ডিসেম্বরেই নির্বাচনের প্রস্তুতির নির্দেশে বিএনপির ‘ধন্যবাদ’, এনসিপির শঙ্কা, আস্থা রাখছে জামায়াত
বিবিসি নিউজ বাংলা’র প্রতিবেদন
- আপডেট সময় : ১২:১০:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
- / 274

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে অথবা এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, এমন ঘোষণা আগেই দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এবার নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের প্রস্তুতি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
সংস্কার ও জুলাই সনদের মতো বিষয়গুলো এখনো অমীমাংসিত। এমন প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এরপর রাত ৮টায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে বৈঠকটির বিস্তারিত জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে প্রেস সচিব বলেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে হবে। নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের প্রত্যেককে নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় প্রস্তুতি ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রেস সচিব জানান, প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকে নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে রিভিউ করা হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়ক ও অন্যান্য নির্বাচনি প্রস্তুতি ছাড়াও, আগামী মাসগুলোতে কঠোর আইন প্রয়োগের নির্দেশনাও কথাও জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার এই সিদ্ধান্তকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবেই দেখছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি। ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করার ঘোষণায় প্রধান উপদেষ্টাকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছে দলটি।
আর নির্বাচন, সংস্কারসহ সব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরই আস্থা রাখার কথা বলছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচনের তারিখ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা না থাকলেও, সুষ্ঠু পরিবেশ এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যেন নিশ্চিত হয়।
তবে নির্বাচনের আগে সংস্কার আর জুলাই সনদ নিয়ে শঙ্কায় জাতীয় নাগরিক পার্টি, এনসিপি। বিবিসি বাংলাকে দলটির নেতারা বলেছেন, “দুইবার জুলাই ঘোষণাপত্র দেয়ার কথা বলেও দেয়নি সরকার। কোন জায়গায় বাঁধা এ বিষয়টিও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা জরুরি।”
নির্বাচন চায় সবাই, তবুও শঙ্কা যেখানে
সংস্কার ও নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য নতুন নয়। যৌক্তিক সংস্কার সেরে সামনের বছর রোজার আগেই নির্বাচনে আগ্রহী বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল।
আর মৌলিক সংস্কার ও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ অনেকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চলতি মাসের মধ্যেই জুলাই সনদ প্রস্তুত করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
তিনি বলছেন, যে সব বিষয়ে আলোচনা অগ্রসর হয়েছে, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় কমিশন।
এই প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিতে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে অনেক রাজনৈতিক দল।
তারা বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে ভোটের প্রস্তুতি এখন থেকেই নেয়া জরুরি। তবে সংস্কার ও জুলাই সনদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন কেউ কেউ।
জাতীয় নাগরিক পার্টি, এনসিপি’র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নির্বাচনের তারিখ ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের সমস্যা না, আমাদের মূল কথা হলো, মৌলিক সংস্কার ও জুলাই সনদের ঘোষণাপত্রের দৃশ্যমান পদক্ষেপ এই দুটি করে দ্রুত ইলেকশনের দিকে যেতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিক হলে নির্বাচনের আগেই সংস্কার ও জুলাই সনদের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব বলেই মনে করেন তিনি। “এটা চাইলে এক সপ্তাহের মধ্যেই সম্ভব,” বলেন মি. আদীব।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থার পাশাপাশি শঙ্কাও রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টির।
মি. আদিব বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকার বলছিল জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ হবে এবং এর আগেও দুইবার ঘোষণাপত্র দেয়ার কথা বলেও দেয়নি। কেনো দিতে পারছে না, কোন জায়গায় বাঁধা এ বিষয়টিও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা জরুরি।”
তবে সরকারের ওপর আস্থা রাখছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। রোজার আগে বা পরে নির্বাচনের সময় নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই দলটির। সুষ্ঠু পরিবেশ এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার বিষয়টিই প্রধান হিসেবে দেখছেন তারা।
দলটির মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নির্বাচন যেন সবদিক থেকে সুষ্ঠু হয় এবং ফ্যাসিবাদ যাতে ফিরে না আসে এমন একটা সংস্কার হওয়া উচিৎ।”
“আমরা আস্থা রাখতে চাই, যে কমিটমেন্ট সরকার ও নির্বাচন কমিশন দিয়েছেন জাতির সামনে, সেগুলো ওনারা রক্ষা করবেন,” বলেন মি. জুবায়ের।
অবশ্য গত ১৮ই জুন ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এক বক্তব্যের সমালোচনা করেছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
তিনি বলেছিলেন, “যিনি একটা বিল্ডিংয়ের তালা খোলার মতো ব্যবস্থা করতে পারেন নাই এক মাসেও, তিনশোটা কনস্টিটিউয়েন্সিতে (নির্বাচনি আসন) উনি কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন, এটা খুবই একটা বিষ্ময়ের ব্যাপার।”
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুতি শেষ করতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ নিয়ে কথা বলেছে বিএনপিও।
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে এই পদক্ষেপের জন্য ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলছেন, “এটা একটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার”। এই সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি সেরে কমিশন একটি নির্বাচনের দিকে এগোবে বলেও আশা প্রকাশ করেন মি. আলমগীর।
দাবি জানান, “এই নির্বাচন যেন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।”
মি. আলমগীর বলেন, “নির্বাচন দেশের মানুষ চায়, যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের দিকে যেতে চাই আমরা।”
নির্বাচন কমিশন কতটা প্রস্তুত?
অতীতে বেশিরভাগ সময় জাতীয় নির্বাচনের অন্তত দেড় বছর আগে রোডম্যাপ প্রকাশ করতে দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি শুরু অথবা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা আসলেও এখনো আনুষ্ঠানিক রোডম্যাপ দেয়নি নির্বাচন কমিশন।
যদিও সরকারের ঘোষণা অনুয়ায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে- প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার পর থেকেই কমিশন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
“ইলেকশন কমিশন তো ডিসেম্বর থেকেই প্রস্তুত,” বলেন মি. মাছউদ।
তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার আগের ঘোষিত সময় অনুযায়ীই আমরা অলরেডি প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচন আয়োজন, কমিশনের প্রথম কাজই এইটা।”
“যে টাইম এখন প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় দিয়েছেন এই সময়ের মধ্যে আমরা প্রস্তুত আছি এবং প্রস্তুত হয়ে যাব,” বলছিলেন মি. মাছউদ।
নির্বাচন আয়োজন নিয়ে খুব একটা সমস্যা দেখছেন না নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, অসম্ভব নয়”।
তিনি বলছেন, ভোটার তালিকার ওপর নির্বাচনের বড় একটি প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। কেননা ভোটার তালিকার ওপর নির্ভর করেই ভোটকেন্দ্রের প্রস্তুতি, সীমানা চূড়ান্তসহ নির্বাচন কেন্দ্রিক বড় প্রস্তুতি নিতে হয়।
এছাড়া “রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের মতো কাজগুলোও সময়সাপেক্ষ,” বলেন মি. আলীম।
তবে আগামী নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।


















