একখন্ড বাংলাদেশ যেন প্রতিষ্টিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নিউ জার্সি ষ্টেট’র প্রসিদ্ধ প্যাটারসন সিটির হৃৎপিন্ডে। একটি ঠিকানা এমন যে- 203 Bangladesh Blvd, Paterson, NJ 11417। ভাবতে মনটা আনন্দে ভরে উঠে। ছোট শহর হলেও নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই প্যাটারসন সিটির বিখ্যাত ইউনিয়ন এভিনিউকে ‘বাংলাদেশ ব্লুবার্ড’ নামকরণ করেছে প্যাটারসন সিটি কাউন্সিল। ২২শে জুন ২০১৮ থেকে যা অফিসিয়ালি কার্যকর হয়েছে। জাঁকজমকপূর্ণ এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার সাধারন মানুষ । যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালি কমিউনিটিতো বটে, এমনকি গোটা বাঙালি জাতির জন্য যা এ এক গর্ব করার মত সৃষ্ট ইতিহাস । এরকম গৌরবময় ইতিহাসের সৃষ্টিকারী নিউজার্সির বাঙালি কমিউনিটির প্রতি আমাদের অভিনন্দন এবং গভীর শ্রদ্ধা। অভিনন্দন জানাচ্ছি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান কারিগর প্যাটারসন সিটি কাউন্সিলের ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, কমিউনিটি নেতা শাহিন খালিকসহ তাদের, যাদের ক্লান্তিহীন শ্রম-ঘামে আমরা এ গৌরবের অংশিদার হলাম। অভিবাদন জানাচ্ছি প্যাটারসন সিটি ও নিউ জার্সি সিটি কাউন্সিলের সকল নেতৃবৃন্দ, কর্মকর্তা ও কলাকুশলীদের এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি।
বাংলাদেশ ব্লুবার্ডের আনুষ্টানিক অভিযাত্রাকে বরন করতে নানামূখি কর্মকান্ডের পাশাপাশি এনাম চৌধুরী সম্পাদিত ‘উদ্ভাস’ নামে স্মারক প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত স্মারকের জন্য আনন্দিতচিত্তের সৌরভকে প্রকাশ করতে বাল্যবন্ধু ও বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক এজিএস নুরুজ্জামান সোহেলের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারিনি। তাই সংক্ষিপ্ত পরিসরের মধ্যে বৃহৎ বিষয়ের বস্তুনিষ্ট আলোচনার ইচ্ছা থাকা সত্বেও অনেক কিছু তুলে ধরতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।
১৭৯১সালে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলের অন্যতম জনক আলেক্সান্ডার হ্যামিল্টন প্যাটারসন সিটির গোড়াপত্তন করেন। নিউ জার্সি ষ্টেটের প্রথম এ্যাটর্ণী জেনারেল ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী, সিনেটর এবং নিউ জার্সির সাবেক গভর্ণর উইলিয়াম প্যাটারসনের নামে শহরের নামকরণ করা হয়। নিউ জার্সির প্যাসাইক কাউন্টির (Passaic County)র বৃহত্তম শহর প্যাটারসন সিটির আয়তন প্রায় ২২বর্গ কিঃ মিঃ। প্যাসাইক কাউন্টির জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ আর প্যাটারসন সিটির জনসংখ্য প্রায় এক লক্ষ পয়তাল্লিশ হাজার। এর মধ্যে হিসাবমতে বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় পনেরো হাজার হলেও বাস্তবে তা বিশ থেকে পঁচিশ হাজারের কম নয়। মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন ভাগের বেশী এশিয়ান। যার মধ্যে প্রায় দুই ভাগ বাঙালি কিংবা বাংলাদেশী বংশদ্ভুত। যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত বর্ধমান বাঙালি জনগোষ্টির বৃহৎ আবাসভূমির তালিকায় প্যাটারসন সিটি অন্যতম।এখানকার বাঙালি জনগোষ্টি ব্যবসা- বানিজ্য, শিক্ষা, আবাসন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে । যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণে, লালনে কিংবা বিকাশে প্যাটারসন সিটির বাঙালি কমিউনিটির অবদান অনস্বীকার্য।
প্রতিবছর এখানে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপনকে ঘিরে ‘বাংলাদেশ ডে প্যারেড’ পালিত হয়। মহান একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়ম্বরে পালনে নিউজার্সির বাঙালি কমিউনিটির সংহত অবস্থান পৃথিবীর প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটিতে বিরল।এই ঐক্য আর আর সংহতির মধ্রি দিযেই মূলধারার স্থানীয় রাজনীতিতে দিনে দিনে বাঙালির দৃঢ় অবস্থান সুদৃঢ় হচ্ছে। প্যাটারসন সিটির ওয়েষ্ট সাইড পার্কে ২০১৫ সালে সরকারীভাবে প্রতিষ্টিত হয়েছে বাঙালির শৌর্য, গৌরব আর অহংকারের প্রতিক ৫২’র ভাষা শহীদদের রক্তরাঙা শহীদ মিনার। Passaic County Board of Chosen freeholders with assistance from the New Jersey Community Development Corporation (NJCDC)’র এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার অর্থায়নে প্রতিষ্টিত মনোরম শহীদ মিনারে কেবলমাত্র সারা বছর একই সাথে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ঢেউ খেলে না, এখানে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবসে বিভিন্ন দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষ বাঙালির বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসকে নতমস্তকে কূর্ণিশ করে উচ্চারণ করে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভূলিতে পারি” । তাছাড়া সারা বছর ঐ পার্কের দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষনের কেন্দ্র ঐ শহীদ মিনার। যা বিশ্বে বিরল। এখানে শেষ নয়।বাংলাদেশের মানুষের সুদৃঢ় অবস্থানের কারনেই ২০১৫সালে প্যাটারসন সিটির Van Houten Street’কে জালালাবাদ ষ্ট্রিট (Jalalabad Street) নামকরণ করা হয়েছে। নিউ জার্সির বিখ্যাত ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই জালালাবাদ ষ্ট্রিটেই অবস্থিত।
কিভাবে এই অর্জন সম্ভব হলো? হ্যাঁ, এটাও নিউ জার্সির বাঙালি কমিউনিটির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। ২০১২সালে প্যাটারসন সিটি কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি হিসেবে কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হন মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান। তখন মূলধারায় আলোর যাত্রা কেবল শুরু হয়েছিলো। ২০১৭ সালে কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হন আরেক বাঙালি শাহিন খালিক। যিনি দীর্ঘদিন থেকে কমিউনিটির কথাই বলে আসছেন। এই কমিউনিটির ব্যাপক অর্জন তাঁর হাত ধরেই।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ১নং আলীনগর ইউনিয়নের টিকরপাড়া গ্রামের মরহুম আব্দুল খালিক’র ছেলে শাহিন খালিক পিতা মাতার সাথে ১৯৯০সালে আমেরিকায় পাড়ী জমান। তিন ভাই ও চার বোনের সকলেই নিউ জার্সিতে বসবাস করেন। পেশায় ব্যবসায়ী শাহিন খালিক কালক্রমে একজন সমাজ সচেতন বাঙালি হিসেবে দেশে ও প্রবাসে সমাজসেবায় আত্ননিয়োগ করেন। কমিউনিটি রাজনীতির পথপরিক্রমায় তিনি ২০১৭সালে প্যাটারসন সিটির ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। স্থানীয় বাঙালি কমিউনিটির দাবীর সাথে তার একান্ত আন্তরিকতার সমন্বয়ে প্যাটারসন সিটির ইউনিয়ন এভিনিউ আজ ‘বাংলাদেশ ব্লুবার্ড’ নামকরণ করা হয়েছে। কাউন্সিলম্যান হিসেবে প্যাটারসনের মুসলিম কমিউনিটির দীর্ঘদিনের দাবী ও তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্যাটারসন সিটির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যাহ্নভোজের মেন্যুতে মুসলিম শিশুদের জন্য হালাল খাবার পরিবেশনের উদ্যোগ গ্রহন করেছে সিটির শিক্ষাকর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য হালাল খাবার পরিবেশনের পাইলট প্রজেক্ট চলমান। যা নিউ জার্সি ষ্টেট’র দ্রুত বর্ধনশীল মুসলিম কমিউনিটির জন্য বিশাল অর্জন। আমেরিকার ন্যায় জন্মভূমি বাংলাদেশেও উন্নয়নমূখি সামাজিক কর্মকান্ডে শাহিন খালিকের মুক্ত হস্ত প্রসারিত। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তায় তাঁর পিতার নামে প্রতিষ্টিত আব্দুল খালিক ফাউন্ডেশন নানামূখি কর্মকান্ডের মাধ্যমে সমাজোন্নয়নে বলিষ্ট অবদান রাখছে। এছাড়াও তিনি বিয়ানীবাজার উপজেলার প্রসিদ্ধ অনলাইন নিউজ পোর্টাল Beanibazarbarta24.com ও জনপ্রিয় অনলাইন টিভি ABTV’র অন্যতম পরিচালক।
নিউ জার্সির বাঙালি কমিউনিটির নানা ক্ষেত্রে সাফল্য যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বময় বাঙালি কমিউনিটির সামাজিক-রাজনৈতিক উত্তরণে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। ভয়কে জয় করে প্রতিকুল পরিবেশে ঠিকে থাকার প্রানান্তকর লড়াইয়ের পাশাপাশি প্রবল ইচ্ছাশক্তিই সফলতার নিয়ামক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রোজভেল্ট এর বিখ্যাত বানী “The only thing we have to fear, is fear itself”কে সম্মূখে রেখে পুরো কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে মূলধারার রাজনীতির দিকেই।
প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটি তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় নিউ জার্সির বাঙালি কমিউনিটিকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে পারে অনায়াসে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদের অরিজিন পরিচয়ে গৌরবের ক্ষেত্র খুজে পাক। বিশ্বময় বাংলা ও বাঙালির জয় হোক। সকলের প্রতি রইলো অনন্ত আশাবাদ।জয়বাংলা।