ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারতে স্বাধীনতার পর ১৭তম লোকসভা নির্বাচন হয়েছে সম্প্রতি। ভারতের রাজনীতির ইতিহাস বলে প্রতিটি নির্বাচনেই বিভিন্ন দল ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে ভোটে সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ভারতের গণমাধ্যমগুলোই বলছে, এবার ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ যেভাবে ভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে, অতীতে তেমনটা কোনোদিন হয়নি। মোদি-শাহের নেতৃত্বে এবং আরএসএসের সাংগঠনিক শক্তিতে বিজেপি এ কাজটা সফলভাবে করতে সক্ষম হয়েছে। তাই এই ভোটে বিজেপির প্রধান কৃতিত্ব ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র ও তীক্ষ্ণভাবে করা হয়েছে। এর সঙ্গে তারা ব্যবহার করেছে উগ্র-জাতীয়তাবাদ মিশ্রিত দেশপ্রেমকে। ভারতের একটা পত্রিকা গণশক্তি লিখেছে ‘জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমে অগৌরবের কিছু নেই। নাগরিক মাত্র দেশপ্রেমে ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিজেপির জাতীয়তাবাদের চরিত্র ভিন্ন। এই জাতীয়তাবাদ ধর্মকেন্দ্রিক হিন্দুত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিজেপির কাছে রাষ্ট্র মানে বহুত্ববাদী রাষ্ট্র নয়, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র।’ হিন্দুত্ববাদ তত্ত্বটা কাজ করেছে এ নির্বাচনে বড় ব্যাপকভাবে। এই ব্রিটেনেও লক্ষ করেছি, বর্ণবিদ্বেষ সাধারণ মানুষের মাঝে খুব একটা থাকে না। কিন্তু যখন রাজনৈতিকভাবে এটা কেউ না কেউ ইস্যু হিসেবে নিয়ে আসে, তখন তা মানুষের মাঝে ছোঁয়াছে রোগের মতো কাজ করে।
ব্রিটেনে ইডিএল কিংবা উগ্র যে কোনো দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সমর্থন করে না, কারণ রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িকতা কিংবা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ব্রিটেনের যে ‘সেভেন সেভেন’ কিংবা মুসলমানদের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছিল, সে সময়টাতেও রাষ্ট্র দাঁড়িয়েছে উগ্র জঙ্গিদের বিরুদ্ধে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়, যেটা হয়েছে নিউজিল্যান্ডেও। বর্ণ-ধর্মকে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে টেনে আনে না। তাই উগ্রতা একটা শ্রেণির মাঝেই থাকে। যে শ্রেণি সংখ্যায় অত্যন্ত নগণ্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এদেরও হয়তো অধিকার আছে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ধ্যান ধারণাকে মানুষের মাঝে প্রচার করার, কিন্তু এটা যখন বিদ্বেষ ছড়ায় তখন তা আর মানবিক থাকে না। আইনের চোখে অপরাধ হয়ে যাওয়ারই কথা তখন। এমনকি বাংলাদেশকে অনেক সময়ই সাম্প্রদায়িকতার তকমা দেয়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু পাকিস্তান কিংবা ভারতের দিকে তাকালে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেই ধরে নেয়া যাবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির অস্তিত্ব নেই, এ কথাটা পুরোপুরি হয়তো আমরা বলতে পারব না, তবে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছে না।
কিন্তু রাষ্ট্র যদি বর্ণবাদ কিংবা ধর্মীয় উগ্রতাকে প্রশ্রয় দেয়, তখন এটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট হতে থাকে। সে কারণেই ভারতে কংগ্রেস থেকে শুরু করে বামপন্থি দলগুলো এই ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেই কথা বলেছে। কিন্তু পেরে ওঠেনি। ভারতীয় পত্রিকগুলোই বলছে বিগত সরকারের সময় পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা আছে, কিন্তু এই ব্যর্থতাগুলো নির্বাচনে প্রাসঙ্গিক হয়নি। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদই ভোটের রাজনীতিতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বিরোধী দলগুলোর প্রচার-প্রচারণায় ভারতের জনগণ খুব একটা পাত্তাই দেয়নি। এমনকি যে কলকাতাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে দেখা হতো, সেখানেও আশাব্যঞ্জক ফলাফল নিয়ে এসেছে বিজেপি।
সে কারণেই হয়তো নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বিজেপির এই নিরঙ্কুশ বিজয়টাকে নৈতিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। মোদির শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান দেখার চেয়ে টিভিতে কার্টুন দেখা উত্তম মনে করেছেন। মানবিক বোধে হয়তো অমর্ত্য সেন এ কথাগুলো বলেছেন, কিন্তু সত্যি কথা হলো, হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাছে তার হৃদয়ে ধারণ করা মানবিক ধর্মটিও তার কাছে পরাজিত হয়েছে। কারণ ধর্মতো মানবতার কথাই বলে। কিন্তু কথা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতের এই রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণইবা কি। সারা ভারতে কংগ্রেসের যে ভূমিধস হয়েছে, তাতে আবারো প্রমাণ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষ বিশ্বাস আনতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর শাসন করার পর বামপন্থিরা পরাজিত হয়েছিল এবং মমতা ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত বামরা আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সত্যি কথা হলো, যতটুকুই না তারা তাদের শেষ সময়ে এসে ভয়হীন হয়েছিলেন কিংবা জবাবদিহিতাকে গুরুত্বহীন করেছিলেন কিংবা নেতাদের পরিবার পরিজনরা যেভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতি ছড়িয়েছিলেন, তা থেকেই মানুষ হয়তো উত্তরণ চেয়েছিল। যা চেয়েছিল মানুষ হয়তো সারা ভারতেই কংগ্রেসের শাসন থেকে অতীতে। পশ্চিমবঙ্গে বামদের তিন দশকেরও অধিককালের শাসন শেষে তৃণমূলের ওপর আস্থা রাখা মানুষ এবারো যেমন বামদের ওপর কোনোই আস্থা রাখতে পারেনি, সেভাবেই পুরোপুরি নির্ভর করতে পারেনি এমনকি মমতা ব্যানার্জীকেও। সারাদেশে কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের ক্ষমতায় থাকায় যে এককেন্দ্রিকতা গড়ে উঠেছিল, তা থেকে মুক্ত হতেই মানুষ বেছে নিয়েছিল বিজেপি কিংবা মোদিকে পাঁচ বছর আগে। বিগত বছরগুলোতে মোদি কিংবা বিজেপি ভারতীয়দের তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি এ কথাটা বারবার উচ্চারিত হয়েছে নির্বাচনের সময়, কিন্তু বিস্ময়করভাবে সত্য হলো, ভারতের মানুষ বিরোধী পক্ষের এ আকাক্সক্ষার স্লোগানকে উপেক্ষা করেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে লুফে নিয়েছে। নির্বাচনে তারা যেন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকেই মনে রেখেছে।
সত্যি কথাটা হলো এই ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি ভোটারদের মাঝে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে, গৌণ হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার মৌলিক বিষয়গুলো। মোদি সরকারের পাঁচ বছরে বহু উচ্চারিত ব্যর্থতাগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এ হিসাবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে আমরা কিছুটা হলেও ভিন্নভাবে বিচার করতে পারি। বাংলাদেশ মূলত একটা মুসলিমপ্রধান দেশ, কিন্তু কেন জানি মুসলিম মৌলবাদ এখানে পোক্ত হতে পারেনি। রাষ্ট্র যেমন এই অতি ধার্মিকদের কৌশলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে সরাতে পেরেছে, ঠিক তেমনি জনগণের একটা ব্যাপক অংশও ধর্মীয় উগ্রতাকে ঘৃণা করেছে কিংবা করছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র ভিন্নধর্মী সংখ্যালঘু মানুষদের সুরক্ষা দিতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পূজা পার্বণ বড়দিন প্রভৃতিতে রাষ্ট্রীয় অনুদান অব্যাহত রেখে ধর্মীয় বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একটা ঈদের জামাতে যেমন পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়, ঠিক তেমনি পূজা-পার্বণে সমানভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই তাই কেউ চাইলেও ধর্মীয় উগ্রতা এ দেশে ছড়ানোর সুযোগ হয়ে উঠে না।
আমাদের দেশটা ঐতিহ্যগতভাবেই সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু তারপরও অতি উৎসাহী কতিপয় ধর্মীয় যাজকরা মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তোলে। এটা এই বাংলাদেশে মৌলবাদী মুসলিম নামধারী রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক মোড়লদের কেউ কেউ যেমন করছে, ঠিক পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউকেটা কেউও এ সুযোগ ছাড়ছে না। আমি বিশ্বাস করি, এটা টিকবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওই যাজকরা (যে ধর্মেরই হোক না কেন) আরো বেশি চিহ্নিত হবে, গণমানুষের কাছে।রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ
ফারুক যোশী : কলাম লেখক, প্রধান সম্পাদক; ৫২বাংলাটিভি ডটকম।