ভারতের রাজনীতিতে দুঃসময় চলছে উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ভারতের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজেপির কাছে অনেকটা শোচনীয় পরাজয়ের পর দলের সভাপতির পদ ছেড়েছেন রাহুল গান্ধী। সভাপতি পদে প্রত্যাশিত কাউকে না পেয়ে সোনিয়া গান্ধী অনেকটা নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও দলের দুঃসময়ে আবারও হাল ধরেছেন সভাপতি হিসেবে। এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে এখন আর সম্মেলন করে ডেলিগেটদের ভোটে দলের নেতা নির্বাচন পদ্ধতি খুব একটা দেখা যায় না বরং আগে থেকেই নেতা নির্ধারণ করা থাকে। সম্মেলন যদি হয়ও তা হয় লোক দেখানো।
রাজনীতি ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়েই সামনে এগিয়ে যায়। ইতিহাসকে বাদ দিয়ে রাজনীতি হয় না। কংগ্রেসের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে যিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি বর্তমান বাংলাদেশের তথা কিশোরগঞ্জের হাওরের সন্তান আনন্দমোহন বসু। অবিভক্ত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদ অলংকৃত করেই থেমে থাকেননি বরং গণমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বসু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। বিজ্ঞানী জগদ্বীশ চন্দ্র বসুর বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা ক্ষণজন্মা, নিঃসন্তান, বরেণ্য এই রাজনীতিক মৃত্যুকালে কোনো বংশধর রেখে যাননি। আর তাই উত্তরাধিকার তথা বংশ পরম্পরার রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই উপমহাদেশে মৃত্যু পরবর্তীকালে তাকে যেমন কেউ স্মরণ করে না ভারতে তেমনি তার মাতৃভূমি এই বাংলাদেশেও।
শুধু তাই নয় আমরা যেমন তাকে স্মরণ করি না তেমনি তার রেখে যাওয়া প্রাসাদতুল্য পৈতৃক বাড়িটি পর্যন্ত স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে সরকারি কিছু অসাধু কর্মচারীর হীনস্বার্থে এলাকার একজন প্রভাবশালী লোককে তথাকথিত লিজ দেওয়া হয়েছে বলে লোক মুখে শোনা যায়। যদিও লিজ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। ঐতিহাসিক এই বাড়িটি এখন অযত্নে আর অবহেলায় দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার চাইলেই প্রাসাদতুল্য বাড়িটিকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নিয়ে এটাকে সংরক্ষণ করতে পারে যা কি না প্রাচীন নির্মাণ শৈলীর একটি স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ব্যারিস্টার আনন্দমোহন বসু ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র র্যাংলার। র্যাংলার শব্দটির সঙ্গে আমরা অনেকেই হয়তো পরিচিত নই। র্যাংলার হচ্ছে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদত্ত গণিত শাস্ত্রের ওপর সর্বোচ্চ ডিগ্রি। আর বসু ভারত উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এই ডিগ্রি তথা র্যাংলার উপাধি লাভ করেন।
আনন্দমোহন বসু যে শুধু একজন র্যাংলার বা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন বিষয়টি কিন্তু এমন নয়, বরং একজন পরিপূর্ণ কীর্তিমান মানুষ হিসেবে খ্যাতির যে বিস্তৃতি থাকা দরকার তার চেয়ে কোনোকিছুর কমতি ছিল না আনন্দমোহন বসুর । তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে মেট্রিকুলেশন পাস করেন।তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং বিএ উভয় পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।তিনি ১৮৭০ সালে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৭৮ সালে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য বিলেতে পাড়ি জমান। আনন্দমোহন বসু ছিলেন ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রথম কোনো ভারতীয় বাঙালি।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের সমর্থক ছিলেন। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা দেবীকে বিয়ে করে পরবর্তীতে তিনি নিজেকে একজন পরিপূর্ণ ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলেন। কিন্তু এ নিয়ে ব্রাহ্ম ধর্মের তরুণ সদস্যরা ভিন্নমত পোষণ করলে ১৮৭৮ সালে তিনি শিবনাথ শাস্ত্রী, শিবচন্দ্র দেব এবং উমেশ চন্দ্র দত্তকে নিয়ে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২৭ এপ্রিল ১৮৭৯ সালে ছাত্রসমাজ নামে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের একটি ছাত্র সংগঠন চালু করেন। একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে তখনকার সময়ে তার অনেক সুখ্যাতি ছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে তার অবদান পর্যবেক্ষণ করলে। তিনি কলকাতা সিটি স্কুল ও সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহে নিজ বসতবাড়িতে কলকাতা সিটি কলেজের একটি শাখা চালু করেন এবং ১৯০১ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় ময়মনসিংহ কলেজিয়েট স্কুল।
১৯০৬ সালে তার মৃত্যুর পর কলেজ সেকশনটি বন্ধ হয়ে যায়। দুই বছর পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কলেজটি পুনঃচালুর উদ্যোগ নেন। ওই সময় কলেজটির নাম পরিবর্তন করে আনন্দমোহন বসুর নামে অর্থাৎ আনন্দমোহন কলেজ নামকরণ করা হয়। বর্তমানে কলেজটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত। আনন্দমোহন বসু কলকাতা শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি শিশির কুমার ঘোষের ইন্ডিয়া লিগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন বসু তাদের অন্যতম। তিনি সৌরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত ওই সংগঠনের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে আজীবন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার এবং ফেলো সদস্য ছিলেন।
২০ আগষ্ট আনন্দমোহন বসুর ১১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯০৬ সালের ঐ দিনে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর পিতার নাম পদ্মলোচন বসু এবং মাতার নাম ওমা কিশোরী দেবী। তিনি ১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আনন্দমোহন বসু আজ হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিহাসের অতল গহ্বরে। তার জন্ম জেলা কিশোরগঞ্জে অনেক গুণী মানুষের জন্ম হয়েছে। এ নিয়ে কিশোরগঞ্জবাসীর গর্বের শেষ নেই। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের এবং পরিতাপের বিষয় হলো কিশোরগঞ্জের সাধারণ আলোচনায় কিংবা গুণিজনের তালিকায় আনন্দমোহন বসু অনেকটাই উপেক্ষিত। অনেকেই তার সম্পর্কে যেটুকু জানে তা হলো কেবলই ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আনন্দমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকে সৌরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিসহ যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বসু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের রাজনীতিতে আনন্দমোহন বসুর অবদান ছিল অপরিসীম। সে সময়কার রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করলেই তা প্রতীয়মান হয়। অথচ নিজ জেলাতেই আনন্দমোহন বসুর নাম সেভাবে উচ্চারিত হয় না। ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন বর্তমান সরকার কীর্তিমান এই মনীষীর প্রতি ন্যূনতম সম্মানটুকু জানানোর জন্য হলেও তার বাড়িটিকে সরকারি জিম্মায় নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে একটি ‘ঐতিহাসিক স্থাপনা’ হিসেবে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করবে। আজ তার মৃত্যুবাষির্কীর এই দিনে তার জন্মস্থানের একজন মানুষ হিসেবে এমন প্রত্যাশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না।