ঢাকা ০৮:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না কুকুরছানা হত্যা মামলায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে ২ বছরের শিশু খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিতে ঢাকায় আসছেন জুবাইদা যুক্তরাজ্যের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী! কাতারের রাজপরিবারের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যেসব অত্যাধুনিক সুবিধা রয়েছে কাকরদিয়া–তেরাদল–আলিপুর এডুকেশন ট্রাস্ট ইউকের আত্নপ্রকাশ

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা নিয়ে কেনো সবাই হতবাক

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০১:১১:২৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫
  • / 262
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ১০ মাসের মাথায় কালোটাকা সাদা করার সুবিধা পুনর্বহাল করায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাধারণ করদাতারা সরকারের এই হঠাৎ ইউটার্নে বিস্মিত।

সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, নির্দিষ্ট হারে কর প্রদানের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ থাকছে এই বাজেটে। অর্থাৎ, আগের সরকারের দেওয়া বিনা জবাবদিহিতে কালোটাকা সাদা করার সুবিধাই কার্যত বহাল রাখা হয়েছে।

এই ঘোষণার পরই নাগরিক সমাজ ও অর্থনীতিবিদরা কড়া সমালোচনা শুরু করেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একে দুর্নীতিবান্ধব এবং কর ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা ‘জুলাই আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক’।

মঙ্গলবার (৩ জুন) বাজেট-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জুলাই আন্দোলন হয়েছিল বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। অথচ বাজেটে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রেখে সেই প্রত্যয়কেই নস্যাৎ করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই সুযোগ নৈতিক করদাতাদের প্রতি অবিচার, যা বৈধ আয় করা মানুষদের প্লট বা ফ্ল্যাট কেনা কঠিন করে দেবে। এছাড়া এতে রাজস্ব আদায়ের খুব বেশি সম্ভাবনাও নেই।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অপ্রদর্শিত আয়ে ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সুযোগ সমাজে আরও বৈষম্য সৃষ্টি করবে। কালোটাকা সাদা করার নীতি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, আমরা এটি সমর্থন করি না।’

টিআইবি কালোটাকা সাদা করার সুযোগকে ‘অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধানবিরোধী’ আখ্যা দিয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকার দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের অঙ্গীকার উপেক্ষা করে রিয়েল এস্টেট লবির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনুপার্জিত আয় রাষ্ট্র দ্বারা বৈধ হতে পারে না। অথচ এই সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার সৃষ্টি করছে এবং ভবিষ্যৎ দুর্নীতিকে উৎসাহ দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘যদি সরকার সত্যিই দুর্নীতি প্রতিরোধে আন্তরিক হয়, তাহলে কালোটাকা সাদা করার মতো সুবিধা কোনোভাবেই দেওয়া যায় না। এটি জনআস্থার পরিপন্থী এবং আইনবহির্ভূত আয়ের প্রতি এক ধরনের নৈতিক বৈধতা তৈরি করে।’

টিআইবির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কালোটাকার পরিমাণ যদি ৪০ শতাংশও হয়, তাহলে তা দাঁড়াতে পারে ১০ থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার মতো।

এদিকে এনবিআর-এর তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা হয়েছে, যা মোট কালোটাকার তুলনায় নগণ্য। এই সামান্য রাজস্ব আয়ের বিনিময়ে নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়াকে বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করেছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের হঠাৎ ইউটার্ন কেন?

২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার জোরেশোরে বলেছিল, তারা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করবে এবং কর ব্যবস্থায় সংস্কার আনবে। ক্ষমতায় আসার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে অর্থাৎ গত ২ সেপ্টেম্বর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তার আগে ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ তথ্য জানান। এরপরই এনবিআর এই বিধান বাতিল করে।

কিন্তু এর ঠিক ১০ মাস পর সোমবার (২ জুন) প্রস্তাবিত বাজেটে এলাকা ভিত্তিক জমির ওপর নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার সুযোগ বহাল রাখার প্রস্তাব আসে। অর্থাৎ আগামী ১ জুলাই থেকে বর্গমিটারের পরিবর্তে বর্গফুট হিসাবে কর দিতে হবে।

তবে এ সুবিধা পাচ্ছে না যদি সেই অর্থ কোনও অপরাধমূলক বা অবৈধ উৎস থেকে উদ্ভূত হয়। চলতি অর্থবছরে এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যেত না, তবে প্রস্তাবিত বাজেটে তা সম্ভব হবে। এছাড়া একাধিক বিল্ডিংয়ের মালিকদের জন্য ২০ শতাংশ কর দিয়ে প্রদর্শনের সুযোগ, গোপন আয়ের ১৫০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ এবং বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধতার সুযোগ এবার বাতিল করা হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক ভবন ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

অর্থ বিলে (২০২৫) বলা হয়েছে, ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত দুই হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে ৯০০ টাকা এবং ফ্ল্যাট কিনলে ২ হাজার টাকা করে কর দিতে হবে। দুই হাজার বর্গফুটের ভবনের ক্ষেত্রে কর হবে ১৮ লাখ টাকা, ফ্ল্যাট কিনলে ৪০ লাখ টাকা।

সরকারের ব্যাখ্যা

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাপকভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি। তিনি বলেন, ‘কোনো কারণে কারও অপ্রদর্শিত টাকা থাকলে সেগুলো প্রদর্শনের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে সমালোচনার কারণে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে। এটা করে ফেলেছি মানেই যে ভালো কিছু হয়েছে, তা নয়।’

মঙ্গলবার (৩ জুন) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

একই প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, ‘গত বছর (আগস্ট ২০২৪) থেকে কালোটাকা বৈধ করার বিশেষ সুযোগ পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। এবারও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে।’

তিনি জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে কেউ যদি অপ্রদর্শিত অর্থে কোনো ফ্ল্যাট বা জমি কেনেন, তাহলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি কর দিয়ে সেটি বৈধ করতে পারবেন। নিজের নামে থাকা জমিতে বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রেও দ্বিগুণ হারে কর দিতে হবে। অতিরিক্ত কর পরিশোধের পর বিনিয়োগ আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।

তিনি বলেন, ‘এটা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নয়। বরং নির্দিষ্ট খাতে অতিরিক্ত কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের একটা পথ রাখা হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ওপর কোনো কর আরোপ করা হয়নি। এটি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে ২২ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবুও, এর বিপরীতে যে পরিমাণ কালো টাকা রয়েছে, তার তুলনায় করের আওতায় আসা অংশ সামান্যই।

আগের সরকারের অভিজ্ঞতা

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ‘কোনো প্রশ্ন না করে’ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু এতে কাঙ্ক্ষিত অর্থ আসেনি। এনবিআর-এর তথ্যমতে, মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকা আয় প্রদর্শিত হয়, যা রাজস্ব আয়ের তুলনায় অতি সামান্য।

অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যারা নিয়মিত কর দেন, তারা এমন সিদ্ধান্তে নিরুৎসাহিত হন। এতে অসৎ আয়ের জন্য প্রণোদনা তৈরি হয় এবং কর প্রশাসনের ওপর আস্থা কমে যায়।’

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কালোটাকা বৈধতা?

বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝোতা ও ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে মাথায় রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার এই সুবিধা চালু করছে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার হয়তো আবাসন ও পুঁজিবাজার চাঙা করতে চাইছে, কারণ অতীতে কালোটাকা এই খাতেই বেশি ব্যবহৃত হতো।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যাত্রা শুরু করা সরকার কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়? অন্তর্বর্তী সরকারের ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক’ ভাবমূর্তির সঙ্গে বাজেটের এই ঘোষণা বড় ধাক্কা বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত থাকলে তা একদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে উৎসাহিত করবে, অন্যদিকে কর ন্যায্যতা ও সামাজিক সুবিচারকে হুমকির মুখে ফেলবে।

এখন দেখার বিষয়, জনমতের চাপে সরকার সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করে, নাকি এটাই তাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে করা প্রথম বড় সমঝোতা হিসেবে থেকে যায়।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা নিয়ে কেনো সবাই হতবাক

আপডেট সময় : ০১:১১:২৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ১০ মাসের মাথায় কালোটাকা সাদা করার সুবিধা পুনর্বহাল করায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাধারণ করদাতারা সরকারের এই হঠাৎ ইউটার্নে বিস্মিত।

সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, নির্দিষ্ট হারে কর প্রদানের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ থাকছে এই বাজেটে। অর্থাৎ, আগের সরকারের দেওয়া বিনা জবাবদিহিতে কালোটাকা সাদা করার সুবিধাই কার্যত বহাল রাখা হয়েছে।

এই ঘোষণার পরই নাগরিক সমাজ ও অর্থনীতিবিদরা কড়া সমালোচনা শুরু করেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একে দুর্নীতিবান্ধব এবং কর ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা ‘জুলাই আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক’।

মঙ্গলবার (৩ জুন) বাজেট-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জুলাই আন্দোলন হয়েছিল বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। অথচ বাজেটে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রেখে সেই প্রত্যয়কেই নস্যাৎ করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই সুযোগ নৈতিক করদাতাদের প্রতি অবিচার, যা বৈধ আয় করা মানুষদের প্লট বা ফ্ল্যাট কেনা কঠিন করে দেবে। এছাড়া এতে রাজস্ব আদায়ের খুব বেশি সম্ভাবনাও নেই।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অপ্রদর্শিত আয়ে ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সুযোগ সমাজে আরও বৈষম্য সৃষ্টি করবে। কালোটাকা সাদা করার নীতি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, আমরা এটি সমর্থন করি না।’

টিআইবি কালোটাকা সাদা করার সুযোগকে ‘অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধানবিরোধী’ আখ্যা দিয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকার দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের অঙ্গীকার উপেক্ষা করে রিয়েল এস্টেট লবির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনুপার্জিত আয় রাষ্ট্র দ্বারা বৈধ হতে পারে না। অথচ এই সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার সৃষ্টি করছে এবং ভবিষ্যৎ দুর্নীতিকে উৎসাহ দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘যদি সরকার সত্যিই দুর্নীতি প্রতিরোধে আন্তরিক হয়, তাহলে কালোটাকা সাদা করার মতো সুবিধা কোনোভাবেই দেওয়া যায় না। এটি জনআস্থার পরিপন্থী এবং আইনবহির্ভূত আয়ের প্রতি এক ধরনের নৈতিক বৈধতা তৈরি করে।’

টিআইবির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কালোটাকার পরিমাণ যদি ৪০ শতাংশও হয়, তাহলে তা দাঁড়াতে পারে ১০ থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার মতো।

এদিকে এনবিআর-এর তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা হয়েছে, যা মোট কালোটাকার তুলনায় নগণ্য। এই সামান্য রাজস্ব আয়ের বিনিময়ে নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়াকে বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করেছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের হঠাৎ ইউটার্ন কেন?

২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার জোরেশোরে বলেছিল, তারা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করবে এবং কর ব্যবস্থায় সংস্কার আনবে। ক্ষমতায় আসার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে অর্থাৎ গত ২ সেপ্টেম্বর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তার আগে ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ তথ্য জানান। এরপরই এনবিআর এই বিধান বাতিল করে।

কিন্তু এর ঠিক ১০ মাস পর সোমবার (২ জুন) প্রস্তাবিত বাজেটে এলাকা ভিত্তিক জমির ওপর নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার সুযোগ বহাল রাখার প্রস্তাব আসে। অর্থাৎ আগামী ১ জুলাই থেকে বর্গমিটারের পরিবর্তে বর্গফুট হিসাবে কর দিতে হবে।

তবে এ সুবিধা পাচ্ছে না যদি সেই অর্থ কোনও অপরাধমূলক বা অবৈধ উৎস থেকে উদ্ভূত হয়। চলতি অর্থবছরে এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যেত না, তবে প্রস্তাবিত বাজেটে তা সম্ভব হবে। এছাড়া একাধিক বিল্ডিংয়ের মালিকদের জন্য ২০ শতাংশ কর দিয়ে প্রদর্শনের সুযোগ, গোপন আয়ের ১৫০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ এবং বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধতার সুযোগ এবার বাতিল করা হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক ভবন ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

অর্থ বিলে (২০২৫) বলা হয়েছে, ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত দুই হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে ৯০০ টাকা এবং ফ্ল্যাট কিনলে ২ হাজার টাকা করে কর দিতে হবে। দুই হাজার বর্গফুটের ভবনের ক্ষেত্রে কর হবে ১৮ লাখ টাকা, ফ্ল্যাট কিনলে ৪০ লাখ টাকা।

সরকারের ব্যাখ্যা

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাপকভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি। তিনি বলেন, ‘কোনো কারণে কারও অপ্রদর্শিত টাকা থাকলে সেগুলো প্রদর্শনের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে সমালোচনার কারণে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে। এটা করে ফেলেছি মানেই যে ভালো কিছু হয়েছে, তা নয়।’

মঙ্গলবার (৩ জুন) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

একই প্রশ্নের উত্তরে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, ‘গত বছর (আগস্ট ২০২৪) থেকে কালোটাকা বৈধ করার বিশেষ সুযোগ পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। এবারও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে।’

তিনি জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে কেউ যদি অপ্রদর্শিত অর্থে কোনো ফ্ল্যাট বা জমি কেনেন, তাহলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি কর দিয়ে সেটি বৈধ করতে পারবেন। নিজের নামে থাকা জমিতে বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রেও দ্বিগুণ হারে কর দিতে হবে। অতিরিক্ত কর পরিশোধের পর বিনিয়োগ আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।

তিনি বলেন, ‘এটা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নয়। বরং নির্দিষ্ট খাতে অতিরিক্ত কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের একটা পথ রাখা হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ওপর কোনো কর আরোপ করা হয়নি। এটি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে ২২ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবুও, এর বিপরীতে যে পরিমাণ কালো টাকা রয়েছে, তার তুলনায় করের আওতায় আসা অংশ সামান্যই।

আগের সরকারের অভিজ্ঞতা

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ‘কোনো প্রশ্ন না করে’ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু এতে কাঙ্ক্ষিত অর্থ আসেনি। এনবিআর-এর তথ্যমতে, মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকা আয় প্রদর্শিত হয়, যা রাজস্ব আয়ের তুলনায় অতি সামান্য।

অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যারা নিয়মিত কর দেন, তারা এমন সিদ্ধান্তে নিরুৎসাহিত হন। এতে অসৎ আয়ের জন্য প্রণোদনা তৈরি হয় এবং কর প্রশাসনের ওপর আস্থা কমে যায়।’

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কালোটাকা বৈধতা?

বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝোতা ও ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে মাথায় রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার এই সুবিধা চালু করছে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার হয়তো আবাসন ও পুঁজিবাজার চাঙা করতে চাইছে, কারণ অতীতে কালোটাকা এই খাতেই বেশি ব্যবহৃত হতো।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যাত্রা শুরু করা সরকার কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়? অন্তর্বর্তী সরকারের ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক’ ভাবমূর্তির সঙ্গে বাজেটের এই ঘোষণা বড় ধাক্কা বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত থাকলে তা একদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে উৎসাহিত করবে, অন্যদিকে কর ন্যায্যতা ও সামাজিক সুবিচারকে হুমকির মুখে ফেলবে।

এখন দেখার বিষয়, জনমতের চাপে সরকার সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করে, নাকি এটাই তাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে করা প্রথম বড় সমঝোতা হিসেবে থেকে যায়।