হাকালুকি হাওর: খাদ্যের যোগানদাতা
খাদ্যের যোগানদাতা হাকালুকি হাওর প্রকৃতির অশেষ বদান্যতার নিদর্শন। এখানে মমতাময় প্রকৃতি আমাদের জন্য রেখে দিয়েছে খাদ্যের বিপুল যোগান। জীববিজ্ঞানীদের মতে, হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে এবং তারা বিলুপ্তপ্রায়।
এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। লোকে হাকালুকিতে যায় মূলত অতিথি পাখি দেখতে। কেউ কেউ বর্ষাকালে শুধু দিগন্তবিস্তৃত পানির সৌন্দর্য দেখতেও হাকালুকিতে যায়।
শীত মৌসুমে হাওর মুখরিত থাকে পরিযায়ী পাখিদের আড্ডায়। জীবনের উপযোগী পরিবেশ আর অফুরান খাদ্যভাণ্ডার বারেবারে নিয়ে আসে পরিযায়ী পাখিদের। তাদের কিছু কিছু ইদানীং এখানেই স্থায়ী উপনিবেশ গড়তে শুরু করেছে! মাছ, ধান, গম, সরিষা, চিনাবাদাম আর বিচিত্র ধরনের সবজি চাষ হতো হাকালুকিতে।
ইদানীং সেসবেও পিছটান দিয়েছে স্থানীয় কৃষকরা। হাওরের বিলগুলোতে নজর পড়েছে পুঁজিপতি শ্রেণির, তারা লিজ নিয়ে বঞ্চিত কিংবা ফতুর করে ছেড়েছে মৎস্যজীবীদের! চৈত্রে কিংবা বৈশাখে যখন পানি নেমে গিয়ে বিশাল বিশাল মাঠ ভেসে ওঠে, তখন হাকালুকির ঐসব মাঠে গিয়ে দাঁড়ালে আপনি অদ্ভুত এক গন্ধ পাবেন, ঠিক চুনের গন্ধ।
পানি যখন নামে তখন কাদার মধ্যে আটকা পড়ে অজস্র ঝিনুক এবং ধীরে ধীরে তাদের খোলস পচে-গলে এই চুনের গন্ধ বেরোয়! ঝিনুকের খোলস থেকেই তো উৎকৃষ্ট চুন উৎপাদিত হয়, তাই না? হাকালুকি তাই ঝিনুক উৎপাদনেরও এক বিরাট সম্ভাবনার নাম।
শুকনো মৌসুমে হাকালুকি একসময় ছিল গাবাদিপশুর বিশাল চারণভূমি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে গরু এবং মহিষ পালন করতেন আব্বা। শুকনো মৌসুমে ঘাসের আকাল দেখা দিত। তখন গৃহপালিত গরু-মহিষ পাঠিয়ে দেয়া হতো হাকালুকির বাথানে। হাকালুকির পুষ্টিকর ঘাস খেয়ে তারা মাংসের দলা হয়ে বাড়ি ফিরত কয়েকমাস পর!
বাথান কী? বর্ষাকালে হাওর এলাকায় পলিমাটি পড়ায় বিলগুলি ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর সেখানে কিছু কিছু জায়গায় ধান চাষ করা হয়। ফসল কাটার পর বিলগুলিতে হাজার হাজার গবাদি পশু বিচরণ করে। এই বিচরণ ভূমির কারণে বহুকাল আগে থেকেই হাওর এলাকায় গড়ে ওঠে বাথানপদ্ধতি। বছরের কয়েক মাস, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে হাওর এলাকায় বসবাসরত এক শ্রেণীর লোক অন্যের গরু-মহিষের তত্ত্বাবধান করে। বিনিময়ে প্রাপ্ত দুধ বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। আর এসব পশু ব্যবহার করে হাল-চাষে। এই-ই ছিল তাদের পেশা। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে গরু-মহিষ মালিকের নিকট ফেরত পাঠায়।
জনশ্রুতি আছে, এক সময় হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি বসবাসরত কুকি ও নাগা উপজাতি তাদের ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করে ‘হাকালুকি’। হাকালুকি অর্থ লুকানো সম্পদ। প্রচলিত কাহিনীর মধ্যে আরো আছে, বহু বছর পূর্বে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘লুকি দেয়’ অর্থাৎ লুকিয়ে থাকে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি’।
এও বলা হয় যে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচন্ড এক ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক নৃপতি ও তাঁর রাজত্ব মাটির নিচে তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘আকালুকি বা হাকালুকি’।
আরও শোনা যায় যে, এক সময় বড়লেখা উপজেলার পশ্চিমাংশে হেংকেল নামে একটি উপজাতি বাস করত। হেংকেলদের বসবাস এলাকার নাম ছিল ‘হেংকেলুকি’।
হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮১.১৫ বর্গ কিমি। হাওরটি ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। হাওরের ৪০% বড়লেখা, ৩০% কুলাউড়া, ১৫% ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০% গোলাপগঞ্জ এবং ৫% বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত।
হাকালুকিতে প্রায় ২৩৮টি বিল রয়েছে। প্রায় সারাবছরই বিলগুলিতে পানি থাকে। উলে¬খযোগ্য বিলসমূহ হলো: চাতলা বিল, চৌকিয়া বিল, ডুলা বিল, পিংলার কোণা বিল, ফুটি বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ারকোণা বিল, বালিজুড়ি বিল, কুকুরডুবি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল, দিয়া বিল, ইত্যাদি।
হাকালুকি হাওরে প্রচুর পরিমাণ মৎস্যসম্পদ রয়েছে। হাওরের বিলগুলি অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাস। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, এই হাওর হলো মাদার ফিশারি। এখানে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির মাছ রয়েছে। হাওর এলাকায় প্রধানত পেশাদার জেলে, মৌসুমি জেলে ও খোরাকি জেলেদের বসবাস রয়েছে। হাকালুকি হাওরের বিলগুলিতে বিভিন্ন জাতের বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। তবে এক সময়ের অন্যতম আকর্ষণীয় জলময় নিম্নভূমির বনাঞ্চল (Swamp Forest ) এখন আর তেমন নেই। হাকালুকি হাওর ইকোট্যুরিজম শিল্প বিকাশের এক অনন্য হাতছানি।
মাধবকুণ্ড: পাথারিয়া পাহাড়ের কান্না
সুদূর অতীত কাল থেকে কাঁদছে যে পাহাড় তার নাম পাথারিয়া। তার কান্নার নাম দিয়েছি আমরা জলপ্রপাত; মাধবকুণ্ড। শীত-বসন্তে তার কান্না থাকে কম, বর্ষায় বেশি। বর্ষায় যদি একা একা দেখতে যান মাধবকুণ্ড, গিয়ে বসেন তার সামনে, ঘোর লেগে যাবে আপনার! সারা বছর দলে দলে লোক দেখতে আসে মাধবকুণ্ড বা পাথারিয়া পাহাড়ের কান্না। পাথারিয়া পাহাড় মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখায় অবস্থিত। আর এই পাথারিয়া পাহাড়ের গায়ে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের স্রোতধারা বহমান এবং এই পাহাড় থেকে পতনশীল। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ‘মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক’। এই ইকোপার্কে এখনো বিলুপ্তপ্রায় বনমোরগের দেখা পাওয়া যায়!
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত: পাথারিয়া পাহাড়ের কান্না সুদূর অতীত কাল থেকে কাঁদছে যে পাহাড় তার নাম পাথারিয়া। তার কান্নার নাম দিয়েছি আমরা জলপ্রপাত; মাধবকুণ্ড। শীত-বসন্তে তার কান্না থাকে কম, বর্ষায় বেশি। বর্ষায় যদি একা একা দেখতে যান মাধবকুণ্ড, গিয়ে বসেন তার সামনে, ঘোর লেগে যাবে আপনার! সারা বছর দলে দলে লোক দেখতে আসে মাধবকুণ্ড বা পাথারিয়া পাহাড়ের কান্না। পাথারিয়া পাহাড় মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখায় অবস্থিত। আর এই পাথারিয়া পাহাড়ের গায়ে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের স্রোতধারা বহমান এবং এই পাহাড় থেকে পতনশীল। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ‘মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক’। এই ইকোপার্কে এখনো বিলুপ্তপ্রায় বনমোরগের দেখা পাওয়া যায়!
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত সিলেট সদর থেকে ৭২ কিলোমিটার, মৌলভীবাজার জেলা-সদর থেকে ৭০ কিলোমিটার, কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে ৩২ কিলোমিটার এবং কাঁঠালতলী থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। মাধবকুণ্ড যেতে হলে আপনাকে প্রথমে বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী বাজারে যেতে হবে। সেখান থেকে পূর্ব-দিকে আরো ৮ কি.মি. গেলে দেখা দেবে অরণ্যের এই পরী।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ছাড়াও এই ইকোপার্কে রয়েছে আরেকটি জলপ্রপাত, যা মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত থেকে অনতিদূরে অবস্থিত। শিবমন্দিরের বিপরীত দিকের পাথুরে ছড়া ধরে গেলে এই জলপ্রপাতের দেখা পাওয়া যায়। এই জলপ্রপাতটি ‘পরীকুণ্ড জলপ্রপাত’ নামে পরিচিত। তবে এই জলপ্রপাতটি কেবল বর্ষাকালেই প্রাণ ফিরে পায়।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত হিসেবে সমধিক পরিচিত। পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম: আদম আইল পাহাড়) কঠিন পাথরে গঠিত আর এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। অর্থাৎ, গঙ্গামারা ছড়া হয়ে বয়ে আসা জলধারা প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু থেকে নিচে পড়ে মাধবছড়া হয়ে প্রবহমান। সাধারণত একটি মূল ধারায় পানি সব সময়ই পড়তে থাকে, বর্ষাকাল এলে মূল ধারার পাশেই আরেকটা ছোট ধারা তৈরি হয় এবং ভরা বর্ষায় দুটো ধারাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পানির তীব্র তোড়ে। জলের এই বিপুল ধারা পড়তে পড়তে নিচে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুণ্ডের। এই মাধবছড়ার পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হতে হতে গিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরে।
কুণ্ডের ডানপাশে পাথরের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে একটি গুহার, যার স্থানীয় নাম কাব। এই কাব দেখতে অনেকটা চালাঘরের মতো। মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে স্নানার্থীরা কাবের নিচে দাঁড়িয়ে ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে থাকেন। কথিত আছে, পুরাকালে গৌরী দেহান্তরিত হলে মহাদেব (মাধবেশ্বর) প্রিয়াবিরহে ব্যথাকাতর মনে প্রিয়ার নিষ্প্রাণ দেহ কাঁধে নিয়ে অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় গৌরীর দেহের অংশ যেখানে যেখানে পড়েছে, সেখানে সৃষ্টি হয়েছে তীর্থক্ষেত্রের। আর পাথারিয়ার গভীর অরণ্যে গৌরীর একটা অংশ পড়েছে বলে দাবি করা হয়।
তাই মাধবকুণ্ড এলাকায় রয়েছে সনাতন ধার্মাবলম্বীদের তীর্থ তথা মন্দির। তবে মন্দিরে ভক্তদের ভিড় তেমন একটা দেখা যায় না। মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক এলাকায় এককালে কমলা-বাগান ছিল; ছিলো আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, সুপারি ও পানের বাগান। এখানে ফলতো লেবুসহ অন্যান্য ফলমূল।
এছাড়া ছিল বিভিন্ন প্রকার বনজ গাছপালা। কিন্তু বর্তমানে এর অধিকাংশই অতীত। ‘সামাজিক বনায়ন’-এর নামে প্রাকৃতিক গাছপালা কেটে রোপণ করা হয়েছে বিভিন্ন হাইব্রিড গাছপালা, যেমন: অ্যাকেশিয়া। ঔষধি ও অর্থকরি গাছ আগরও আছে রোপণ-তালিকায়। কিন্তু প্রাকৃতিক বন নষ্ট করে এই সামাজিক বনায়ন পরিবেশ ধ্বংসই করেছে বেশি।
মাধবকুণ্ড এলাকায় বাস করেন আদিবাসী খাসিয়া সম্প্রদায়। খাসিয়ারা গাছে গাছে পান আর পাহাড়ের গায়ে জুম-চাষ করে। মাধবছড়াকে ঘিরে খাসিয়াদের জীবনযাত্রা আবর্তিত হয়। পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে অন্যতম বিখ্যাত এই স্থানটিতে বর্তমানে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই ইকোপার্কের অন্যতম আকর্ষণ হলো মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, পরিকুণ্ড জলপ্রপাত, শ্রী শ্রী মাধবেশ্বরের তীর্থস্থান, এবং চা-বাগান।
খালেদ রাজ্জাক: কবি, শিক্ষক ও নিসর্গপ্রেমিক
আরও পড়ুন: