কানাইডিঙা/হনা/শোণা
ইংরেজি নাম: Broken bones plant, Indian calosanthes, Indian Trumpet, tree of Damocles। বৈজ্ঞানিক নাম: Oroxylum indicum । পরিবার: Bignoniaceae
কানাইডিঙা । সিলেটে তাকে বলে ‘হনা’! এটি ‘শোণা’ নামেও পরিচিত। ভারতের আসামে বলে ‘ভাতঘীলা’। তরুরাজ্যে সে আশরাফ নয়, আতরাফ; অর্থাৎ, অনাদরের গাছ। আমিও প্রতিবছর অনেক চারা উপড়ে ফেলি, অকারণে আমার সীমিত ভূমি দখলের অপরাধে! কিন্তু সে প্রায় অপ্রতিরোধ্য। দিকে দিকে বংশ ছড়ায় খুব সহজে। বসতবাড়ি থেকে এ বৃক্ষ উচ্ছেদ হতে হতে এখন অধিকাংশ গোরস্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
ইদানীংআমি যত হনার গাছ দেখেছি তার অধিকাংশই বিভিন্ন গোরস্থানে অবস্থিত। আমরা তাকে ভালোবাসি না কিন্তু সে আমাদের মৃত স্বজনদের পাহারা দেয় নিভৃতে।
বীজ থেকে সহজেই চারা হয়। মাটিতে ডাল পুঁতে রাখলেও সহজেই চারা হয়ে যায়। কানাইডিঙা মাঝারি ধরণের বৃক্ষ; সীমিত আয়তনের, ৩০-৩৫ ফুটের মতো উঁচু। তার ফল লম্বা ও চ্যাপ্টা, অনেকটা নৌকার আকৃতির। সেজন্যেই বুঝি এমন নাম! ফল পাকলে ফেটে গিয়ে ভেতরে হালকা পাতলা গোল গোল কাগজের টুকরোর মতো বীজ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। কাঁচা ফল মাংসল ও নরম এবং তা আগুনে ঝলসে, ত্বক ফেলে বেটে কেউ কেউ ভর্তা খায় বলে শুনেছিদরিদ্রলোকেরা। গ্রীষ্মে ফুল আসে, বর্ষায় ফল হয় এবং পরিপক্ক হয় শীতে।
এ গাছের পাতার নির্যাস ও ত্বক অগ্নিমান্দ্য, রক্ত-আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং আমবাতে উপকারী বলে প্রচলিত ধারণা। এ বিষয়ে আমার কাছে বাস্তবভিত্তিক তথ্য নেই।
পালান বা পালাম
পালান বা পালামের Common English name: Scarlet Wrightia. বৈজ্ঞানিক নাম: Wrightia coccinea ; পরিবার: Apocynaceae।
পালানের সিঁদুররাঙা ফুল নিয়ে আমাদের সুমধুর শৈশবস্মৃতি রয়েছে। সেসব এখানে আলোচ্য নয়। বাঙলাদেশে এ বৃক্ষটির আবাস শুধুই সিলেটে সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের শ্রদ্ধেয় নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা তাকে রাজধানী পর্যন্ত নিয়ে যান। এখন সেখান থেকে কিছু কিছু উৎসাহী বৃক্ষপ্রেমিকের কল্যাণে হয়ত ছড়িয়ে যাবে/যাচ্ছে সারাদেশে।
পালান পত্রমোচী ক্ষীরী বৃক্ষ। অর্থাৎ তার কাণ্ড বা পাতা ছিঁড়লে দুধের মতো সাদা কষ বের হয়। একসময় সিলেটের গ্রামাঞ্চলে মানুষ এই আঠা চিকন বাঁশের শলাকায় মাখিয়ে, মাটিতে বা বৃক্ষশাখে রেখে ছোট ছোট পাখি শিকার করত।
পালান মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ। ৪০ ফুটের মতো উঁচু হয়। এর কাঠ সাদা, নরম আর খুব হালকা কিন্তু পরিপক্ব গাছের কাঠ দীর্ঘস্থায়ী। খুব পলিশ হয়। আগে মানুষ পালানের কাঠ দিয়েও ফার্নিচার তৈরি করত। পালান-কাঠে নির্মিত ৪০ বছরের পুরনো পালঙ্ক, আলনা, আলমারি ইত্যাদি আমি দেখেছি; অক্ষতই আছে। এখনো সে দামি কাঠ তবে আগের মতো কদর করে না লোকে। কারণ সে পরিপক্ব হতে বেশ সময় নেয়। আমাদের সময় নেই, জমি নেই, চাহিদা বেশি; তাই দ্রুত বর্ধনশীল অ্যাকেশিয়ার দিকেই মনযোগ বেশি!
পালানের কাঠ খোদাই করা সহজ। আগেকার দিনে এর কাঠ দিয়ে ভাত ও তরকারির চামচ তৈরি হতো। কাঠের খেলনা তৈরিতেও এর ব্যবহার ব্যাপক ছিল; এখন আর সেসব দেখা যায় না!
পালান কেউ যত্নকরে লাগায় না আর। বসন্তে যখন পালানের পক্ব ফল থেকে ধানের মতো ছোট ছোট বীজ সাথে সংযুক্ত তুলার সাহায্যে (অবিকল আকন্দের তুলার মতো) লাখে লাখে বাতাসবাহিত হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে, আর বৃষ্টির ছিটা পেলেই গজায় অজস্র চারা, যত্রতত্র পালানের বন লেগে যায়; তখন মনেই হয় না সে সহজে বিলুপ্ত হবে! বসন্তের শেষে পত্রশূন্য রিক্ত গাছ বৃষ্টির ছোঁয়া পেলেই অতিদ্রুত ঘন পাতায় ভরে যায় আর দেখা দেয় সেই মনোরম ফুল!
হিংরা বা কাঁটাবাদাম
হিংরা বা কাঁটাবাদাম বা চেস্টনাট (Chestnut) খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তার বাপের বাড়ি আমেরিকায় (নাকি ইউরোপে?)! গোটা বিশ্বে অস্বাভাবিক দামি এই বাদাম কীভাবে যে সিলেটের সামান্য কিছু এলাকায় এসে বংশবিস্তার করেছে, জানা নেই। তাকে ঘিরে আমাদের বাড়িতে ছিল বাৎসরিক উৎসব। উৎসবে অতিথি হিশেবে হাজার হাজার টিয়া আসত এই গাছের বাদাম খেতে, তাদের সাথে কাড়াকাড়ি ছিল গ্রামের ছেলেদের! টিয়ার ঝাঁক ১/২ দিনেই সাবাড় করে ফেলত গাছের সুস্বাদু বাদাম সব।
অনেকগুলো বড় বড় গাছ ছিল আমাদের, কাঠের প্রয়োজনে আব্বা কেটে ফেলেছেন বেশিরভাগ। এখনো আছে কয়েকটি গাছ, বাদাম ধরে নিয়মিত, আমরাও খাই। কিন্তু অতিথিরা আসেন না আর, সম্ভবত এত অল্পে তাদের আসা-যাওয়ার কষ্ট পোষায় না!
আমরা বলি ‘হিংরা’, অনেকে বলে ‘কাঁটাবাদাম’। ইংরেজি নাম: Chestnut। বৈজ্ঞানিক নাম: Castanea dentata। পরিবার: Fagaceae। গাছ ৪০-৫০ ফুটের মতো উঁচু হয়। আমেরিকায় নাকি ৯৮ ফুট উঁচু হওয়ার রেকর্ড আছে!
অনায়াসে আমাদের টিলাভূমিতে হচ্ছে। গাছ বেশ দ্রুতই বাড়ে এবং বাদাম ধরে প্রচুর। টিয়া ছাড়াও কাঠবিড়ালির মুখ থেকে বাদাম রক্ষা করা এক শক্ত কাজ। কাঁটার বলের ভেতর থেকে কীভাবে তারা খুব সহজে বাদাম/বীজটি খেয়ে নেয়, সে এক বিস্ময়!
একটা চারাও আমরা যত্নকরে লাগাই নি, এমনিতেই বংশ বিস্তৃত হচ্ছে। হেমন্তের মাঝামাঝি গাছভরে আসে ফুল। ফল পাকতে পাকতে পরবর্তী শরৎ দুয়ারে এসে হানা দেয়। গাছের কাঠ প্রচণ্ড শক্ত, মজবুত আর টেকসই বলে এ বৃক্ষ এখন সিলেটে বিলুপ্তপ্রায়! তবে এ গাছের কাঠ দিয়ে ফার্নিচার হয় না, কাঠ পলিশ করা যায় না বলে। আমাদের এ ঐশ্বর্যকে এখন বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো দরকার।
খালেদ রাজ্জাক: কবি, শিক্ষক ও নিসর্গপ্রেমিক