এক:
ঘৃণা, বিদ্ধেষ, শত্রুতা বাড়াচ্ছে প্রবাসে বাংলাদেশি রাজনীতি
প্রতিবারের ন্যায় এবারও সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন উপলক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র আগমন ঘটবে সাড়ম্বরে। পৃথিবীতে একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে সর্বাধিক সংখ্যক রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের বিশাল বহর এসময় সরকারী খরচে যুক্তরাষ্ট্র আগমন করেন। যদিও তাদের অনেকে জাতিসংঘের অধিবেশনের আসল কাজ কী –তা উপলব্দি করতে পারেন কিনা সন্দেহ হয়।
এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ব্যক্তির রাষ্ট্রিয় অবস্থানের প্রশ্ন অবান্তর। প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীদের তালিকা দেখলেই মানসপঠে অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের চিত্র চোখের সামনে ভাসে। যেন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ‘টিম বাংলাদেশ’ পা রাখছে অলিম্পিক মাঠে। যা বাংলাদেশের বেলায় সংস্কৃতি হয়ে দাড়িয়েছে। সোভিয়েত জমানায়ও সংখ্যায় এতো বড় সোভিয়েত ইউনিয়ন টিম অলিম্পিকে আসতো বলে মনে হয় না।
তবে এটা সত্য যে, প্রতিবছর বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আনন্দ উল্লাস পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নানা ধরণের কর্মসূচি গ্রহন করে। গোটা নিউ ইয়র্কের বাঙালী রেষ্টুরেন্ট বা ক্যাফে ষ্টলগুলোর বিক্রি বাড়ে।
বিশেষত: নিউ ইয়র্কে বাঙালি কমিউনিটির রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র জ্যাকসন হাইটসে বাঙালির উপচেপড়া ভীড় লক্ষ্য করা যায়। বাঙালি রেষ্টুরেন্টগুলোতে সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিদায় পর্যন্ত সময়কালে বেচাকেনায় দিনরাত একা হয়ে উঠে। বছরের অন্য কোন সময় এমন উৎসব চোখে পড়ে না।
বাঙালি মালিকানাধীন প্রিন্টিং প্রেসগুলোর এটাই বড়দিন বা ঈদ। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে পক্ষে বিপক্ষে ব্যানার, ফেস্টুন, লিফলেট ছাঁপাতে নানা কাজে চব্বিশ ঘন্টাই তাদের কাজ করতে হয়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেইট থেকে বাঙালি রাজনৈতিক, আধা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিউ ইয়র্ক আগমন ঘটে । প্রধানমন্ত্রীসহ ঢাকা থেকে সরকারী খরচে উড়ে আসা নেতা ,আধানেতা সকলের সাথে একেকটি সেলফি তুলে প্রবাসীগণ দুধের স্বাধ পানিতে মেটান।
এসময় বিশেষ করে প্রবাসী সরকারদলীয় রাজনৈতিক কর্মী সমর্থকদের অনেকে সপ্তাহের জন্য কাজ থেকে ছুটি নেন। সরকার বিরোধী জোট বা বলয়ের অনেকে যে একেবারেই নেন না, তাও নয়। এভাবে পুরো বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে একধরনের আনন্দদায়ক পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়। নব্বই দশকের পর থেকে যা প্রবাসের বাঙালি কমিউনিটির সংস্কৃতিতে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
এবার আসি আসল কথায়। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সমগ্র প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটি যখন থাকেন আনন্দিত, যখন একটি বিশেষ ঈদ বা উৎসবভাব বিরাজমান থাকে চতূর্দিকে, তখন কিছু অন্ধকার নেমে আসে কমিউনিটির মাঝে এবং ঘটে কিছু অনাকাংখিত ঘটনা। যার মধ্য দিয়ে কমিউনিটির মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা ও পারষ্পরিক দু:সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
প্রবাসের বুকে দেশীয় রাজনীতি চর্চার উপলক্ষে ঘৃন্যকর অপরাজনীতির বিষবাষ্পে গোটা বাঙালি কমিউনিটি কলুষিত হয়। প্রকাশিত হয় বাংলাদেশী রাজনীতির দেউলিয়াত্ব। অপরাজনৈতিক অনুষ্ঠানসমূহ নানাভাবে টেলিভিশন, নিউজ মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের ফলে দেশে বিদেশে ঘৃণা ও তিরষ্কারের ঢেউ আছড়ে পড়ে। বিষয়টি সাধারণত কেউ মেনে নিতে পারেন না। নারীরা তীব্র ঘৃণা করেন। পুরুষরা ন্যাক্ষারজনক অভিব্যক্তি বা মন্তব্য করেন। আর এদেশে জন্ম নেওয়া বা পড়াশুনায় আলোকিত আমাদের তরুণ প্রজন্মের অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারা এইসব রাজনীতিবিদ,আধারাজনীতিবিদদেরকে আফ্রিকার জঙ্গলের হিংস্র দানবদের চেয়েও অধম বলে মনে করছে।
দুই:
দৃশ্যপট এয়ারপোর্ট: বাংলাদেশকে হেয় করার অধিকার রাজনীতিবিদদের নেই
অদ্ভূদ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেই হোন কিংবা যে কোন দলের হোন তাঁর আগমন উপলক্ষে কমিউনিটির আনন্দ দু’ ভাগ হয়ে যায়। একভাগ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কে সাদরে ও সাড়ম্বরে বরণ করতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহন করেন । আর বিরোধীঅংশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁকে রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ, অযোগ্য-অথর্ব প্রমানের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী যেখানে-প্রতিরোধ সেখানে’ ইত্যাদি শ্লোগানে ঊজ্জীবিত হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দেন। বিষয়টি ন্যাক্ষারজনক হলেও প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে বেশ কয়েক বছর থেকে এটি একটি জোরালো সাংস্কৃতিক আবহ লাভ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠনের শাখা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেই হোন না কেন প্রতিবছর আমেরিকায় তাঁর পদচিহ্ন রাখার মূহুর্তে কৌশলে শত বাধা, ব্যরিকেড ভেঙ্গে কিংবা নিয়ম নীতির মধ্যে থেকেই তাঁকে নিউ ইয়র্কের জে এফ কে বিমানবন্দরে সরকার দলীয় হাজারো নেতাকর্মীর ব্যানার, ফেষ্টুনসমেত গগণবিধারী শ্লোগানমূখর মিছিলে স্বাগত জানানোর সংস্কৃতি বিদ্যমান।
আবার একই সময়ে চল্লিশ বা পঞ্চাশ হাত দুরত্বে মুখোমুখি অবস্থানে থেকে সরকার বিরোধী হাজারো নেতাকর্মী রণসাজে সজ্জ্বিত হয়ে ব্যানার-ফেষ্টুনসমেত সরকার বিরোধী ধিক্ষারমূলক শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করেন। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের পক্ষে বিপক্ষে মিছিল দিতে দিতে কখনো কখনো দু পক্ষ মারামারিতে লিপ্ত হন। কখনও রক্তা রক্তির ঘটনাও ঘটে।
এসময় বিভিন্ন দেশের বিমান যাত্রীগণ হতচকিত হন। ভয়ে অনেকে দিকবিদিক দৌড়াদৌড়ি করেন। পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর হুইসেলের উচ্চস্বর, নেতাকর্মীদের চিল্লাচিল্লি, ভয়কাতুরে নেতা ও আধারাজনৈতিকনেতাদের দৌড়াদৌড়ি ও গ্রেপ্তার আতংকিতদের উচ্চস্বর- সব মিলিয়ে সাক্ষাৎ দোযখ দৃশ্যের মতো বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের বুকে নেমে আসেন ক্ষনিকের জন্য।
একসময় পরিস্থিতি শান্ত হয়। সবাই যার যার ঘরে চলে যান। রেখে যান বিপ্লবী স্মৃতি। দু পক্ষের হাজারো নেতাকর্মীর ব্যানার, ফেষ্টুন, পানির বোতল, সিগারেটের প্যাকেট, দৌড়ের গতিতে ফেলে যাওয়া দামী ব্রান্ডের জুতা, ইত্যাদির সমাহারে গড়ে ওঠে কয়েকড্রাম আবর্জনা। ক্লিনারগণ এগুলো সাফ করেন আর বাঙালির কয়েকপুরুষের কপালে ইংরেজী ভাষায় শুদ্ধ উচ্চারণে ‘এফ’ ও ‘বি’ আদ্যাক্ষরের হাজারো গালি জুড়িয়ে দেন। কারণ একটু পূর্বে যা হয়েছে তা প্রতি বছর কেবল বাঙালিরাই এদেশীয়দের সামনে উপস্থাপন করেন।
তিন:
রাজনীতির নামে প্রবাসে গালাগালি আর হাতাহাতির স্বদেশ প্রেম…
এবার যাই জাতিসংঘে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেদিন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখবেন, সেদিন নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সম্মূখে সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দল বা জোট তাঁকে উন্নয়নের সকল প্রকার বিশেষণে তাঁকে’ আখ্যায়িত করে, তাঁর স্তুতি বন্দনায় ব্যানার ফেষ্টুনসহ মিছিল সমাবেশ করেন।
সরকার বিরোধী দলসমূহও একই সময়ে একই স্থানে সরকার দলীয়দের সম্মূখে মাত্র ৫০ বা ৬০ হাত দুরত্ব বজায় রেখে মারমুখি প্রতিবোধ ও মিছিলের আয়োজন করেন। এসব মিছিল সমাবেশে নিজ নিজ দলীয় বা জোট সমর্থক প্রবাসী নেতাকর্মীদের জড়ো করতে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের মাস খানেক পূর্ব থেকে গ্রেটার নিউ ইয়র্ক সিটির পাঁচটি ব্যুরোর প্রতিটিতে ডজনখানেক টাউন হল মিটিং করাসহ নানা ধরনের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়। এসবের পেছনে ব্যাপক অর্থ লগ্নিও করা হয়ে থাকে।
শহরের বাঙালির মিলনকেন্দ্র জ্যাকসন হাইটসে নানান সংগঠনের ব্যানারে অগণিত প্রস্তুতি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এসব প্রস্তুতিমূলক অনুষ্ঠানাদিতে সরকার সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে কিংবা অন্তর্দলীয় গ্রুপিংকে কেন্দ্র করে দু- চারটি ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া নিতান্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রুপলাভ করেছে। এসময়ে চেয়ার ছুড়াছুড়ি কিংবা শারিরিক সংঘর্ষ, মারামারি, অশ্লীল গালিগালাজ, চিৎকার, চেচামেচির মধ্য দিয়ে এক কিম্ভূতকিমাকার পরিস্থিতি সৃষ্টিতে জ্যাকসন হাইটসের বাঙালি কমিউনিটি তাদের বিপ্লবী চেতনায় মেতে উঠে। প্রতিপক্ষের মাথা ফাটানো, রক্ত ঝরানো কিংবা ঝগড়াটে নেতাকর্মীদের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এসময়ে প্রবাসী বাঙালির স্বদেশী রাজনীতির বিপ্লবী চরিত্রের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে।
এভাবে প্রতি বছর ঘৃণ্য ও ন্যাক্ষারজনক ঘটনা ঘটে জাতিসংঘের সম্মুখে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সাধারণ অধিবেশনে যখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা বক্তৃতা প্রদান করেন সদর দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে। তখন সঙ্গতকারনেই দেশী বিদেশী অসংখ্য সাংবাদিক, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান, কুটনীতিকদের আনাগোনার মধ্যে বাঙালি রাজনীতিবিদরা আত্নকলহ বা বিরোধী দলের সাথে রাজনৈতিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সদর দপ্তরের বাইরে।
সরকার সমর্থক ও বিরোধী’ দু পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে দাড়িয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব নোংরা ও কুৎসিত শ্লোগানে একে অপরকে বিদ্ধ করেন। মজার ব্যাপার হলো, দু দলের পক্ষে এসময় ঢাকা থেকে আসা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সক্রিয়ভাবে মাঠে থেকে পাশে দাড়িয়ে কর্মী সমর্থকদের শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগান। নোংরা শ্লোগান শুনতে শুনতে একসময় ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গে। শুরু হয় বোতল ছুড়াছুড়ি, একে অপরকে নোংরা গালিগালাজ, অশ্রাব্য বাক্যকথন।
এসময় প্রতিপক্ষকে ডিম বা টমেটো ছুড়তে পারদর্শী কর্মীটি ঢাকা থেকে উড়ে আসা নেতার বিশেষ আশির্বাদপ্রাপ্তির লক্ষ্যে বিশেষ উপযোগ্যতা লাভ করে। দিন শেষে সন্ধ্যা নামে কিংবা কর্তৃপক্ষের দেওয়া সময়ের শেষ বাঁশি বাঁজে। দেশী রাজনীতির বিপ্লবী নেতাকর্মীগণ যে যার কৃতিত্বের উপর গর্বোন্নোত শিরে গন্তব্যে প্রস্থান নেন। কেউবা শহরে থেকে যায় জাতীয় নেতাদের সাথে কোন সুযোগে সাক্ষাৎ প্রাপ্তির আশায়। কিন্তু, রেখে যায় নোংরা স্মৃতি। সিগারেটের টুকরো, সিগারেটের প্যাকেট, ব্যবহার অনুপযোগী ব্যানার ফেষ্টুনের স্তুপ, ছুড়ে মারা ডিম বা টমেটোর নোংরা অংশ, খাবারের প্যাকেট, ইত্যাদির সমাহারে কয়েক কন্টেইনার আবর্জনা।
যখন গার্ভেজ ক্লিনারগণ রাশি রাশি আবর্জনা পরিস্কার করার পাশাপাশি সমগ্র সমাবেশ এরিয়াকে মেশিনের সাহায্যে পানি দ্বারা ধৌত করেন তখন আমাদের কপালে আরেকদফা গালি জুটে। এছাড়াও সরকারপক্ষ ও বিরোধীবলয় দু পক্ষের মিছিল সমাবেশকে শান্তিপূর্ণ রাখতে পুলিশ বা সিকিউরিটি বাহিনীকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এসময় নিরাপত্তাবাহিনীর মুখ দিয়ে অনাকাংখিত ও অরুচিকর শব্দমালা অনর্গল বের হতে থাকে। যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। বাঙালি জাতির জন্য বেদনাদায়ক ।যা পৃথিবীর অন্য কোন দেশ ও জাতির বেলায় বিরল।
চার:
দেশকে খাটো করা রাজনৈতিক কর্মসূচি এয়ারপোর্ট ও জাতিসংঘের সামনে
প্রথমত: প্রতিবছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্র প্রধানের নিউ ইয়র্ক আগমন উপলক্ষে জে এফ কে এয়ারপোর্ট বা জাতিসংঘের সম্মূখে আগে উল্লেখিত যে মিছিল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের বেলায় নেই।
পৃথিবীর কোন কোন দেশে সামরিক শাসন বা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বা সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বসংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সম্মূখে সারা বছরব্যাপী প্রায়ই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী মিছিল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। যা মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
কিন্তু, প্রতিবছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা দেওয়ার প্রাক্ষালে সরকারের পক্ষে- বিপক্ষে একই সময় একই স্থানে নূন্যতম পাষ্পরিক দুরত্বে পাল্টাপাল্টি মিছিল সমাবেশ, পারষ্পরিক হামলা ও নোংরা খিস্তি খেউড়ের চিত্র কেবল বাংলাদেশীরাই প্রতিবছর প্রদর্শন করছেন। যা বিশ্বসভায় একটি হাজার বছরের সভ্য এবং হার না মানা জাতি হিসেবে আমাদের গর্বিত পরিচয়কে ধুলায় নামাচ্ছে দিন দিন ।
দ্বিতীয়ত: সারা বছর বিশ্বের রাজধানী খ্যাত নিউ ইয়র্কে পৃথিবীর অগণিত দেশের রাষ্ট্রনায়কের আগমন ঘটে। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও ব্যস্ত জে এফ কে বিমান বন্দরে ঐদেশের সরকার পক্ষ ও বিরোধী সমর্থক নেতাকর্মীদের পাল্টাপাল্টি মিছিল সমাবেশসহ রাষ্ট্র প্রধানকে অভ্যর্থনা জানানোর কোন দৃশ্য দূর্লভ। কিন্তু, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত কিংবা রাষ্ট্রিয় সফরে আমেরিকায় পা রাখলেই বিমান বন্দরে শত শত সরকার সমর্থক ও বিরোধী নেতাকর্মীদের মিছিল সমাবেশে যেসব নেতিবাচক ঘটনা ঘটে তা দিয়ে আসলে আমরা কী ম্যাসেজ দিচ্ছি। দুদল স্পস্টত বাংলাদেশকে ঘিরে চরম ভাবে বাংলাদেশকে অপমান অপদস্ত করার দায়ভারটা আসলে কে নিবে?
পাঁচ:
নতুন প্রজন্মদের বাংলাদেশ বিমুখতার দায় কে নেবে?
২০১১সালে আমেরিকায় আসার পর এসব কর্মকান্ডের বিপরিতে সাধারণ বাঙালির চিন্তা ধারা সম্পর্কে জ্ঞাত হতে আমি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন পদধারী নেতাদের কাছে – এ বিষয়ে তাদের ভাবনা জানতে চেয়েছিলাম। দু দলের নেতৃবৃন্দ যে কথা বলেছেন তার সারকথা হলো- ‘সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে যদিও এসব কর্মকান্ড বেমানান বা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য নেতিবাচক। তবে এটি একটি দলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে। এখন দল থেকে কেউ এসবের বিরুদ্ধে কথা বলার অর্থ হচ্ছে, দলীয় রাজনীতিতে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার শামিল। তাই দলে নিজের অবস্থান শক্ত করতে বরং এসব অনুষ্ঠানাদি যাতে আরো প্রবলভাবে করাই হচ্ছে নেতাদের কাছে ত্যাগী,কর্মট ও উদ্যোমী সাহসী নেতা হবার যোগ্যতা অর্জন করা।
কয়েকজন বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ করেছি তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য – সবাই এইসব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নেতিবাচক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বিষোদাগার করে বলেছেন- এসব যত দ্রুত বন্ধ করা যায় ততোই বাংলাদেশ এর জন্য মঙ্গল। অভিবাসী বাংলাদেশী হিসাবে আমরা আর মাথা নিচু করে থাকতে চাই না। যেখানে বাংলাদেশী হিসাবে আমাদের মাথা উচু করে দাড়াবার অনেক কিছু আছে।
নিউ ইয়র্কে জন্ম ও বেড়ে উঠা কয়েকজন তরুণকে -এ বিষয়ে তাদের ভাবনা জানতে চেয়েছি- তাদের সারকথা হলো- প্রতিবছর এসব কর্মকান্ড খুবই অপমানজনক। তাদেরকে খুব ব্যাথিত করে। এসব কর্মকান্ড প্রতিযোগিতামূলক চাকুরী ফিল্ডে বা বন্ধুদের আড্ডায় তাদের অনেক ছোট করে দিচ্ছে। কারণ এসব এখন আর শুধুমাত্র বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে নয়। বাংলাদেশী রাজনীতির বিষয়গুলো এখন অপেনসিক্রেট।
সর্বোপরি সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালির বক্তব্য হচ্ছে যে, আমাদের দেশের হিংসাত্নক নোংরা রাজনীতির আন্তর্জাতিক পরিচিতি দেয়া হচ্ছে বড় অপরাধ। রাজনীতির নামে এই সংস্কৃতি যত দ্রুত বন্ধ হবে ততোই বাংলাদেশের জন্য বিশেষ কনে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা দেড়কোটি অনাবাসীর জন্য মঙ্গল।
ছয়:
বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটি এখন আর বিশ বছর পূর্বের অবস্থানে একেবারেই নেই। বর্তমান তরুণ বাংলাদেশীরা ব্যাপকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে মূলধারায় সামাজিক, ব্যবসা ও কাজে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে । এখানে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মও উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে অগ্রসরমান। একই ভাবে সরকারী বেসরকারী চাকুরীক্ষেত্রে উচ্চমাত্রায় অগ্রসরতা মিলিয়ে আমেরিকার বাঙালি কমিউনিটি যুক্তরাষ্ট্রের গোটা এথনিক কমিউনিটির মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সচেতনতা, আর্থিক স্বচ্ছলতায় সামষ্টিকভাবে দ্রুত অগ্রসর জাতিগোষ্ঠির অন্যতম। তাই সামাজিকভাবে বাঙালি জনগোষ্টির যে কোন নেতিবাঁচক কর্মকান্ড বর্তমানে হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
এ বিষয়ে আমেরিকায় জন্ম ও বেড়ে উঠা তরুণ প্রজন্ম বেশ সচেতন। বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গন, ক্রিড়াক্ষেত্র বা মানবিক বিশ্বের যেকোন ক্ষেত্রে বাঙালি জাতির যে কোন অর্জন বা বিজয় যেমন গোটা বাঙালি জাতিকে উৎফুল্ল, অনুপ্রাণিত ও গর্বিত করে। তেমনি যেকোন নেতিবাচক কর্মকান্ডে বিয়োগাত্নক বিষাদময়তা প্রগাঢ়ভাবে কমিউনিটির সর্বত্র পরিলক্ষিত হয় ।
প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে তাহলে আলোচ্য অপরাজনীতি বা নোংরা রাজনীতি কারা লালন করেন? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে মাটি যত উর্বর সেখানে আগাছার বৃদ্ধিও ততো প্রবল। মূলত: যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীদের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ প্রবাসের বুকে দেশীয় রাজনীতি চর্চার নামে এইসব অনৈতিক রাজনীতির ধারক বাহক।
বিনয়ে নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশী রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার কাছে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি – প্রধানমন্ত্রীকে মিছিল সমাবেশসহ বিমানবন্দর বা জাতিসঙ্গে স্বাগত জানানো এবং বিরোধী দলগুলোর তাঁর বিরুদ্ধে অমার্জিত ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহিভূত ভাবে প্রবাসে হাজারো নেতাকর্মীর সমাবেশ করার বিকল্প কী কিছু নেই? এরকম কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে মূলত: কি অর্জন সম্ভব? এসব রাজনীতিতে দেশপ্রেম এবং প্রবাসে বাংলাদেশকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরা কী সম্ভব হচ্ছে? কিংবা, প্রবাসের ব্যাপকাংশ বাঙালির চাহিদার প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতিবছর এসব নোংরা পরিবেশ রচনা কি বন্ধ করা যায় না?
দু পক্ষর বক্তব্যই এক- সবাই এক জায়গায় একমত যে এইভাবে রাজনীতি ঠিক না। এইধারার রাজনীতির সাথে দেশ এবং দেশপ্রেম এর কোন ছায়া বা ছোয়া নেই। বরং প্রবাসে নতুন প্রজন্মর কাছে আমরা দিন দিন নেগেটিভ ম্যাসেজ বা ইনসিডেন্ট রাখছি। যা খুব দূ:খজনক।
তারা এও বলেছেন যে, এই আদর্শহীন নোংরা অবস্থা অথবা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে বের হতে প্রবাসে গোটা কমিউনিটির জাগরণ জরুরী। এক্ষেত্রে কমিউনিটি সংগঠনসমূহের উদ্যোগী হওয়া একান্ত জরুরী বলে এইসব রাজনীতিবিদরাও মনে করছেন।
প্রবাসে দেশের রাজনীতি চর্চাকারীদের অনেকে আগ্রহবশত দু‘একবার এইসব কর্মকান্ডে অংশ গ্রহন করে এর ভীবৎস অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। যদিও এখনো যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী রাজনীতিতে তারা সক্রিয়অ কিন্তু এসব কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করেন না। এরকম কয়েকজনের কাছে জানতে চেয়েছি যে, ‘ জে এফ এয়ারপোর্ট বা জাতিসংঘের সম্মূখের মিছিল বা কর্মী সমাবেশ থেকে নিজেদের ঘুটিয়ে নেওয়ার কারণ কী ? তারা বলেছেন, ‘এধরণের প্রোগ্রামগুলো অনর্থক ও বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতি প্রবাসে আমদানী করে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যাবহার ছাড়া কিছু নয়।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে- বিপক্ষে যাই হোক না কেন, এটা অনাহুত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ ধরণের অনুষ্ঠানাদি শুধু দেশের সুনামকে ধ্বংস করছে না। প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে তাদের শিকড় থেবে বিচ্ছিন্ন হতে সহায়তা করছে। পাশাপাশি জন্ম নিচ্ছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারণাও।
প্রবাসে দেশপ্রেম বা দেশের সেবা ,উন্নয়ন এর নামে বাস্তবতা বিবর্জিত রাজনীতি খোদ দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যে এবং উন্নয়নে আত্নঘাতি ভূমিকায় চলে যাওয়া থেকে এখনও কী একটু দূরে আছি আমরা? প্রশ্নটা যেমন সহজ, উত্তরও বোধ করি সবার জানা।
ছরওয়ার হোসেন, নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি; ৫২বাংলা টিভি ও স্যোসাল এ্যাক্টিভিস্ট।
আরও পড়ুন: