ঢাকা ০৫:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

বিচারের মুখে এত সেনা কর্মকর্তা, আসল উদ্দেশ্য কি?

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০৮:৪০:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
  • / 136

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বাংলাদেশে গুম সংক্রান্ত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ১৫ জন কর্মরত কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এতজন সেনা কর্মকর্তাকে বেসামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করার ঘটনা বিরল। এরপর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে—সেনা কর্মকর্তাদের সিভিল আদালতে বিচার, সরকার–সেনা সম্পর্ক, এবং এর ফলে সেনাবাহিনীর ভেতরে সম্ভাব্য প্রভাব কেমন হতে পারে।

শনিবার ১৫ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে ঘিরে নানা গুজব, আলোচনা এবং পক্ষে–বিপক্ষে প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি কৌশলী অবস্থান নিয়েছে, অন্য অনেক দলই নীরবতা অবলম্বন করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে, সেনাবাহিনীতে একটি পক্ষের প্রভাব নিশ্চিত করার জন্য প্রতিপক্ষকে নির্মূলের জন্য এই বিচারের আয়োজন করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এ ঘটনার দিকনির্দেশনা স্পষ্ট হবে। এরপরই সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক অবস্থানও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, ঘটনাটি যেভাবে জনসমক্ষে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক পরিসরেও পড়তে পারে বলে তার আশঙ্কা।

তবে কেউ কেউ বলছেন, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হওয়ায় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিতে বড় ক্ষতি হবে না।
অন্যদিকে বেসামরিক আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “গুমের দুই মামলাসহ তিন মামলায় পরোয়ানাভুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তার বিচার করার ক্ষমতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।”

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা সেনা হেফাজতে থাকবেন নাকি সাধারণ আসামিদের মতোই বিবেচিত হবেন—এ প্রসঙ্গে তাজুল ইসলাম বলেন, “আইনের সাধারণ বিধান হচ্ছে, আসামিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়। এরপর আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কোথায় থাকবে।”

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ অতীতের নজির বিবেচনা করলে দেখা যায়, সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে কোনো বাধা নেই।

সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস–কে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, সশস্ত্র বাহিনীর অন্য কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরিকল্পনা নেই।

এই ঘটনার তাৎপর্য বা প্রভাব

ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর সেনা সদর জানিয়েছে, যাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল, সাতজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, একজন কর্নেল, চারজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও একজন মেজর রয়েছেন। তাদের একজন অবসরপ্রস্তুতিকালীন ছুটিতে আছেন।

শনিবার সেনা সদর ব্রিফিংয়ে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, দুটি মামলার ৩০ আসামির মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত, একজন এলপিআরে এবং ১৫ জন বর্তমান কর্মরত।

এর আগে, ৮ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং তাদের ২২ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়।
এরপর থেকেই ‘সেনা কর্মকর্তাদের বেসামরিক আদালতে বিচার’ ইস্যুতে পক্ষে–বিপক্ষে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সামরিক আইনেই অপরাধের বিচার করার সুযোগ আছে। তাই বিষয়টি যেভাবে জনসমক্ষে এসেছে, তা সেনাবাহিনীর মর্যাদার সঙ্গে যায় না।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, “সেনাবাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাহিনীর কেউ অপরাধ করলে সেটি সামরিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত। বিষয়টি জনসমক্ষে আনার আগে আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার ছিল।”

তার মতে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে সেনাবাহিনীর অবদান ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতেও এ ঘটনার প্রভাব পড়তে পারে।

অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আব্দুর রব খান মনে করেন, এ ঘটনায় বাহিনী নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, বরং বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করে সেনাবাহিনী প্রশংসা পাবে।
“এটা পুরো বিচার প্রক্রিয়ার অংশ, আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এতে পুরো জাতি জড়িত,” বলেন তিনি।

সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিকও বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে সেনা অফিসারদের হত্যার বিচার বেসামরিক আদালতেই হয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্টও তাতে সম্মতি দিয়েছে। তাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সিভিল আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের বিচারে বাধা নেই।

তবে আইনে সুযোগ থাকলেও একযোগে এতজন সেনা কর্মকর্তার বিচার বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, বিষয়টি যেভাবে প্রচারিত হয়েছে তা সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর ফলে বাহিনীর ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হয় এবং সেনা কর্তৃপক্ষ তা কীভাবে সামাল দেয়, সেদিকেও নজর থাকবে।

রাজনৈতিক দলগুলোও সেনাবাহিনীর মনোভাব বিবেচনায় কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। অনেকের ধারণা, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরই সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই মামলায় অগ্রসর হয়েছে।

বিএনপি এক বিবৃতিতে বলেছে, “সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য এই দেশের গর্বিত সন্তান। সীমা লঙ্ঘনকারীরা বিচারের মুখোমুখি হোক—এটাই অধিকাংশ সেনা সদস্যের প্রত্যাশা।”
বিবৃতিতে দলটি আসলে এই পর্যন্ত হওয়া অগ্রগতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

আরও পড়ুন :
‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’: বর্তমান ১৫ সেনা কর্মকর্তা ‘হেফাজতে’

সেনানিবাসে অস্থায়ী কারাগার ঘোষণা পরবর্তী পদক্ষেপ

শনিবার বিকেলে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসকে অস্থায়ী কারাগার ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর ফলে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় নাম থাকা সেনা কর্মকর্তাদের কাউকে সামরিক কারাগারে নয়, বরং এই অস্থায়ী কারাগারেই রাখা হবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে সেনা সদর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ১৫ জন কর্মকর্তাকে সেনা সদর থেকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তারা বর্তমানে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে অবস্থান করছেন।”

একই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই মামলার প্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যমে নানামুখী ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ছড়িয়ে পড়ে—কেউ একে সেনা বাহিনীর “সহযোগিতামূলক অবস্থান” হিসেবে দেখেন, আবার কেউ মনে করেন এটি “অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার কৌশল।”

নিখোঁজ কর্মকর্তার প্রসঙ্গ

পরোয়ানাভুক্তদের মধ্যে মেজর (অব.) কবির আহম্মদের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
তার পরিবারের দাবি, তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। তবে সেনা সদর জানিয়েছে, তিনি “অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা” এবং অন্যদের মতোই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কবির আহম্মদের ভাই এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমার ভাইকে বহু বছর আগে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন আবার তার নাম আসামির তালিকায় দেখে আমরা বিস্মিত।”
এই মন্তব্যের বিষয়ে সরকার বা সেনা সদর এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

বিচার প্রক্রিয়া সম্ভাব্য প্রভাব

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং সংবিধান অনুযায়ী তার রায় বা নির্দেশনা সেনা বাহিনীসহ সব প্রতিষ্ঠানকে মানতে হয়।
তবে সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায়, এখানকার প্রতিটি পদক্ষেপ সরকারের জন্যও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ বলেন, “একযোগে এতজন কর্মকর্তার নাম আসায় স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন উঠছে। তবে সেনাবাহিনী একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রতিষ্ঠান—তারা আদালতের আদেশ মানবে, এটি নিশ্চিত।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের জন্য এ মামলার দুইটি বড় চ্যালেঞ্জ—
এক, বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে দেশি–বিদেশি প্রশ্ন না তোলা;
দুই, সেনা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা।

একজন সাবেক সচিবের ভাষায়, “এ ঘটনাকে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বা শাসনব্যবস্থার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হবে। তাই কোনো ভুল বার্তা যেন না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সেনা ভাবমূর্তি

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের অংশগ্রহণ ও পেশাদারিত্ব আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত।
তবে এ মামলার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে পারে—বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে জাতিসংঘ কী অবস্থান নেয়, সেটিও নজরে থাকবে।

ঢাকায় নিযুক্ত এক পশ্চিমা কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা হলে এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবে যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা পক্ষপাতের ইঙ্গিত দেখা যায়, তা উল্টো প্রভাব ফেলবে।”

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্কের পরীক্ষা

আইন, প্রশাসন, সেনা বাহিনী ও রাজনীতির সংবেদনশীল সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই মামলাটি এখন সবার নজরে।
সেনা কর্মকর্তাদের বেসামরিক আদালতে বিচার—বাংলাদেশে এটি শুধু আইনি ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্কের পরীক্ষাও বটে।

পরবর্তী পদক্ষেপে সরকার ও সেনা সদর কীভাবে পরিস্থিতি পরিচালনা করে—সেটিই নির্ধারণ করবে এই আলোচিত মামলার রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভবিষ্যৎ।

নিউজটি শেয়ার করুন

বিচারের মুখে এত সেনা কর্মকর্তা, আসল উদ্দেশ্য কি?

আপডেট সময় : ০৮:৪০:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশে গুম সংক্রান্ত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ১৫ জন কর্মরত কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এতজন সেনা কর্মকর্তাকে বেসামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করার ঘটনা বিরল। এরপর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে—সেনা কর্মকর্তাদের সিভিল আদালতে বিচার, সরকার–সেনা সম্পর্ক, এবং এর ফলে সেনাবাহিনীর ভেতরে সম্ভাব্য প্রভাব কেমন হতে পারে।

শনিবার ১৫ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে ঘিরে নানা গুজব, আলোচনা এবং পক্ষে–বিপক্ষে প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি কৌশলী অবস্থান নিয়েছে, অন্য অনেক দলই নীরবতা অবলম্বন করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে, সেনাবাহিনীতে একটি পক্ষের প্রভাব নিশ্চিত করার জন্য প্রতিপক্ষকে নির্মূলের জন্য এই বিচারের আয়োজন করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এ ঘটনার দিকনির্দেশনা স্পষ্ট হবে। এরপরই সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক অবস্থানও পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, ঘটনাটি যেভাবে জনসমক্ষে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক পরিসরেও পড়তে পারে বলে তার আশঙ্কা।

তবে কেউ কেউ বলছেন, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হওয়ায় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিতে বড় ক্ষতি হবে না।
অন্যদিকে বেসামরিক আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “গুমের দুই মামলাসহ তিন মামলায় পরোয়ানাভুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তার বিচার করার ক্ষমতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।”

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা সেনা হেফাজতে থাকবেন নাকি সাধারণ আসামিদের মতোই বিবেচিত হবেন—এ প্রসঙ্গে তাজুল ইসলাম বলেন, “আইনের সাধারণ বিধান হচ্ছে, আসামিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়। এরপর আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কোথায় থাকবে।”

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ অতীতের নজির বিবেচনা করলে দেখা যায়, সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে কোনো বাধা নেই।

সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস–কে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, সশস্ত্র বাহিনীর অন্য কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরিকল্পনা নেই।

এই ঘটনার তাৎপর্য বা প্রভাব

ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর সেনা সদর জানিয়েছে, যাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল, সাতজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, একজন কর্নেল, চারজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও একজন মেজর রয়েছেন। তাদের একজন অবসরপ্রস্তুতিকালীন ছুটিতে আছেন।

শনিবার সেনা সদর ব্রিফিংয়ে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, দুটি মামলার ৩০ আসামির মধ্যে ২৫ জনই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত, একজন এলপিআরে এবং ১৫ জন বর্তমান কর্মরত।

এর আগে, ৮ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং তাদের ২২ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়।
এরপর থেকেই ‘সেনা কর্মকর্তাদের বেসামরিক আদালতে বিচার’ ইস্যুতে পক্ষে–বিপক্ষে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সামরিক আইনেই অপরাধের বিচার করার সুযোগ আছে। তাই বিষয়টি যেভাবে জনসমক্ষে এসেছে, তা সেনাবাহিনীর মর্যাদার সঙ্গে যায় না।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, “সেনাবাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাহিনীর কেউ অপরাধ করলে সেটি সামরিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত। বিষয়টি জনসমক্ষে আনার আগে আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার ছিল।”

তার মতে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে সেনাবাহিনীর অবদান ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতেও এ ঘটনার প্রভাব পড়তে পারে।

অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আব্দুর রব খান মনে করেন, এ ঘটনায় বাহিনী নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না, বরং বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করে সেনাবাহিনী প্রশংসা পাবে।
“এটা পুরো বিচার প্রক্রিয়ার অংশ, আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এতে পুরো জাতি জড়িত,” বলেন তিনি।

সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিকও বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে সেনা অফিসারদের হত্যার বিচার বেসামরিক আদালতেই হয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্টও তাতে সম্মতি দিয়েছে। তাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সিভিল আদালতে সেনা কর্মকর্তাদের বিচারে বাধা নেই।

তবে আইনে সুযোগ থাকলেও একযোগে এতজন সেনা কর্মকর্তার বিচার বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, বিষয়টি যেভাবে প্রচারিত হয়েছে তা সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর ফলে বাহিনীর ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হয় এবং সেনা কর্তৃপক্ষ তা কীভাবে সামাল দেয়, সেদিকেও নজর থাকবে।

রাজনৈতিক দলগুলোও সেনাবাহিনীর মনোভাব বিবেচনায় কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। অনেকের ধারণা, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরই সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই মামলায় অগ্রসর হয়েছে।

বিএনপি এক বিবৃতিতে বলেছে, “সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য এই দেশের গর্বিত সন্তান। সীমা লঙ্ঘনকারীরা বিচারের মুখোমুখি হোক—এটাই অধিকাংশ সেনা সদস্যের প্রত্যাশা।”
বিবৃতিতে দলটি আসলে এই পর্যন্ত হওয়া অগ্রগতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

আরও পড়ুন :
‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’: বর্তমান ১৫ সেনা কর্মকর্তা ‘হেফাজতে’

সেনানিবাসে অস্থায়ী কারাগার ঘোষণা পরবর্তী পদক্ষেপ

শনিবার বিকেলে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসকে অস্থায়ী কারাগার ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর ফলে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় নাম থাকা সেনা কর্মকর্তাদের কাউকে সামরিক কারাগারে নয়, বরং এই অস্থায়ী কারাগারেই রাখা হবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে সেনা সদর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ১৫ জন কর্মকর্তাকে সেনা সদর থেকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তারা বর্তমানে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে অবস্থান করছেন।”

একই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই মামলার প্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যমে নানামুখী ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ছড়িয়ে পড়ে—কেউ একে সেনা বাহিনীর “সহযোগিতামূলক অবস্থান” হিসেবে দেখেন, আবার কেউ মনে করেন এটি “অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার কৌশল।”

নিখোঁজ কর্মকর্তার প্রসঙ্গ

পরোয়ানাভুক্তদের মধ্যে মেজর (অব.) কবির আহম্মদের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
তার পরিবারের দাবি, তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। তবে সেনা সদর জানিয়েছে, তিনি “অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা” এবং অন্যদের মতোই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কবির আহম্মদের ভাই এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমার ভাইকে বহু বছর আগে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন আবার তার নাম আসামির তালিকায় দেখে আমরা বিস্মিত।”
এই মন্তব্যের বিষয়ে সরকার বা সেনা সদর এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

বিচার প্রক্রিয়া সম্ভাব্য প্রভাব

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং সংবিধান অনুযায়ী তার রায় বা নির্দেশনা সেনা বাহিনীসহ সব প্রতিষ্ঠানকে মানতে হয়।
তবে সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায়, এখানকার প্রতিটি পদক্ষেপ সরকারের জন্যও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ বলেন, “একযোগে এতজন কর্মকর্তার নাম আসায় স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন উঠছে। তবে সেনাবাহিনী একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রতিষ্ঠান—তারা আদালতের আদেশ মানবে, এটি নিশ্চিত।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের জন্য এ মামলার দুইটি বড় চ্যালেঞ্জ—
এক, বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে দেশি–বিদেশি প্রশ্ন না তোলা;
দুই, সেনা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা।

একজন সাবেক সচিবের ভাষায়, “এ ঘটনাকে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বা শাসনব্যবস্থার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হবে। তাই কোনো ভুল বার্তা যেন না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সেনা ভাবমূর্তি

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের অংশগ্রহণ ও পেশাদারিত্ব আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত।
তবে এ মামলার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে পারে—বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে জাতিসংঘ কী অবস্থান নেয়, সেটিও নজরে থাকবে।

ঢাকায় নিযুক্ত এক পশ্চিমা কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা হলে এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবে যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা পক্ষপাতের ইঙ্গিত দেখা যায়, তা উল্টো প্রভাব ফেলবে।”

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্কের পরীক্ষা

আইন, প্রশাসন, সেনা বাহিনী ও রাজনীতির সংবেদনশীল সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই মামলাটি এখন সবার নজরে।
সেনা কর্মকর্তাদের বেসামরিক আদালতে বিচার—বাংলাদেশে এটি শুধু আইনি ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্কের পরীক্ষাও বটে।

পরবর্তী পদক্ষেপে সরকার ও সেনা সদর কীভাবে পরিস্থিতি পরিচালনা করে—সেটিই নির্ধারণ করবে এই আলোচিত মামলার রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভবিষ্যৎ।