হতাশ কেন, হাসপাতালে বিষ কোথায় পেল জুলাইযোদ্ধারা?
- আপডেট সময় : ০১:০০:২৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫
- / 206

‘হতাশা ও ক্ষোভ’ থেকেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত চার তরুণ, যাঁরা আন্দোলনে চোখ হারিয়েছেন। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কক্ষের সামনে, জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কামাল আকবরের উপস্থিতিতে তাঁরা বিষপান করেন।
সোমবার (২৬ মে ২০২৫) দুপুরে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই চার তরুণের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তাঁরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভাবে তারা চরম হতাশাগ্রস্ত। বিষয়টি নিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের সিইওর সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলেও ব্যর্থ হন। হতাশা ও ক্ষোভ থেকেই বিষপানের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।
বর্তমানে চারজনই শঙ্কামুক্ত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকলেও শারীরিক দুর্বলতা রয়ে গেছে। চিকিৎসাধীন তরুণরা হলেন—আলী হামজা শিমুল, আখতার হোসেন ওরফে তাহের, মারুফ আহমেদ এবং মো. সাগর। তাঁরা রবিবার বিষপান করেন।
তাঁদের মধ্যে মো. সাগরের অবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তাঁর মা মোর্শেদা বেগম বলেন, “গতকাল বিষ খাওয়ার পর থেকে শুধু ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার বলেছেন এখন শঙ্কামুক্ত।”
হতাশা প্রসঙ্গে মোর্শেদা বেগম বলেন, “আমার একটাই ছেলে। গার্মেন্টসে আমি আর সে চাকরি করে সংসার চালাতাম। এখন আমরা দু’জনই বেকার। আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়, গলায় এখনও ছররা গুলি রয়ে গেছে। উন্নত চিকিৎসার কথা বললে বলা হয়, গ্রামে ফিরে যেতে। সেই ক্ষোভেই সে বিষ খেয়েছে।”
হাসপাতালের চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানা গেছে, বিষক্রিয়া দূর করতে রোগীদের দ্রুত স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বর্তমানে পর্যবেক্ষণে রয়েছেন, শিগগিরই তাঁদের ছাড়পত্র দেওয়া হতে পারে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাকি মোহাম্মদ জাকিউল আলম বলেন, “বিষপান করা চারজনই এখন স্থিতিশীল। আশা করছি দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন।”
হাসপাতালটির পরিচালক ডা. শফিকুর রহমান জানান, “চিকিৎসাধীন সবাই এখন ভালো আছেন, শঙ্কামুক্ত অবস্থায় চিকিৎসা চলছে। আমরা তাঁদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছি।”
বিষ এল কোথা থেকে?
আলী হামজা শিমুল বলেন, “আমরা সাতজন মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অবহেলার শিকার হচ্ছি, অন্তত বাকিরা যেন না হয়।” কোথা থেকে বিষ পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, “শনিবার পাশের কাঁচা বাজার থেকে কিনেছি।”
এক জুলাই যোদ্ধা, যিনি বর্তমানে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকতে চান, বলেন, “আমরাও আত্মাহুতি দিতে চেয়েছিলাম। আমরা সাতজন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিষ খাব। কাঁচাবাজার থেকে ‘নাইট্রো’ নামের একটি পোকামাকড় মারার রাসায়নিক কিনেছিলাম। পরে কয়েকজনের বাধায় তিনজন খেতে পারেননি, বাকি চারজন খেয়ে ফেলেন।”
চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিয়ে ক্ষোভ
আলী হামজা শিমুল বলেন, “দশ মাস ধরে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে দুর্ভোগ পোহাচ্ছি। পরিচালক খায়ের চৌধুরী উন্নত চিকিৎসা তো দিচ্ছেন না, উল্টো চোখের ক্ষতি বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বিদেশে রেফার করতে অনুরোধ করলে শুরুতে সম্মতি দিলেও পরে বলেন, ‘তোমার যা খুশি করো।’ এই অবহেলাই আমাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এটা করতে চাইনি, বাধ্য হয়ে করেছি। দশ মাস ধরে কেবল আশ্বাস পেয়েছি, চিকিৎসা নয়। পরিচালক নানা অজুহাতে আমাদের এড়িয়ে গেছেন।”
আলী হামজা আরও জানান, “গতকাল যখন মিটিং চলছিল, আমরা গিয়ে চিকিৎসার দাবি জানাই। পরিচালক কিছু না বলে বলেন, ‘তোমাদের যা ভালো লাগে করো।’ তখনই বাইরে গিয়ে আমরা বিষপান করি।”
উল্লেখযোগ্য যে, চারজনের মধ্যে একজন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। আত্মহত্যার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মার্চে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, এখনও কিছু হয়নি। সিঙ্গাপুরে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, দেশে তো চিকিৎসা প্রায় না থাকার মতো।”
ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধির অভিযোগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিনিধি নাবিলা নাদিয়া বলেন, “অনেকের একটি চোখ অপসারণ করতে হয়েছে, কারও ক্ষেত্রে দুটি চোখও ঝুঁকিতে। উন্নত চিকিৎসায় বাইরে প্রযুক্তিগত সমাধান রয়েছে, কিন্তু এখানে শুধু পাথরের চোখ বসিয়ে চিকিৎসা শেষ বলে মনে করা হয়। উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।”
তিনি আরও বলেন, “আহতরা বলছেন, আমরা দেশের জন্য দিয়েছি, এখন দেশ আমাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে। যাদের বসিয়েছি, তারাই দেখবে।”
কি ঘটেছিল সেদিন?
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জুলাই ফাউন্ডেশনের সিইও’র সঙ্গে চলমান বৈঠকের সময় চার তরুণ তাঁর কক্ষে যান দাবি জানাতে। সিইও তাঁদের অপেক্ষা করতে বলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানেই বিষপান করেন তাঁরা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক জানান, “তাঁরা নাকি আগেই বিষ এনে রেখেছিলেন। সিইও আগের দিন তাঁদের কথা দিয়েছিলেন যে তিনি এসে দেখা করবেন। তিনি কথা রেখেও কথা বলেন।”
চিকিৎসক আরও জানান, “সিইও পরিচালকের রুমে অন্যান্য চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন। বিদেশ পাঠানো, পুনর্বাসন ও ক্যাটাগরি সংশোধন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। একপর্যায়ে কয়েকজন দেখা করতে চান। সিইও পরে বসবেন বলে জানালে, কিছুক্ষণ পর বাইরে হৈচৈ শুরু হয়—জানা যায় কয়েকজন বিষ খেয়ে ফেলেছেন।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও জুলাই ফাউন্ডেশনের বক্তব্য
ওই চিকিৎসক বলেন, “চক্ষু হাসপাতালে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৭৪ জন আহতের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অনেককে বিদেশেও পাঠানো হয়েছে। বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনেও চিকিৎসা হয়েছে। তবে এমন কিছু রোগী আছেন, যাঁদের দৃষ্টিশক্তি আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এখনো প্রায় ৫০ জন চিকিৎসাধীন, যাঁরা এক বা দুই চোখ হারিয়েছেন। তাঁদের প্রধান দাবি—বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন।”
হাসপাতাল পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, “আমরা সাধারণ রোগীদের বেড ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে তাঁদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিয়েছি। কিন্তু এ ধরনের আচরণ আমাদের ব্যথিত করেছে। চাইলে তাঁরা বাসায় গিয়েও চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন। তবুও আমরা আন্তরিকভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।”
বিষপান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হতাশা থেকে তাঁরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। বাংলাদেশে যা সম্ভব, তা করা হয়েছে। এর বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের এখানে ছয় সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি আছে। তারাই ঠিক করেন কে বিদেশে যাবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই।”
এক বিজ্ঞপ্তিতে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন জানায়, হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে আহত চারজনের বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টাকে ‘কঠিন মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফাউন্ডেশন বলেছে, “জুলাই যোদ্ধারা আমাদের গর্ব। তাঁদের মনোবল যাতে ভেঙে না পড়ে, সে লক্ষ্যে ফাউন্ডেশন নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।”


















