লেবার পার্টি গত গ্রীষ্মে ক্ষমতায় আসার পরপরই ব্রিটিশ উদ্যোক্তা চার্লি মালিনস দেশ ছেড়ে চলে যান। প্লাম্বিং ব্যবসায় সাফল্য পেয়ে তিনি বিপুল সম্পদ অর্জন করেছিলেন।
চার্লি মালিনস এখন তার সময় স্পেন ও দুবাইয়ে ভাগ করে কাটাচ্ছেন। তার মতে, “ব্রিটেন এখন ব্যবসা করার জন্য আর ভালো জায়গা নয়।”
৭২ বছর বয়সী মালিনস দেখতে অনেকটা গায়ক রড স্টুয়ার্টের মতো। তিনি ধনী ও পরিচিত কয়েকজন ব্রিটিশের মধ্যে একজন, যারা ব্রিটেন ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন অথবা ইতোমধ্যে চলে গেছেন।
ধনীদের এই দেশত্যাগের পেছনে সাম্প্রতিক কর সংস্কারই মূল কারণ বলে জানিয়েছেন ধনীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারীরা।
দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন বিশ্বের ধনীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত। এখানে রুশ অলিগার্ক থেকে নির্বাসিত নেতা, হেজ ফান্ড পরিচালনাকারী থেকে ব্রিটিশ ধনীরা পাশাপাশি থাকেন। এই শহরে পুরোনো অর্থ ও নতুন অর্থের মেলবন্ধন ঘটে।
লন্ডনের আইনি ও পেশাগত সেবা, সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, উচ্চমানের রিয়েল এস্টেট এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসার ভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রাধান্যের কারণে লন্ডন বিশ্বের ধনীদের কাছে প্রিয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, অনেক ধনী ব্যক্তি স্পেন, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে চলে যাচ্ছেন।
এসব দেশে করের হার কম অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ করের বিনিময়ে ধনীরা তাদের বৈশ্বিক আয়ের ওপর করমুক্ত থাকতে পারেন। কেউ কেউ এই ধনীদের দেশত্যাগে শঙ্কিত হলেও, অনেকেই এটিকে স্বস্তির বিষয় হিসেবেই দেখছেন।
ব্রিটেন ছাড়ার একটি বড় উদাহরণ হলেন মিশরীয় ধনকুবের ও অ্যাস্টন ভিলা ফুটবল ক্লাবের অংশীদার নাসেফ সাওয়ারিস। তিনি ফিনান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, “আমার পরিচিত কারও কথা জানি না, যিনি এই এপ্রিল অথবা আগামী এপ্রিল (যদি তাদের সন্তানের স্কুলের বিষয় থাকে) ব্রিটেন ছেড়ে যাচ্ছেন না।”
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আবাসিক ও হলিডে পার্ক পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আলফি বেস্ট। তিনি ব্রিটেনের কর ও নিয়ন্ত্রক জটিলতাকে ‘অত্যাচার’ আখ্যা দিয়ে মোনাকোতে চলে গেছেন।
সানডে টাইমস রিচ লিস্টের সম্পাদক রবার্ট ওয়াটস বলেন, লন্ডনের ‘বিলিয়নেয়ারের যুগ শেষ’। রবার্টের তালিকায় যুক্তরাজ্যের শীর্ষ ৩৫০ জন ধনীর সম্পদের তথ্য থাকে। তিনি গত এক দশক ধরে ধনীদের ওপর পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছেন।
তিনি বলেন, “ধনীরা ক্ষুব্ধ নন, তবে ক্লান্ত। তারা মনে করছেন এখানে নতুন ব্যবসা শুরু করা, সেটিকে বড় করা কিংবা সম্প্রসারণ করা সহজ নয়।”
ব্রিটিশ সরকার তাদের রাজস্ব বাড়াতে সম্প্রতি শতাব্দীপ্রাচীন এক করনীতি বাতিল করেছে। এই নীতির আওতায় ‘নন-ডম’ নামে পরিচিত বিদেশি বাসিন্দারা তাদের বিদেশি আয় ব্রিটেনে করমুক্ত রাখতে পারতেন।
তবে এই পরিবর্তনের ঘোষণা প্রথমে কনজারভেটিভ সরকার দেয়। লেবার সরকার ক্ষমতায় এসে এপ্রিলে তা কার্যকর করে এই কর সুবিধা বন্ধ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বৈশ্বিক সম্পদের ওপর উত্তরাধিকার কর ছাড়ও বাতিল করেছে। ব্রিটেনে উত্তরাধিকার করের সর্বোচ্চ হার ৪০ শতাংশ, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম উচ্চ হার। তবে নানা ছাড়ের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কার্যত করের হার কমে যায়।
এই কর সংস্কার থেকে আগামী পাঁচ বছরে সরকারের ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন পাউন্ড রাজস্ব আয়ের আশা করা হচ্ছে। সরকার বলছে, এই অর্থ দিয়ে আর্থিক সংকটে থাকা স্কুল, হাসপাতাল ও ডেন্টাল ক্লিনিকের ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই পরিবর্তন ‘নিজের গোলে বল’ করার মতো ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর ফিস্কাল স্টাডিজের তথ্যানুসারে, যুক্তরাজ্যের শীর্ষ ১ শতাংশ আয়করদাতা দেশের মোট কর আয়ের ২৯ শতাংশ দিয়ে থাকেন। যদি তাদের বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সরকারের আয় কমে যেতে পারে।
সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের হিসাব, মাত্র এক-চতুর্থাংশ ‘নন-ডম’ দেশ ছাড়লে সরকারের এই সংস্কার থেকে আয় শূন্য হয়ে যাবে। আর যদি অর্ধেক চলে যায়, তাহলে সরকারের ক্ষতি হবে ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড।
চার্লি মালিনস বলেন, তিনি ব্রিটিশ ট্যাক্স দপ্তরের জন্য যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। এখন দুবাইয়ে নতুন একটি প্লাম্বিং ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করছেন।
তিনি বলেন, “আমি ৫৫ বছরে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি পাউন্ড কর দিয়েছি। আমি কর দিতে আপত্তি করি না। তবে ক্যাপিটাল গেইন, উত্তরাধিকার করসহ নানা কর নিয়ে মনে হচ্ছে সরকার ভুল মানুষদের শাস্তি দিচ্ছে, উৎসাহ না দিয়ে।”
‘নন-ডম’দের মধ্যে কতজন ইতোমধ্যে দেশ ছেড়েছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। যুক্তরাজ্যের রাজস্ব দপ্তর এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য আগামী বছর প্রকাশ করবে। তবে নানা ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে।
বৈশ্বিক রিয়েল এস্টেট কনসালট্যান্ট নাইট ফ্র্যাঙ্কের ‘সুপার প্রাইম’ সম্পত্তি বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টুয়ার্ট বেইলি জানান, কর পরিবর্তনের প্রস্তাবের পর ধনী বিক্রেতার সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, “বাজার এখন ক্রেতাদের অনুকূলে। বিশেষ করে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি পাউন্ডের বাড়ি নিয়ে।”
তিনি যোগ করেন, “নাইটসব্রিজ বা বেলগ্রেভিয়ার মতো এলাকায় সাধারণ মানের বাড়ি কিনতে এখন অনেক বিকল্প রয়েছে।”
তবে নতুন ক্রেতারাও বাজারে আসছেন। বিশেষ করে ধনী আমেরিকানদের উপস্থিতি এখন বেশি। গত এক বছরে ৬ হাজার ৬১৮ জন আমেরিকান ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বা বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করেছেন, যা রেকর্ড। শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ১ হাজার ৯০০ জন আবেদন করেছেন—এটি কোনও একক ত্রৈমাসিকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
স্টুয়ার্ট বেইলি বলেন, ধনী আমেরিকানদের ব্রিটেনে আগমনের ধারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলের আগেই শুরু হয়েছিল, যখন মুদ্রার বিনিময় হার তাদের পক্ষে ছিল।
লন্ডনের আইনজীবী ক্লেয়ার মরিস, যিনি বিশ্বজুড়ে ক্লায়েন্টদের কর ও ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেন, তিনি বলেন, “কর পরিবর্তন, বিশেষ করে উত্তরাধিকার কর নিয়ে উদ্বেগের কারণে অনেক মানুষ দেশ ছেড়ে গেছেন।”
তিনি যোগ করেন, “যারা ব্রিটেনে আসতে চাইছিলেন, তাদের মধ্যে কতজন এখন আর আসবেন না—তা আমরা কখনোই জানতে পারব না।”
তবে সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। কেউ কেউ মনে করেন, এই ধনীদের বিদায়ে কোনও ক্ষতি নেই।
লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় ক্যাটলিন মোরান লিখেছেন: “সুপার ধনীরা বলছে তারা ব্রিটেন ছেড়ে যাচ্ছে। আমি দুঃখিত নই।” তিনি উল্লেখ করেন, লন্ডনের কিছু অংশে অদ্ভুত নির্জনতা বিরাজ করছে। তিনি লেখেন, “সব ধনী লোক খারাপ না হলেও, অনেক সময় তারা খারাপ প্রতিবেশী হয়ে ওঠে।”
ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের অর্থনীতিবিদ অরুণ আদভানি ২০১৭ সালের একটি উদাহরণ মনে করিয়ে দেন। সেবার নতুন কর নীতির কারণে ৫ শতাংশ ‘নন-ডম’ দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি ৯৫ শতাংশ থেকে গিয়ে আগের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি কর দিয়েছিলেন।
তবে এবার তিনি মনে করছেন, আরও বেশি মানুষ দেশ ছাড়বেন। কারণ এবার কর পরিবর্তনের মাত্রা আরও বড়। যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশ ছেড়েছেন, তারা নতুন উত্তরাধিকার কর থেকে রেহাই পেয়েছেন।
আদভানি বলেন, “যদি কারও দেশ ছাড়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলে এখনই সঠিক সময়।”
তবে তিনি মনে করিয়ে দেন, জীবনযাপনের বিবেচনাও বড় ভূমিকা রাখে। যাদের সন্তান প্রাইভেট স্কুলে পড়ছে, তারা সাধারণত দেশ ছাড়তে চান না। অন্যদিকে যারা ইতোমধ্যে স্পেনে অবসর জীবনযাপন করছেন, তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ।
আদভানি আশা করছেন, সব মিলিয়ে এই কর সংস্কার সরকারের রাজস্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের রাজনীতি বিশ্লেষক টনি ট্র্যাভার্স বলেন, এই তথাকথিত ‘ধনীদের দেশত্যাগ’ আসলে বৈশ্বিক এক প্রবণতা। তিনি বলেন, “কিছু অতি ধনী মানুষ চলে যাচ্ছেন, কিন্তু অনেকেই থেকে যাচ্ছেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন, ব্রিটেনের সুযোগ-সুবিধা অন্য দেশের কম করের চেয়ে বেশি মূল্যবান।”
তিনি যোগ করেন, “যদি তারা সত্যিই যেতে চাইতেন, তাহলে ম্যানহাটনের টাউনহাউস বা নাইটসব্রিজের বাড়ির মালিকরা বহু আগেই বাহামায় চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তারা থেকেছেন।”
অন্যদিকে, সানডে টাইমস রিচ লিস্টের তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটেনে ধনীদের নিট সম্পদ গত তিন বছর ধরে কমছে। ২০২৫ সালের তালিকায় ১৫৬ জন বিলিয়নেয়ার রয়েছেন, যেখানে ২০২৪ সালে ছিলেন ১৬৫ জন। এটি রিচ লিস্টের ৩৭ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পতন।
রিচ লিস্টের সম্পাদক রবার্ট ওয়াটস বলেন, এই পতনের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে—নীতির পরিবর্তন, সুদের হারের ওঠানামা এবং করবান্ধব দেশের প্রতি আকর্ষণ।
তিনি বলেন, “বিশেষ করে বয়স্ক ধনীরা উদ্বিগ্ন যে, মৃত্যুর পর তাদের বিদেশি কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে ব্রিটিশ উত্তরাধিকার করের আওতায় পড়ে যাবে। তাই অনেকে মনে করছেন, দেশ ছাড়া ছাড়া তাদের আর কোনও বিকল্প নেই।”
তিনি ভবিষ্যতের প্রভাব নিয়ে বলেন, “ধনকুবেরদের নিয়ে সবার আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু যাঁরা কর্মসংস্থান তৈরি করেন, তাদের দেশত্যাগের ক্ষেত্রে অবহেলা করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।”
তথ্যসূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট



















