সাধারণত শ্রমিকদের শ্রম আর কষ্টের কথাটা বুঝাতে শ্রম-ঘাম একটা জুতসই শব্দ। শ্রমে-ঘামে যুদ্ধ করে প্রবাসের শ্রমিকরা দেশে রেমিটেন্স পাঠায়। প্রবাসীদের এ রিমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রাখে । যদি দেড় কোটি মানুষও বাংলাদেশের বাইরে থাকে, তাহলে কম করে হলেও ৫ থেকে ৬ কোটি মানুষ এই দেড়কোটি মানুষের উপরই নির্ভরশীল থাকেন সরাসরি। এছাড়া আছে রেমিটেন্স, এই রেমিটেন্সের প্রবাহ থেকে আসা রাষ্ট্রীয় আয়। বাস্তবতা হল, এদের প্রায় সবাই-ই দেশে তাদের পরিবার দেখাশোনা করে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা দেশটিতে দিচ্ছেন তাদের সর্বোচ্চ অংশ।
আরব আমিরাত, সৌদিআরব তথা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংখ্যা কম নয়। তাদের অনেকেই বাংলাদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন। উচ্চ চাকুরীজীবীদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, তবে বড় অংকের না। আর সেজন্যে দেখা যায়, আরব আমিরাত-সৌদি আরবে কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি ব্যবসায়ী-চাকুরীজীবীদের একটা নাক সিঁটকানো ভাব আছেই। শ্রমিক শ্রেণির মানুষগুলোর সুবিধা আদায়ে কথিত উচ্চশ্রেণির মানুষগুলোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও খুব একটা উদ্যোগী হন না। যারা কিছু কিছু সাহায্য-সহায়তা করে থাকেন, তাদের সংখ্যা অল্প। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কারণেই শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হন। বিচার পাবার অধিকার থাকা সত্ত্বেও তারা আইন-কানুন ঘাটাঘাটি করতে উদ্যোগী হতে পারেন না।
একজন শ্রমিকের অফিস-আদালতে দৌড়ানোর মতো সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থান তাদের থাকে না। অন্যদিকে এসব ব্যাপার থেকে শিক্ষিত চাকুরিজীবী শ্রেণি কিছুটা দূরে থাকেন, ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রয়োজনে দেশটির আইন কানুন ঘাটাঘাটি না করে নিজেদের মাঝে থাকতেই পছন্দ করেন। আর সেজন্যই মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ শ্রমিক বিভিন্নভাবেই নির্যাতিত হন, উদয়াস্থ শ্রম দিয়েও ন্যায্য প্রাপ্যটুকু না পাবার বেদনাটুকু আমরা প্রতিনিয়তই দেখি বিভিন্নভাবে। আর সেজন্যই এই মানুষগুলো নির্ভর করে দেশের দূতাবাসগুলোর উপর। দূতাবসগুলোর উপর নির্যাতিত মানুষের অভিযোগ আছে বিস্তর কিন্তু দূতাবাস তাদের রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতার কথাও উচ্চারণ করে থাকেন প্রায়ই, কিন্তু সেবা প্রদানে কিছু কিছু গোয়ার্তুমী এই মানুষগুলোর ভোগান্তি বাড়ায়।
অন্যদিকে দেখা যায় তুলনামূলকভাবে শুধুমাত্র বাংলাদেশের শ্রমিকরাই অধিক অর্থ ব্যয় করে করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাড়ি জমায়। প্রায় পাঁচ বছর আগে সোৗদিআরবের জেদ্দা এয়ারপোর্টে এক ভারতীয় নাগরিক আলাপচারিতায় বলেছিলেন তিনি তার চাকুরীতে ১১০০ রিয়াল বেতন পান, তার এদেশে আসতে খরচ হয়েছে ভারতীয় রুপীতে লাখ খানেকের মত। অথচ এই একই কাজে বাংলাদেশী একজন নাগরিকের ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। একজন ভারতীয় নাগরিক তার সৌদিআরবে আসার খরচ তোলে নেয় এক বছরেই, অথচ আমাদের দেশের একজন নাগরিক ঐ টাকা তুলতে তার দেশে যাবার সময় হয়ে যায়। আমাদের বিদেশ মন্ত্রণালয় এসব ব্যাপারে মনিটরের কথা বলেন প্রায়ই, কিন্তু কার্যত তার প্রতিফলন কতটুকু হয়, তা প্রশ্নই থেকে যায়।
ইউরোপ-আমেরিকার অভিবাসীদের এরকম সমস্যা স্বাভাবিকভাবেই নেই। কারণ শ্রম দিয়ে হোক আর মেধা দিয়ে হোক প্রত্যেকটা মানুষই কোন না কোনভাবে নিজেকে একটা অবস্থানের মাঝে নিয়ে যায় এ দেশগুলোতে। পুরোপুরি নির্ভর হতে হয় না অন্য কারো উপর। অর্থনৈতিক যাঁতাকলে সন্তান-সন্তুতি নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথার কারণ নেই, এমনকি মহিলারও। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন অনেকটা নিশ্চিত থাকে সে দেশগুলোতে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোই প্রত্যেকটা নাগরিকের সুরক্ষা দেয়। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে স্থায়ী আবাস করে নেয়া মানুষগুলো এমনকি খুব একটা দূতাবাসের সমর্থন-সহযোগিতা প্রত্যাশা করে না। কারণ সে দেশীয় আইনই তাকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আবহটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে শ্রমিকদের লম্বা লাইন থাকে দূতাবাসের বারান্দায়। অর্থের জন্য আসা মানুষগুলোর সবচেয়ে বেদনাময় জায়গা হল, মাসের পর কাজ করে এরা বেতন পায় না। কারো ভিসার মেয়াদ চলে যায়। অবৈধ হয়ে পুলিশের চাহনী এদের তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু তবুও ঐ মানুষগুলোই তার শেষ অর্জনটুকুই স্বজন আর দেশকেই দিয়ে যায় উজাড় করে।
এই দিয়ে যাবার মধ্যে অন্য এক শ্রমবাজার সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশি নারীদের জন্য। ২০১১ সালে প্রস্তাব আসে সৌদি আরব থেকে।বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক নিতে চায় তারা। এর অনেক আগ থেকেই সৌদিআরবে এমনকি বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ বন্ধই ছিল। ঢালাওভাবে শ্রমিকদের দরজা তারা খুলে দিল না, শুধু নতুন একটা জানালা খুললো নারীদের জন্য। হঠাৎ করে এই জানালা খোলায় আশাবাদী হল বাংলাদেশ। কিন্তু সে কি বাংলাদেশের প্রতি সৌদি আরবের দরদ না-কি অন্য কিছু। সে ইতিহাস ভিন্ন। কারণ ইতিমধ্যে সৌদিআরবের মরুভূমির মাঝে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিরাট বিরাট অট্টালিকার অভ্যন্তর পৃথিবীর শত শত নারীর অশ্রু আর রক্তে ভেসে গেছে। যৌন নির্যাতনে আর পারিশ্রমিক না পাবার বেদনায় হাজার হাজার ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকার নারীরা চলে গেছ দেশে, নিজের বাস্তুভিটায়। যৌন নির্যাতন আর ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন সইতে পারেনি আমাদের উন্নয়নশীর দেশগুলোও। তাইতো ঐ দেশগুলো সৌদিআরবের সাথে নারী শ্রমিক নিয়োগ চুক্তিগুলোই বাতিল করে দেয়। আর তখন থেকেই সৌদিআরব হন্যে হয়ে বাজার খোঁজে নারীর বাজার। তারা বাজার ঠিকই পায়, স্বল্প পারিশ্রমিকে ২০১৫ সাল থেকে চুক্তি হয় বাংলাদেশের সাথে। সেই থেকেই শুরু। নির্যাতন-নিগ্রহ আর হাহাকারের। ধর্ষণ, অনাহার, বেতন না পাওয়া- সবকিছুই ভাগ্যে জুটতে থাকে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের।
২০১৫ সালে এক চুক্তির পর বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী পাঠানো শুরু হয় সৌদি আরবে। কিন্তু কিছু দিন যেতে যেতেই নারীদের ফেরত আসা শুরু হয়। শ্রমবাজার সৃষ্টির শুরু থেকেই সে কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছিল, কিন্তু ‘রেমিটেন্স’ নামক সোহাগী শব্দের অন্তরালে ঢাকা পড়লো সব কিছুই। একে একে ফিরে আসতে থাকলো নির্যাতিত নারীরা। জমতে থাকল অভিযোগের পাহাড়। এমনকি অনেক নারীকে তাদের বিসর্জিত ইজ্জতের কারণে স্বামী সন্তানরাও তাদের জায়গা দিল না, নিদারুণ বেদনা নিয়ে এই নারীরা কাটাতে থাকলো মানবেতর জীবন।
ফিরে আসার পর ওই নারীরা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ জানালেও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ছিল নিশ্চুপ। সেসময় সৌদি আরব সফর করে এসে সংসদীয় একটি দল দাবিও করেছিল, নারী গৃহকর্মীদের ফেরার কারণ নির্যাতন নয়। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সভাপতি বজলুল হক হারুন বলেছিলেন, ‘সৌদি আরবে অবস্থানরত শ্রমিকরা এবং গৃহকর্মীরা বেশ ভাল আছেন। সেখানে নিয়োজিত গৃহকর্মীদের ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা, সৌদি খাবার খাওয়ার প্রতি অনাগ্রহ এবং দেশের থাকার প্রতি অতি আগ্রহকে দেশে ফিরে আসার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’ কি অকাট্য যুক্তি ! রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্বের কাছে হার মানতে থাকে নির্যাতিত নারীদের হাহাকার।
হাজার হাজার নারীদের অর্থ খোয়ানো আর সম্ভ্রম হারানোর পর গত মাসে অবশ্য মন্ত্রণালয় আংশিকভাবে স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে কাজ নিয়ে যাওয়া নারীরা নানা নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন নিপীড়নেরও শিকার হয়েছেন।
এখন সংসদীয় দলের সেই প্রতিনিধি দলকে কি কোন প্রশ্ন করতে পারবে সেই নির্যাতিত শত-সহস্র নারী ? দেশের অর্থ ব্যয় করে সৌদিআরবে না গিয়ে এখানে বসেই খেয়াল খুশিমত একটা প্রতিবেদন দিয়ে দিলেইতো ল্যাটা চুকে যেত। তাহলে প্রশ্ন কি রাখা যায় না, দেশের লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ ভ্রমণ করে তাদের ‘অকাট্য যুক্তি’র নামে কেন এই প্রহসন। কেন-ইবা তাদের মিথ্যে তথ্যে নির্যাতিত মানুষগুলোর নির্যাতনকে গুরুত্বই দেয়া হল না, বরং ধর্ষিতা আর নির্যাতিতা নারীদের হেয় করে এদের ‘মিথ্যুক’ হিসেবেই জাতির সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হল?
ফিরে আসার এ মিছিল থামছে না, কান্না আর হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস আরও ভারী হচ্ছে দিনের পর দিন। বাড়ছে লাশের বোঝা। বেসরকারি সংস্থা ব্রাক এর অভিবাসন কর্মসূচির পরিসংখ্যান অনুযায়ী সৌদিআরবে ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে এবছর ৯০০ জনের মতো বাংলাদেশী নারী গৃহকর্মী দেশে ফেরত এসেছে। উদ্বেগের ব্যাপার হল, এ বছর সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশী নারী গৃহকর্মী ৪৮ জনের মৃতদেহ দেশে আনা হয়। তাদের মধ্যে ২০ জনই সৌদি আরবে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে আত্মহত্যা করেছেন।
আগেই উল্লেখ করেছি গত মাসে সরকারও এ নির্যাতনের ব্যাপারটাকে আংশিক হলেও স্বীকার করেছে। কিন্তু কথা হল, নারীদের উপর সুনির্দিষ্ট এই অমানবিক নির্যাতনের বিপরীতে দাঁড়াবার কোন মত পদক্ষেপ নিতে পারছে কি সরকার? নারীশ্রমিকদের নিয়ে যে চুক্তি সরকার করেছে, তাতে আপাত দৃষ্টিতে দেশ এবং নারী শ্রমিকের কল্যাণই নিহিত। কিন্তু যে নির্যাতন-পাশবিকতার ক্ষত নিয়ে ফিরছে নারী শ্রমিরা, যে অভিযোগগুলো একের এক জমছে, সে অভিযোগগুলো দিয়েইতো দেশটার শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় একটা চাপ রাখতে হবে, নির্যাতিত নারীদের (শ্রমিকদের) ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধি-বিধান আনতে হবে। শুধুমাত্র বৈধ-অবৈধতার ধুয়া তোলে মানবিক দিককেতো এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ইউরোপ আমেরিকায় অবৈধ নারী পুরুষের সংখ্যা লাখ লাখ , কিন্তু সেকারণে কোন অবৈধ শরণার্থীকে ধর্ষণ-নির্যাতন করলে সে দেশগুলোর নাগরিকতো পার পাচ্ছেন না। মানবিক জায়গাটাতেই আমাদের হাত দিতে হবে। মানবিক জায়গাটাতে যদি দু’রাষ্ট্র এক হতে না পারে, তাহলে ধর্ষণ-নির্যাতনকে সঙ্গী করে তো একতরফা নারী শ্রমিক রপ্তানি চালু রাখতে পারে না একটা দেশ।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম