অর্ধশত বছর থেকে ব্রিটেনে বাংলা পত্রিকা বেরুচ্ছে নিয়মিত। যদিও ব্রিটেনে বাংলা গণমাধ্যমের ইতিহাস শতবর্ষেরও অধিক। লন্ডন থেকে প্রচারিত প্রিন্ট মিডিয়াই ছিল এক সময় পাঠকদের একমাত্র গণমাধ্যম। এই ‘একমাত্র’র ওপর ভর করে অনেক পত্রিকার উত্থান হয়েছে সময়ে সময়ে, এদের মাঝে অনেকগুলো ঝরে পড়েছে, আবার চার-পাঁচটি পত্রিকা এখনো কষ্টে-সৃষ্টে বেঁচে আছে, যার মাঝে দুয়েকটা ছাড়া এখন অনেকটা ফ্রি-ই পাওয়া যায়। পত্রিকার পাঠক কমেছে, অন্যদিকে পত্রিকাগুলোর মান বেড়েছে অনেক। এখন আকাল পড়েছে প্রিন্ট মিডিয়ার। তাই দুয়েকটা পত্রিকা এখন তাদের অনলাইন ভার্সন চালু করেছে। কিন্তু এগুলো সার্বক্ষণিক আপডেট নির্ভর নয়। তাই সত্যি বলতে গিয়ে এই কাগজগুলোর টিকে থাকা প্রশ্নবোধকই বলতে হয়। বার্মিংহাম থেকে এখন প্রিন্ট কোনো পত্রিকা দেখা যায় না, অন্যদিকে ম্যানচেস্টার থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাটি এখন মাসেও অনিয়মিত বেরুচ্ছে।
প্রিন্ট মিডিয়ার এরকম নাজুক বর্তমান সময়েও ব্রিটেনে বাংলা গণমাধ্যমের যেন জোয়ার বইছে। অনলাইন পোর্টালগুলো জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারণ এতে কোনো প্রকার ঝক্কি-ঝামেলা নেই। একজন সম্পাদকই একটা পত্রিকা চালানোর জন্য যথেষ্ট। কারণ কোনো রিপোর্টার-সাংবাদিকের প্রয়োজন হয় না কোথাও। শুধু নিজের শহরে দু’চারজন লোক থাকলেই হলো। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে যে কোনো নিউজই আজকাল হাতের কাছে। প্রিন্ট মিডিয়ার এই সময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে ব্রিটেনে। বাংলা মাধ্যমের ছয়টি টিভি চ্যানেল লন্ডনে তো বটেই সারা ব্রিটেন এবং ইউরোপজুড়ে একটা বড় ধরনের নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে পেরেছে। লন্ডন শহরে তো বটেই, লন্ডনের বাইরের বিভিন্ন বাংলাদেশি অধ্যুষিত শহরগুলোতে এখন টিভি সাংবাদিক আছেন।
কিন্তু এ কথা বলতেই হয়, আকাশ মিডিয়ার কারণেই বাংলাদেশের মতোই সারা ব্রিটেনে অন্তত রিপোর্টারদের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলা গণমাধ্যম বৃদ্ধি পাওয়ার পরও সে হিসেবে ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির কথা ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে কি? একটা মাসের প্রচারিত কিংবা প্রকাশিত নিউজগুলোর দিকে একটু চোখ ফেরালে ক’টা নিউজ পাওয়া যাবে, যেখানে অনুসন্ধান আছে- কমিউনিটিতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম কতটুকুই ফোকাস করা হচ্ছে এসব গণমাধ্যমে। দুয়েকটা বড় সংগঠন কিংবা শুধুমাত্র ছোট ছোট সংগঠনের নিউজগুলোই কমিউনিটির আসল চিত্র নয়। বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নের স্লোগান, বাংলাদেশের বিভিন্ন সংকট কিংবা সম্ভাবনা কতটুকুই উঠে আসছে এসব গণমাধ্যমে। বিরোধী দলের আন্দোলন, সরকারের ব্যর্থতা কিংবা সংকটের বিরোধীদলীয় প্রচার কতটুকু জায়গা করে নিচ্ছে এই গণমাধ্যমে এবং এ নিউজগুলোর প্রভাব কতটুকু পড়ছে এ কমিউনিটিতে তাও ভাবনার ব্যাপার। কারণ এসব নিউজ পাঠক কিংবা দর্শকদের প্রভাবিত করতে পারলে গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থার জায়গাটাও তৈরি হয়।
লন্ডনে বিভিন্ন সময় বাংলা গণমাধ্যমে কমিউনিটির বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রেস কনফারেন্স হয়। প্রেস কনফারেন্সে লন্ডনের সাংবাদিকদের উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক থাকে। প্রতিটি গণমাধ্যম থেকে একজন করে উপস্থিত হলেই মোটামুটি কাভার হয়ে যায় একটা নিউজ। এ নিউজগুলো প্রচার হওয়ার পর কমিউনিটিতে এর প্রভাব কতটুকু পড়ে, এ নিয়ে আলোচনা কতটুকু হয় কিংবা বাঙালিপাড়ার কল্যাণে যারা লন্ডনের দুয়েকটা কাউন্সিলের মিডিয়া অফিসার (বাংলাভাষীদের হয়ে) হিসেবে কাজ করেন, তারাইবা কতটুকু কমিউনিটির সংবাদ বিষয়ক দাবি-সমস্যা তুলে ধরছেন তাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগে, তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। অন্যদিকে অভিযোগ আছে লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস উইংও তাদের কর্মতৎপরতা তুলে ধরতে তাদের নিজস্ব মানুষকেই (সাংবাদিক) বেছে নেয়, যার প্রমাণ লন্ডনে ক’মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর একটা সভায় সাংবাদিকদের বের করে দেয়া। লন্ডনের সিনিয়র কিংবা প্রবীণ-পরিচিত সাংবাদিকদের ব্ল্যাক-লিস্টেড করে রাখাটাতে দূতাবাসের কোনো বাড়তি লাভালাভ হওয়ার কথা নয়।
ম্যানচেস্টারের সহকারী হাইকমিশন গত মাসে একটা মতবিনিময় করেছে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে। সেখানে হাইকমিশনের সার্ভিস, আগামী জানুয়ারিতে ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটে বিমান ফ্লাইট চালু নিশ্চিত করাসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের গণমাধ্যমকর্মীরা এ মতবিনিময় সভায় এসেছিলেন। সভায় সহকারী হাইকমিশনার মূলত দেশের উন্নয়ন আর সম্ভাবনা নিয়েই কথা বলেছেন। তিনি তার আলোচনার শুরুতেই বলেছেন, এটা একটা সৌজন্য আলোচনা এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন এবং পরিকল্পনাগুলোই তিনি উচ্চারণ করেছেন তার আলোচনায়। বিশেষত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারে জায়গা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সারা পৃথিবীতে যে এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, সে কথা আবারো উচ্চারণ করে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে উদ্ভূত বর্তমান সমস্যার কথাটাও তুলে ধরেন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিয়ে তাদের আদি বাসস্থানে নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন পৃথিবীব্যাপী। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে বিশেষত প্রভাবশালী কিছু এনজিওদের অসহযোগিতা, বিশ্ব নেতাদের কারো কারো এতে ইতিবাচক সমর্থন না থাকা প্রভৃতি কথাগুলো উঠে আসে তার আলোচনায়। সহকারী হাইকমিশনার আহ্বান করেছেন, গণমাধ্যমকর্মী কিংবা কমিউনিটি এক্টিভিস্ট কিংবা ব্রিটেনের মূলধারার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদরা যেন রোহিঙ্গা ইস্যুটা ফোকাস করেন। দূতাবাসের প্রধান হিসেবে তিনি যা বলেছেন, তার কথাগুলো আমরা সরকারের উচ্চারিত কথাগুলোর প্রতিধ্বনি হিসেবেই ধরে নিতে পারি। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করা এখানে কোনো বিরাট ব্যাপার নয়। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে যে সংকট চলছে, তার জন্য ব্রিটেনের বাংলাদেশিসহ ইউরোপ-আমেরিকার নেতৃস্থানীয় অভিবাসীরা উদ্যোগ নিতেই পারেন। স্থানীয় এমপিদের কাছে এ ইস্যুটার ব্যাপারে ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। ওয়েবসাইটকে আরো আধুনিকীকরণ এবং জনগণের কাছে আরো সহজ করে তোলার জন্য কিছু প্রস্তাবও গ্রহণ করেছেন।
ম্যানচেস্টার সহকারী হাইকমিশনার গত দুবছর থেকে এ মতবিনিময়টা করছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি বিবেচনায় তার কথাগুলোর প্রচার সে হিসেবে হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। সে দিনের সে উপস্থিতিতে আওয়ামী ঘরানার বাইরেও গণমাধ্যমকর্মীরা ছিলেন, তবে জামায়াত সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকর্মীদের এখানে উপস্থিত না হওয়ার জন্য কেউ একজন ইঙ্গিত দিলেও সহকারী হাইকমিশনার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই এদের কাছ থেকে দূরে থাকার কথাটা ব্যক্ত করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস নিয়ে কিছু কিছু কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দুয়েকটি দেশসহ বিভিন্ন দূতাবাসের অনিয়ম-দুর্নীতির কথাও চাউর হয়েছে। লন্ডন দূতাবাস নিয়েও আলোচনা আছে। তবুও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নিয়েই ক’মাস আগে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব মতবিনিময় করেছে। দূতাবাসগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চাউর হওয়া এরকম সময়ে আমার মনে হয়েছে, গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে ম্যানচেস্টার সহকারী হাইকমিশনের বৈঠকে এক ধরনের পজিটিভিটি আছে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে দূতাবাসগুলো এরকম উদ্যোগ নিতেই পারে। বিশেষত লন্ডন দূতাবাসে প্রেস মিনিস্টার আছেন। বর্তমান প্রেস মিনিস্টার সাংবাদিকদের সঙ্গে সময়ে সময়ে যোগাযোগ রাখেন বলেই লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব সভাপতি জানিয়েছেন। তবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রেস ব্রিফিং করা একটা সময়োপযোগী উদ্যোগ হতে পারে।
যে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দূতাবাসগুলোতে দলীয় লোকগুলো ঘুর ঘুর করে। দলীয় লোকগুলোর সঙ্গে দূতাবাসের সম্পর্ক থাকাটায় কোনো ন্যায়হীনতা কিংবা অস্বাভাবিকত্ব নেই, তবে দূতাবাসের সঙ্গে নামসর্বস্ব চেতনাধারী সুযোগ সন্ধানীরা থাকলে সরকার কিংবা দূতাবাসের জন্য দুর্নামই বয়ে আনে, যা হয়েছে মাত্র ক’মাস আগে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর সভায়।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম।