বাংলাদেশের গুজব এখন এক পরিচিত শব্দ। এই শব্দটা একাকার হয়ে আছে দেশটির সঙ্গে। শব্দটা ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব তৈরি করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বারবার বাংলাদেশে। জান-মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। সরকার গুজব প্রতিরোধে তৎপর থাকলেও পুরোপুরি এ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আর তাই সময়ে-অসময়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দানা বেঁধেছে, গুজবের ডাল-পালা মেলেছে। আর তাই পরিচিতি ‘চিল কান নিয়ে যাচ্ছে’র পেছনে অস্থির দৌড় দিয়েছে মানুষ।
গুজব রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবাই-ই রাজনৈতিক প্রয়োজনে ইস্যু খোঁজে। এই ইস্যুগুলোই দেখা যায় কোনো কোনো সময় সমাজ কিংবা নাগরিক জীবনে অস্থিরতা তৈরিতে সহায়ক হয়ে ওঠে। গুজব যেহেতু ইতোমধ্যে এক সামাজিক অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে, সে হিসেবে সব পক্ষই একে অপরের ওপর গুজবের দায় দিতে চাইছে সুচতুরভাবে। এতে রাজনৈতিক-সামাজিক এমনকি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একটা অস্থিরতা দৃশ্যমান।
হারপিক ও ব্লিচিং পাউডার বেসিনে ঢেলে দিলে মশার বংশ ধ্বংস হয়ে যায়- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল এ কথাটা। আমরা অনেকেই হয়তো ভাবতে পারি এ ব্যাপারটা হতেই পারে না। কিন্তু ঢাকাবাসী যারা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটা দিন ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছে, সেখানে ভেসে যাওয়া খড়কুটোকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সঙ্গী করতে চাইবে। আমরা বলতেই পারি এ এক অবৈজ্ঞানিক কিংবা বাস্তবতা বিবর্জিত দুটো কেমিক্যালের সংমিশ্রণ, কিন্তু মানুষ যেখানে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না পাবে, সেখানে খড়কুটো কেন, বানের পানিতে ভাসতে থাকা কোনো হিংস্র প্রাণীর কাছেও প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঠাঁই পেতে চাইবে। আর সে জন্যই এ রকম একটা মিথ্যাচার এমনকি দায়িত্বশীল মানুষও দায়িত্বহীন হয়ে তাদের আইডি থেকে শেয়ার দিয়েছে। যদিও তাৎক্ষণিক সচেতনতার কারণেই এ দায়িত্বহীন মিথ্যাচার দিয়ে হারপিক কিংবা ব্লিচিং পাউডারের অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করা গেছে।
ছেলেধরা গুজবে তো সে সময়ও মেলেনি একেবারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝরে গেলেন একজন মা রেনু। চার বছরের তুবা মেয়েটি অনাথ হলো। সামাজিক নৃশংসতা কোন পর্যায়ে গেলে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছিই ঘটে যায় এই নৃশংসতা- একজন মা মরছে কিছু জানোয়াররূপী মানুষের উল্লাস নৃত্যে আর এই দৃশ্যটি দেখেও নির্বিকার থেকে আরো অনেক মা কিংবা অভিভাবক কিংবা অসংখ্য মানুষ উপভোগ করে নির্মমতার ওই হোলি উৎসব। সমাজ-রাষ্ট্র এ দায়ভার কি এড়াতে পারে কোনোভাবে? দুধ নিয়ে কেলেঙ্কারি হয়েছে। এর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে দুধ নিয়ে আলোচনা এসেছে। পক্ষে-বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে মানুষ। আবার একই ব্যাপার নিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে ভিন্ন আলোচনাও আসছে। অর্থনৈতিক ব্যাপারটা উচ্চারিত হচ্ছে এখানেও। তাহলে নাগরিক নির্ভরতা পাবে কোথায়?
আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষত ফেসবুক হয়ে গেছে যেন এখন বিশ্বস্ত এক আতঙ্কের নাম। কিশোর-তরুণী-যুবক-প্রৌঢ় যেন ফেসবুকেই নিজেকে খোঁজে। প্রাণ খুলে কথা বলতে গিয়ে অতিকথনে ভরে ফেলে অনেকেই তাদের আইডি। এ এক অবাধ আত্মমুখী প্রচারণা, যা এক ধরনের মানসিক বৈকল্যই তৈরি করছে। ‘যার যত বন্ধু, তিনি ততই জনপ্রিয়’ এই মন্ত্রে প্রত্যেকটা মানুষ নিজেদের বন্ধুদের মাঝে আকর্ষণীয় করে তুলছে, কার আগে কে তথ্য দেবে, দেবে মৃত্যুর সংবাদ কিংবা বিভীষিকার ছবি, আর তা করতে গিয়েই হারপিক আর ব্লিচিং পাউডার এক হয়ে ফেসবুকেই তারা নতুন কারখানা বানায়, মশা নিধনের কিংবা ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে মৃত্যু ত্বরান্বিত করে রেনুর মতো মায়ের।
অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। ফেসবুক বলি কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলি, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি এমনকি জনজীবনে এ মাধ্যমগুলো নিয়ে এসেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব দেশই এই যোগাযোগ মাধ্যমে জেগে উঠেছে। যেখানে এমনকি কথা বলার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ জেগে উঠেছে, সোচ্চার হয়েছে মানুষের মুক্তচিন্তার হাতিয়ার। নুসরাত নিয়ে যেমন একটা বাংলাদেশ জেগে উঠেছে, তেমনি সৌদি আরবের নাগরিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড বিশ্ব মাতিয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া কিংবা রোহিঙ্গা ইস্যুসহ অনেকে অনেক ঘটনা দুর্ঘটনা আমাদের মানবিক বোধ জাগ্রত করে এ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতেই।
নারী-শিশুরা ধর্ষিতা হচ্ছে, ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হচ্ছে, সামান্য কথা কাটাকাটিতে প্রাইভেট কারের চালককে তারই সতীর্থ কোচের নিচে ফেলে পঙ্গু করে দিচ্ছে। ধর্মের পবিত্রতাকে ব্যবহার করে চলছে অনৈতিকতা। স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের ওপর পাশবিকতা চালাচ্ছে, ধর্ষণ করছে। প্রকাশ্যে কুপিয়ে বা গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। এগুলো গুজব নয়। হিংস্রতা-নিষ্ঠুরতা হয়ে গেছে এখন এক সামাজিক অনুষঙ্গ। কারণ এই হিংস্রতা কিংবা নিষ্ঠুরতা চলে নির্বিকারভাবে রাষ্ট্রের প্রচলিত নিয়ম-আইনকে উপেক্ষা করেই। নারায়ণগঞ্জে ত্বকীকে হত্যা করা হলো, বিশ্বজিৎকে সবার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হলো, আয়শা আখতারের সামনে তার স্বামী রিফাতকে কোপানো হলো, এসব নৃশংসতার শেষ কোথায়? রিফাত হত্যার ভিডিও ফুটেজে সব কিছুই দেখেছে এ বিশ্ব। তবুও কেন জানি এখন আয়শাই হয়ে গেল সবকিছুর ফোকাস। তার রিমান্ডের আড়ালে এমনকি খুনিদের কার্যকলাপ ঢাকা পড়ে গেল যেন ক্রমশ।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, সয়লাব হয়ে যাচ্ছে ঢাকা। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এর ভয়াবহতা। আগস্ট মাসে এর তীব্রতা আরো বাড়বে। অথচ ডেঙ্গুকে নিয়ে প্রথমাবস্থায় জনগণের শঙ্কাকে বলা হয়েছে গুজব। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে অপবাদ দেয়া হয়েছে। গুজব ছড়ানোর বিবৃতি এসেছে। তবে অতি সম্প্রতি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের উক্তি আমাদের আশান্বিত করে। গুজবের বাংলাদেশে ঢাকার দুই মেয়রের ব্যর্থতার কথা তিনি ইঙ্গিতে উচ্চারণ করে দায় নেয়ার যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন তা আমাদের অবশ্যই আশান্বিত করে। অন্যদিকে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেয়াও মানুষকে কিছুটা স্বস্তির মধ্যেই রাখতে পারছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মৃত্যুর পর যখন দুই লাখ টাকার কাছাকাছি বিল আসে মাত্র ২৪ ঘণ্টায়, তখন কেন জানি নির্ভরতা হারায় মানুষ। ৫০০ টাকার ডেঙ্গু ফিতে যখন ২৬০০ টাকা নেয়া হয় কিংবা যখন খবর প্রকাশিত হয়, চেকআপ ছাড়া ডেঙ্গুর রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এগুলোকে তখন আমরা গুজব বলে উড়িয়ে দিতে চাই, কিন্তু পারি না। সবাই চায় এগুলোই গুজব হোক, কিন্তু হয় না। এসব খবর পড়তে গিয়ে যে কোনো পাঠকই বলতে বাধ্য হবে যে, মানুষ আর মানবতার সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছে এসব বাণিজ্যলোভী নিষ্ঠুররা। মানুষ যেখানে মৃত্যুর কালো থাবা থেকে বাঁচার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, ঠিক সে সময় এ রকম সংবাদ শুধুই আমাদের হতাশ করে।
মহামারির ছোবলে মানুষের মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে কেউ না কেউ, অথচ মৃত্যু আর মহামারি নিয়ে সরকার কিংবা রাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে চলছে অমানবিকতা। মানুষের মৃত্যুভয়কে পুঁজি করে নামি-দামি হাসপাতালগুলোতে চলছে ডেঙ্গু-ব্যবসা। বাণিজ্য মানুষকে অমানবিক করে তুলছে। রাজনৈতিক দাসদের কারণে সত্য বলার সাহসটুকু যেন হারিয়ে যাচ্ছে। নৃশংস হচ্ছে মানুষ প্রতিনিয়ত। কি এক ধরনের শঙ্কা যেন কথা বলায়। এই শঙ্কা থেকেই কেউ উদ্যোগী হচ্ছে না। যারা রাষ্ট্রের বিবেক, তারাও কেন জানি দেখেও দেখছে না। আস্থাহীনতা কিংবা বিশ্বাসহীনতার মাঝ দিয়ে একটা সমাজ এগোতে পারে না। সন্দেহ দানা বাঁধছে। বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষকেই উদ্যোগী হতে হবে। এই কণ্টকাকীর্ণ সময়েই তো কথা বলা প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।