দেশজুড়ে কর্মবিরতিতে কলেজ শিক্ষকরা
- আপডেট সময় : ০১:৫১:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
- / 60
ঢাকা কলেজে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া উত্তেজনা এখন সারাদেশে কর্মবিরতিতে রূপ নিয়েছে। একই সঙ্গে রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে একীভূত করে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠনের প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে শিক্ষকদের ক্ষোভও আরও তীব্র হয়েছে। শিক্ষকরা এই কাঠামোর সংশোধন ও বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকের পদত্যাগ দাবি করেছেন। অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত কাঠামোর বিরোধিতা করে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও পাল্টা কর্মসূচি পালন করছে। ফলে সাত কলেজের শিক্ষা ও প্রশাসনিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত
ঘটনার সূত্রপাত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি আইন–২০২৫’ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে শিক্ষা ভবন অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচি ঘিরে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সোমবার (১৩ অক্টোবর) সকালে সাত কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে পদযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বিষয়টি টের পেয়ে শিক্ষকরা বাধা দিতে গেলে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাকবিনিময় হয়। একপর্যায়ে স্নাতক ২০২২–২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফরহাদ রেজা শিক্ষকদের উদ্দেশে ‘দালাল’ মন্তব্য করলে শিক্ষকরা তাকে আটক করে টিচার্স লাউঞ্জে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন শিক্ষার্থীরা বাধা দিলে ধস্তাধস্তি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।
সাত কলেজকে নিয়ে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ গঠনের বিষয়টি ঘিরে শিক্ষক–শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে। একদিকে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা অধ্যাদেশ সংশোধনের দাবিতে রাজপথে অবস্থান ও অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে শিক্ষক সংগঠনগুলো শিক্ষকদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে কর্মবিরতি ও কালো ব্যাজ ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে স্নাতক শিক্ষার্থীরা ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি আইন–২০২৫’ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে একজোট হয়েছেন।
পরে সহপাঠীরা ফরহাদকে মুক্ত করে আনেন। অভিযোগ রয়েছে, এ সময় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা টিচার্স লাউঞ্জের জানালার কাচ ভাঙচুর করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ফুটেজে দেখা যায়, এক উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী দৌড়ে এসে স্নাতক এক শিক্ষার্থীকে মারধর করছেন।
শিক্ষকদের বক্তব্য
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ আলোচনা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কিছু শিক্ষার্থীর আপত্তিকর কথায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফরহাদ রেজাকে কমনরুমে নেওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা বাধা দেয় ও প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করে।’
আরেক শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সংলাপের মাধ্যমে সমাধান। কাউকে হেয় বা অপমান করার প্রশ্নই ওঠে না।’
সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যাপক মাহফিল আরা বেগম বলেন, ‘সোমবার সকালে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের দুটি কর্মসূচি ছিল— একটি শিক্ষা ভবনের দিকে লংমার্চ, অন্যটি শহীদ মিনার অভিমুখে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অভিযাত্রা। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে উচ্চমাধ্যমিক ও বর্তমান স্নাতকদের বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য না থাকা, কাঠামো বিলুপ্তির আশঙ্কা— এসব কারণেই উত্তেজনা দেখা দেয়।’
তিনি আরও জানান, ‘আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে কিছু ছাত্র উপাধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে হুমকি দেয়। ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌহিদুর রহমান যখন শান্তিপূর্ণভাবে কথা বলতে যান, তখন কিছু ছাত্র তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। বিপুলসংখ্যক বহিরাগতও তখন কলেজে উপস্থিত ছিল, যারা আক্রমণে অংশ নেয়। পরে পুলিশ এসে অবরুদ্ধ শিক্ষকদের উদ্ধার করে।’
শিক্ষার্থী ফরহাদ রেজার বক্তব্য
ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ফরহাদ রেজা দাবি করেন, তিনি কোনো শিক্ষককে আঘাত করেননি বা স্পর্শও করেননি। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি কোনো শিক্ষককে ধরি নাই, গায়ে হাত দিই নাই। আমাদের কর্মসূচি আগেই ঘোষণা করা ছিল, আমরা সেটা শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছু শিক্ষক এসে উল্টো আমাদের দোষ দিতে থাকেন।’
তার দাবি, ‘বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ১০–১৫ জন শিক্ষক আমাকে ঘিরে ফেলে টানাটানি করেন। এতে আমি পড়ে যাই, হাতে ও মাথায় আঘাত পাই। আমার জুতা, ঘড়ি ও কাপড় ছিঁড়ে যায়, মাথা ফেটে রক্তও বের হয়।’
ফরহাদ অভিযোগ করেন, পরে তাকে অফিসে নিয়ে লিখিত বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়। তিনি বলেন, ‘আহত অবস্থায় কিছুই লিখতে পারছিলাম না, তবুও জোর করে লেখানো হয়। এরপর আমার অভিভাবককে ফোন করতে বলা হয়। ভিডিও দেখলেই বোঝা যাবে, আমি কাউকে স্পর্শও করিনি।’
তীব্র প্রতিক্রিয়া: শিক্ষা ক্যাডারের কর্মবিরতি
শিক্ষকদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার। ঘটনার পরপরই ঢাকা কলেজে শিক্ষকরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেন এবং প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াসের পদত্যাগ দাবি করেন।
পরে রাতে বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন যৌথ বিবৃতি দিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশের সরকারি কলেজে সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও কালো ব্যাজ ধারণের ঘোষণা দেয়।
অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব ড. মো. মাসুদ রানা খান বলেন, ‘শিক্ষকদের ওপর হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্য রক্ষা আমাদের মূল লক্ষ্য। সাম্প্রতিক ঘটনাটি সেই মূল্যবোধে আঘাত করেছে। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চাই। একইসঙ্গে সব শিক্ষককে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান জানাচ্ছি।’
পক্ষে–বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ গঠন নিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থী, এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি হয়েছে। একদিকে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা অধ্যাদেশ সংশোধনের দাবিতে রাজপথে, অন্যদিকে শিক্ষক সংগঠনগুলো কর্মবিরতিতে, আর স্নাতক শিক্ষার্থীরা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে— ফলে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
তিন পক্ষের মধ্যে আস্থাহীনতা ও ক্ষোভও বাড়ছে। শিক্ষকরা বলছেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোতে তাদের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কর্তৃত্ব খর্ব হবে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি, শিক্ষকরা তাদের আন্দোলন দমন করতে চাইছেন। উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা আশঙ্কা করছেন, নতুন আইনে তাদের বিভাগ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যা ঢাকা কলেজের শতবর্ষের ঐতিহ্য নষ্ট করবে।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের অগ্রগতি
সরকারি সাত কলেজকে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সোমবার (১৩ অক্টোবর) সচিবালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী প্রতিনিধি তানজিমুল আজিজ জানান, অধ্যাদেশের দ্বিতীয় ধাপের কাজ চলছে, যা সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ। প্রায় ছয় হাজার ইমেইল মতামত জমা পড়েছে, প্রতিটি যাচাই–বাছাই করতে সময় লাগছে।
তিনি বলেন, ‘আগামী তিন–চার দিনের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে পরামর্শ শেষ করে পরবর্তী ধাপে যাওয়া হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে অধ্যাদেশ দ্রুতই ক্যাবিনেটে উঠবে।’
বৈঠকে থাকা শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নাঈম হাওলাদার জানান, ‘২৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছে। তিনি জানিয়েছেন, ছয় হাজারের বেশি মতামত প্রক্রিয়াকরণে পাঁচজন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সব মতামত যাচাই শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করা হবে।’
প্রশাসক ও ইউজিসির মন্তব্য পাওয়া যায়নি
এই পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও অন্তর্বর্তী প্রশাসক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস এবং ইউজিসি ও সাত কলেজবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের সঙ্গে। মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।


















