মিয়ানমারকে ‘মানবিক করিডোর’: বিতর্কের কারণ ও বাস্তবতা কী?
- আপডেট সময় : ১১:১৬:১০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৪ মে ২০২৫
- / 258
দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে বাংলাদেশ সরকার ‘নীতিগতভাবে’ মানবিক করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এই প্রক্রিয়া ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিরোধিতাও তীব্র হয়েছে।
করিডোরটি কেমনভাবে এবং কোথায় বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও নির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে এই উদ্যোগ গ্রহণে বাংলাদেশের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য বিরোধিতার মধ্যেও সরকারের বক্তব্য, জাতিসংঘ যদি এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়, তাহলে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
বিষয়টি ঘিরে বিশ্লেষকদের মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ একে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান মনে করেন, এমন উদ্যোগে অংশগ্রহণ করতে হলে সর্বপ্রথম মিয়ানমার সরকারের সম্মতি প্রয়োজন। তাঁর মতে, “মিয়ানমার সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়াই যদি বাংলাদেশের মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ এবং মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে।”
তিনি আরও বলেন, রাখাইনের পরিস্থিতি এখন জটিল। সেখানে একটি পক্ষ মিয়ানমার জান্তা সরকার, অপরটি সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সম্পৃক্ততা থাকায় এটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় হিসেবেও বিবেচ্য।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের মতে, করিডোর ব্যবস্থার আগে প্রক্রিয়াটি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। “জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিতে হলে আগে মিয়ানমার সরকারের সম্মতি আদায় করতে হবে,” বলেন তিনি।
তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, “আমরা কি নিশ্চিত যে, জাতিসংঘ বা বাংলাদেশ আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছে? যদি না করে থাকে, তাহলে উদ্যোগটি এখনও পরিপূর্ণ নয়।”
করিডোর নিয়ে আলোচনার সূচনা
২০২১ সাল থেকে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয় আরাকান আর্মি। শুধু কায়ুকফায়ু সমুদ্রবন্দরটি রয়েছে জান্তা সরকারের হাতে।
এরই মধ্যে ইউএনডিপি এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে, রাখাইনে ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিলে খাদ্য ঘাটতির কারণে ২০ লাখের বেশি মানুষ অনাহারে পড়তে পারে। বীজ, সার, খারাপ আবহাওয়া ও বাস্তুচ্যুতি খাদ্য উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো মানবিক করিডোর বিষয়ে ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক প্রতিনিধি খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, “মানবিক সহায়তা কেবল জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হতে পারে, এবং এতে বাংলাদেশ যুক্ত থাকবে যদি তা যৌক্তিক কাঠামোর মাধ্যমে হয়।”
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন পরে জানান, “নীতিগতভাবে আমরা সম্মত, তবে কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো পূরণ হলে আমরা সহযোগিতা করব, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে।”
এই বক্তব্যের পরপরই বিষয়টি ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের ঝড় ওঠে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, এমন সিদ্ধান্ত দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই আসা উচিত।”
জাতিসংঘ ও সরকারের অবস্থান
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম একাধিকবার জানিয়েছেন, জাতিসংঘ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেনি। তবে তিনি বলেন, “যদি জাতিসংঘ এ ধরনের উদ্যোগ নেয়, বাংলাদেশ যৌক্তিক কাঠামোয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকবে।”
জাতিসংঘের ঢাকা অফিসও বলেছে, রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় সরকারের অনুমতি প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের শর্তসমূহ
বাংলাদেশ সরকার বলেছে, ত্রাণ বিতরণ হবে নিরপেক্ষ, শর্তহীন এবং বৈষম্যহীনভাবে। এজন্য রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ এবং যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন, যাতে ত্রাণ পরিবহন ব্যাহত না হয়।
ত্রাণ যেন আরাকানি, রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে বৈষম্যহীনভাবে বিতরণ হয়—এটিও সরকারের অন্যতম শর্ত। সরকার স্পষ্ট করে বলেছে, ত্রাণের সঙ্গে কোনো শর্ত আরোপ করা যাবে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, যদি দুর্ভিক্ষ হয়, তবে রাখাইন থেকে আবারও শরণার্থী ঢল শুরু হতে পারে, যেটি বাংলাদেশকে নতুন করে সংকটে ফেলবে।
২০১৭ সালের মতো পরিস্থিতি ফের দেখা দিতে পারে, যখন ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল।
মানবিক করিডোর কী?
আন্তর্জাতিক আইনে মানবিক করিডোরের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকলেও এটির মূল উদ্দেশ্য হলো—যুদ্ধক্ষেত্রে আটকে পড়া মানুষদের জন্য নিরাপদ পথ তৈরি করা, যাতে তারা সহায়তা পেতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দি রেডক্রসের মতে, এটি একটি সময়সীমা নির্ধারিত চুক্তিভিত্তিক পথ, যেখানে বেসামরিক মানুষের চলাচল বা সাহায্য পৌঁছানো নিশ্চিত করা হয়।
বিশ্বের আলোচিত করিডোরগুলোর মধ্যে লাচিন করিডোর (আর্মেনিয়া-নাগর্নো-কারাবাখ) অন্যতম, যার নিরাপত্তা রুশ শান্তিরক্ষীরা দিয়েছিল। কিন্তু পরে তা নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়।
জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালে বসনিয়ায় ছয়টি ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষণা করলেও পর্যাপ্ত সুরক্ষা না থাকায় সেসব জায়গায় গণহত্যাও ঘটে, যেমন স্রেব্রেনিকা। ফলে মানবিক করিডোর ব্যবস্থাকে জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বলেই মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
ঝুঁকি কতটা?
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুনীরুজ্জামান বলেন, “মিয়ানমারের অনুমতি ছাড়া করিডোর স্থাপন আইনসম্মত নয় এবং তা করলে বাংলাদেশ একটি বেআইনি কাজের অংশীদার হবে।”
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, করিডোর পরিচালনায় যদি বাংলাদেশ সেনা মোতায়েন করে, তবে সেটি শুধু সেনাদের জন্যই নয়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে।
তার ভাষায়, “যদি পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমরা একটি প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারি, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।”
তিনি আরও বলেন, “ভবিষ্যতে কেউ এই নিদর্শন দেখিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে করিডোর স্থাপনের দাবি তুলতে পারে, যা দেশের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।”



















