গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারার পর এখন কারফিউ : বহু হতাহত, ১০ জনের মৃত্যু দাবি
- আপডেট সময় : ০৮:০৫:০৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
- / 289

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনায় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর গুলিতে বহু প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। দুইজনের মারা যাওয়ার তথ্য সংবাদ মাধ্যম নিশ্চিত হতে পেরেছে। গুলিবিদ্ধ ৯জনের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলাটিতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বুধবার (১৬ জুলাই) রাত আটটা থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে।
বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে।
এনসিপির ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। উত্তেজনার প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। গোপালগঞ্জের পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে মঞ্চে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার পর এনসিপি নেতারা সমাবেশ শেষ করে ফিরে যাওয়ার সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এরপর ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। হামলা–সংঘর্ষের এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত দুজন নিহত হয়েছেন।
নিহত দুজন হলেন গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫) ও কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮)। অবশ্য স্থানীয়রা দশজনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস জানান, বিকেলে তিনজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাঁরা গুলিবিদ্ধ ছিলেন।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে নিহত দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয় গেছে। অপরজনের মৃত্যুর বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত যায়নি। হাসপাতালের একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই ব্যক্তির লাশ স্বজনেরা নিয়ে গেছেন।
হাসপাতালের কর্মকর্তা জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, আরও ৯ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের অস্ত্রোপচার চলছে।
নিহত দীপ্ত সাহার চাচা হাসপাতালে বলেন, দীপ্ত দুপুরের খাবার খেয়ে তাঁর দোকানে যাচ্ছিলেন। শহরের চৌরঙ্গীতে তাঁর পেটে গুলি লাগে।
নিহত রমজান কাজীর বাবা কামরুল কাজী বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলছে। আমার ছেলে তো কোনো দোষ করেনি। আমি আমার সন্তানকে কোথায় পাব?’

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, এনসিপির সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল ব্যক্তি লাঠিসোঁটা নিয়ে এনসিপির গাড়ি বহর ঘিরে হামলা চালান। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এনসিপির নেতারা সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে প্রশাসনের আশ্রয়ে চলে যান। অন্যরা অন্যদিক দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
ভাইরাল ভিডিওতে যা দেখা যায়
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু ভিডিও ও আলোকচিত্র ভাইরাল হয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায় একজন আহতকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন সেনা সদস্য। ওই আহত নড়াছড়া করলে একজন সেনা সদস্য পা দিয়ে তার মাথা চেপে ধরে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ছেলেটিকে পুলিশ সদস্যরা আটক করেছে। ফটোসাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সে নিজেকে ছাত্রলীগ কর্মী বলে পরিচয় দেয়। তখনই এক পুলিশ কনস্টেবল তাকে মারধর করে।
আরেকটি ভাইরাল ভিডিও, একটি টেলিভিশনের লাইভে শোনা যায়, একজন সেনা অফিসার সরাসরি গুলি করতে সৈনিকদের নির্দেশ দিচ্ছেন। “ডায়রেক্ট গুলি কর বাইঞ্চুত। গুলি তো করছি স্যার। গুলি কর, ডায়রেক্ট গুলি কর।”
হামলার ঘটনার পর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এই হামলা চালিয়েছেন। এ সময় পুলিশ-সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তাদের (এনসিপি) বলা হয়েছিল, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা সমাবেশস্থলে এসে দেখেন, পরিস্থিতি ঠিক নেই।
সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনা, হামলা
এনসিপির সমাবেশকে ঘিরে সকাল থেকে দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলির শব্দে গোটা গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। হাতবোমা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের বিকট শব্দ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে আতঙ্কে শহরের অধিকাংশ এলাকায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের চলাচলও সীমিত হয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলা যখন হয়, তখন বৃষ্টি চলছিল। সমাবেশমঞ্চে ছিলেন এনসিপির স্থানীয় নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতারা পৌঁছালেই পুরোদমে সমাবেশের কার্যক্রম শুরুর জন্য তারা অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় খাল পার হয়ে এসে লাঠিসোঁটা নিয়ে পৌরপার্কে সমাবেশস্থলে ঢুকে পড়েন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুই থেকে তিনশন নেতাকর্মী। তারা বোমাবাজি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন একং সমাবেশ মঞ্চের ব্যানার ছিঁড়ে চেয়ার ও মাইক ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় মঞ্চের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা দ্রুত আদালত চত্বরে ঢুকে পড়েন। হঠাৎ আক্রমণে হতচকিত এনসিপি কর্মীরাও দৌড়ে সরে যান।
তবে অল্প সময়ের মধ্যে তারা সামলে উঠে ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। জেলার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমানও ঘটনাস্থলে আসেন।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বেলা ২টার পরপরই সমাবেশস্থলে পৌঁছান। এরপর পুরোদমে সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হয়।
এনসিপি নেতারা সমাবেশ শেষ করে বের হয়ে যাওয়ার সময় আবারও হামলার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার দুপুর পৌনে ৩টার দিকে শহরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় গোপালগঞ্জ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এই অবস্থায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধরা জারি করা হয়। জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, “জেলা প্রশাসক মো. কামরুজ্জামান জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছেন।”
গোটা শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি সবশেষ চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এসব হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছেন। তবে সেই সংখ্যা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি।
জবাব দেওয়া ঘোষণা এনসিপির
সমাবেশে ‘মুজিববাদীদের’ বাধার জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। নাহিদ বলেন, “মুজিববাদীরা আজকে বাধা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে আমরা বলেছিলাম, বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই, সেই লড়াইয়ে জিততে হবে। সেই লড়াইয়ে আমরা জিতেছিলাম। আজকে আমাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। অচিরেই আমরা এর জবাব দেব ইনশাল্লাহ।”
নাহিদ বলেন, “যারা গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে, নতুন বাংলাদেশের পক্ষে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। এই গোপালগঞ্জ যেন আর মুজিববাদীদের কেন্দ্র হয়ে উঠতে না পারে। যদি পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, নিজেদের জেলার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব, বাংলাদেশকে রক্ষা দায়িত্ব আমাদের নিজেদের নিতে হবে। যেমন আমরা গণঅভ্যুত্থানে নিয়েছিলাম।”
সমাবেশে নাহিদ বলেন, “আমরা নিশ্চিত করতে চাই, গোপালগঞ্জ নামের কারণে ভবিষ্যতের চাকরি ক্ষেত্রে বা অন্য কোনো স্থানে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। কিন্তু গোপালগঞ্জে সন্ত্রাসীদের আস্তানা হতে আমরা দেব না। মুজিববাদীরা মুক্তিযুদ্ধকে কলুষিত করেছে, গোপালগঞ্জকেও কলুষিত করেছে। সেই গোপালগঞ্জকে আমরা উদ্ধার করব এবং সমুন্নত করব। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেক সম্পদ আওয়ামী দখল করেছে। তাদের সঙ্গে বেইনসাফ করেছে। আমরা নতুন বাংলাদেশে সকল ধর্মের অধিকার রক্ষা করব।”
এনসিপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, “আজকে মুজিববাদীরা বাধা দিয়েছে, তাদের জবাব দেওয়া হবে। আমরা ঘোষণা দিলে সারা বাংলাদেশ এই গোপালগঞ্জে এসে জড়ো হবে। কিন্তু আমরা সময় দিয়ে যাচ্ছি। আজকে যে হামলা হল, কোন সাহসে বাধা দেওয়া হয়েছে, কোন সাহসে মুজিববাদীরা গোপালগঞ্জে এখনও আশ্রিত হয়ে আছে, কারা আশ্রয় দিয়েছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি এর সামধান না হয় তাহলে আমরা আবারও আসব গোপালগঞ্জে। আমরা নিজ হাতে দায়িত্ব নিয়ে গোপালগঞ্জকে মুবিবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করব ইনশাল্লাহ। মুজিববাদীদের কবর রচনা করে, বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচনা করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব এটা আমাদের আপনাদের কাছে ওয়াদা।”
এ সময় এনসিপি নেতারা, ‘ইনকিলাব-জিন্দাবাদ’, ‘মুজিববাদ-মুর্দাববাদ’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
কেন এই উত্তেজনা
অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ১ জুলাই থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এর অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে বুধবার গোপালগঞ্জে সমাবেশ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া। সারা দেশে কর্মসূচির নাম ‘জুলাই পদযাত্রা’ হলেও গোপালগঞ্জের কর্মসূচির নামকরণ করা হয় ‘মার্চ টু গোপালগঞ’। এনসিপির নেতারা ফেসবুকে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সমাবেশকে ঘিরে মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) রাত থেকে উত্তেজনা তৈরি হয়।
এদিকে, এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়িবহর গোপালগঞ্জে পৌঁছানোর আগে সকালে সদর উপজেলার উলপুর এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীরা পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন দেয় ও ভাঙচুর করে। এ সময় সেখানে কয়েকজন পুলিশ সদস্য মারধরের শিকার হয় বলে গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মির মো. সাজেদুর রহমান জানান।
এরপর বেলা ১১টার দিকে টেকেরহাট সড়কের কংশুর এলাকায় সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এম রকিবুল হাসানের গাড়িতেও হামলা হয়। এ সময় গাড়িচালক মইন আহত হন।
এর আগে সকালে সদর উপজেলার গান্ধীয়াশুর এলাকায় ঘোনাপাড়া-টেকেরহাট আঞ্চলিক সড়কে গাছ কেটে সড়ক অবরোধ করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।


















