ্জ’ নাকি ব্রেক্সিট নামক বিচ্ছেদের জন্যই মানুষ ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনের বুথের দিকে যাবে, এ প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসছেই। ব্রেক্সিট না মানবিকতা- অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই এগুচ্ছে ব্রিটেন, ‘রিয়েল চেঞ্জ’ না ‘ব্রেক্সিট ডান’?
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম