ঢাকা ০৮:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না কুকুরছানা হত্যা মামলায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে ২ বছরের শিশু খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিতে ঢাকায় আসছেন জুবাইদা যুক্তরাজ্যের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী! কাতারের রাজপরিবারের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যেসব অত্যাধুনিক সুবিধা রয়েছে কাকরদিয়া–তেরাদল–আলিপুর এডুকেশন ট্রাস্ট ইউকের আত্নপ্রকাশ

এখন লড়াই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে: ফরহাদ মজহার

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০৮:৩০:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫
  • / 543
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়াকে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ আখ্যা দিয়ে এর ফলাফল ‘ইতিবাচক’ হবে বলেই মনে করছেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তার মতে, এখন বাংলাদেশের জনগণের সামনের লড়াই ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে। জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে তাতে সব ধরনের ‘ফ্যাসিবাদী’ শক্তিকে মোকাবেলা করার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গঠনের রাজনীতি করার তাগিদ এসেছে তার তরফে। তার মতে, ফ্যাসিবাদী কোনো মতের বা কোনো মতাদর্শের রাজনৈতিক পুনর্বাসন চলবে না, যা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। তবে দলটির কর্মী-সমর্থকদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করতে হবে।

রোববার (১১ মে ২০২৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন ফরহাদ মজহার। অনেকের মতে তিনি জুলাই গণ অভ্যুত্থানের নেপথ্যের অন্যতম নায়ক। বাংলাদেশে নানা ধরনের ‘ফ্যাসিস্ট’ প্রবণতা বিদ্যমান থাকা এবং তা থেকে মুক্তির উপায় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদীদের দুটো চরিত্র আছে। এটা তো একই মুদ্রার দুই পিঠ। একটা হল– তার সেকুলার চরিত্র, আরেকটা হচ্ছে তার ধর্মীয় জাতিবাদী চরিত্র। দুটোই জাতিবাদের দুটো পিঠ। ওটা হল সেকুলার জাতিবাদ। এটা হল ধর্মীয় জাতিবাদ। “ফলে বাংলাদেশের জনগণের সামনে দুটো শত্রু। এই দুটো শত্রুর বিরুদ্ধে তাকে লড়াই করতে। আমরা ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুরু করেছি। জনগণ এখন বুঝতেছে ধর্মীয় জাতিবাদ কী ভয়ংকর। এটার বিরুদ্ধে লড়াই হবে।”

জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবির মুখে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম শনিবার রাতে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সম্পর্কিত প্রজ্ঞাপন সোমবার জারি হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। একই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিকে জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনার সিদ্ধান্তও হয়েছে। ‘ইনসাইড আউটের’ আলোচনায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, সমকালীন রাজনীতি, রাজনীতির প্রতিবন্ধকতা, ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরেন ফরহাদ মজহার। গ্রন্থনা করেছেন মাছুম কামাল ও জি এম মোস্তাফিজুল আলম।

ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কেন এবং কীভাবে লড়াই
ফরহাদ মজহার যে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেছেন, সেটি কার বিরুদ্ধে, কীভাবে হবে সেটির ব্যাখ্যাও তিনি করেছেন। এর আগে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ একাই শুধু ‘ফ্যাসিস্ট’ নয়, বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ধর্মীয় নানান ‘ফ্যাসিস্ট’ প্রবণতা রয়েছে।

তারা কারা সেই ব্যাখায় ইনসাইড আউটে তিনি বলেন, “প্রথমত তিনটা ভাগ করবেন আপনি।

”আমাদের লড়তে হচ্ছে প্রথমত ফ্যাসিবাদ…এটা ইডিওলজি, এরপর হল ‘ফ্যাসিস্ট শক্তি’। এটা কিন্তু ইডিওলজি না, এটা অর্গানাইজড। ইডিওলজি যখন একটা অর্গানাইজড সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তি আকারে হাজির থাকে, এটা হল একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি। আর তিন নম্বর হল–‘ফ্যাসিস্ট সংবিধান’।”

‘সেক্যুলার ফ্যাসিবাদ যেটা বাঙালি জাতিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের নামে তৈরি হয়েছিল’ সেটা এরই মধ্যে মোকাবেলা করা হয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।

চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, “সেকুলার ফ্যাসিবাদ আমরা মোকাবেলা করেছি। কিন্তু একই সঙ্গে আরেকটা– ধর্মীয় জাতিবাদ। ধর্মের নামে মনে করে যে, তার অবস্থানই সহীহ। আর সকলে তার শত্রু এবং তাদের বিরুদ্ধে তারা একটা সংগ্রাম করে। যে শক্তিটা মাজার ভাঙে ইসলামের নামে, যে শক্তিটা ইসলামের নামে মেয়েকে অপমান করে, যে ফ্যাসিবাদ এই ইসলামের নামে তার যে মহিমা, তার যে ফিলোসফিক্যাল শক্তি, সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এটাকে একটা পরকালবাদী ধর্ম আকারে হাজির করে।”

সমাজের যেকোনো প্রকার ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রাকে যে বাধা দেয় ক্রমাগত, এটা কি ফ্যাসিবাদ নয়– সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি।

ধর্মীয় জাতিবাদেরও পতন হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের যদি পতন ঘটে থাকে তাহলে ধর্মীয় জাতিবাদেরও পতন ঘটবে। কারণ ধর্মীয় জাতিবাদের কোনো প্রকার স্থান বিশ্ব ইতিহাসে হবে না। আর বাংলাদেশে ইতিহাসে এটা কখনো হবে না। কিন্তু ইসলামের হবে। ইসলাম ভিন্ন জিনিস। ইসলামী যারা, যদি কেউ সত্যিকারের মোমিন বা মুসলমান হয়ে থাকে তার প্রথম শিক্ষা ইসলাম জাতিবাদ বিরোধী। ইসলাম কোনো প্রকার জাতিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না।”

আর কাউকে নিষিদ্ধের দাবি উঠবে?
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে ঘিরে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান; পতন ঘটে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলের।

আন্দোলনের মধ্যেই আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিবাদ’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগের দাবি জোরালো হতে থাকে। সরকার পতনের পর আন্দোলন দমাতে শক্তিপ্রয়োগ ও ’গণহত্যার’ অভিযোগ তুলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারাসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও দলের বিচারের দাবি আসছে।

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অন্যান্য ‘ফ্যাসিবাদের’ কথাও বলে আসছে ফরহাদ মজহার। সেক্ষেত্রে অন্য কোনো দলকেও নিষিদ্ধের দাবি আসবে কি না রোববার ‘ইনসাইড আউট’ অনুষ্ঠানের আলোচনায় এই প্রশ্ন ছিল তার কাছে।

জবাবে তিনি বলেন, “সেটা নির্ভর করছে তাদের তৎপরতা দেখে। যেমন ধরেন, আজকে যে এক ধরনের ইসলামপন্থিকে দেখলাম, যারা শাপলা চত্বরটা বানাতে দেয়নি আমাদের ধর্মের নামে; যে মিনার তৈরি করাটা খারাপ। স্মৃতিটাকে তারা ধ্বংস করেছে। শেখ হাসিনা যেভাবে এই তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রদের হত্যা করেছে, যে রক্তপাত ঘটিয়েছে, এটাকে ধামাচাপার দেওয়ার জন্য যারা শেখ হাসিনাকে কওমি জননী বলেছে এবং কওমি জননী বলার মধ্য দিয়ে যারা শাপলা চত্বরকে একটা ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ বানাতে যারা বাধা দিয়েছে, এরা তো স্বভাবতই বাংলাদেশের মুসলমানদের দুষমন।”

এক যুগ আগে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডেকেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। শাহবাগের আন্দোলনের বিপরীতে ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে সেখানে তারা অবস্থান নিলে তাদের হঠাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বল প্রয়োগ করলে সেখানে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে।

তখনকার সেই প্রেক্ষাপটের কথা তুলে ধরে ধর্মীয় গোষ্ঠী শাপলা ছেড়ে শাহবাগ দখল করেছে বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার। বলেন, “এরা এখন কী করছে? এরা এখন শাহবাগ দখল করতে আসছে। শাহবাগ তো তোমার জায়গা না। তোমার জায়গা ছিল শাপলা। যেখানে শাপলা ছিল সিম্বল। শাপলা ছিল আমাদের লড়াইয়ের জায়গা। শাপলা ছিল আমাদের স্মৃতিচিহ্ন। সে স্মৃতিচিহ্নকে তোমরা ধ্বংস করেছ। ধ্বংস করে এসে এখন তোমরা শাহবাগকে অপবিত্র করতে এসেছ।

”এটা তো চলবে না। এভাবে তো রাজনীতি চলবে না। এই হচ্ছে ফ্যাসিজমের চরিত্র। এই ফ্যাসিজমকে ধরিয়ে দেওয়াটা এটা আমাদের এখনকার কাজ।”

এই গোষ্ঠীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, “যারা মাজার ভেঙেছে, যারা মাজার ভাঙে এবং যারা মেয়েদেরকে অপমান করে, মেয়েদেরকে কোনো প্রকার সম্মান দেয় না, মেয়েদেরকে তাদের দাসি-বাদী মনে করে। আপনি কি মনে করে বাংলাদেশের জনগণ গণঅভ্যুত্থানের পরে এদেরকে সহ্য করবে? অবশ্যই সহ্য করবে না।

”ফলে এইজন্য আমরা মনে করি যে, সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে এবং মোকাবেলা করার মধ্য দিয়ে একটা নতুন বাংলাদেশ গঠন করবার রাজনীতি আমাদের করতে যাবে।”

‘ধর্মীয় জাতিবাদীরা আওয়ামী লীগেরই দোসর’
ফরহাদ মজহার মনে করেন, যারা ইসলাম ধর্মের হয়ে নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা দেয়, মাজার ভাঙে, তারা আওয়ামী লীগেরই দোসর। তিনি বলেন, “যারাই মুসলিম জাতিবাদের নামে, ইসলামী জাতিবাদের নামে, ধর্মীয় জাতিবাদের নামে রাজনীতি করতে চাইছে, তারা আওয়ামী লীগেরই দোসর। দেখবেন তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা আনার জন্য নানা রকম তৎপরতা এখন বাংলাদেশে শুরু করেছে। ফলে এখনকার লড়াই একান্ত ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ইসলামের মহিমা কায়েম করার লড়াই।”

বাঙালি মানেই মুসলমান বাঙালিই বোঝায় বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। বলেন, “বাঙালি মানে কিন্তু কলকাতার বাঙালি বোঝায় না। আমরা যুদ্ধ করে বাঙালি হয়েছি। ফলে বাঙালি বলতে সবসময় মুসলমান বাঙালিই বোঝায়।

”সেই দিক থেকে ইসলামের মহিমা যখন আমরা আত্মস্থ করব বাঙালি হিসেবে…আমরা তো আরব না, আমরা তো ইরানি না, আমরা তুরানি না, ফলে আমরা আরব হিসেবে নয়, বাংলাভাষী বাংলা সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হিসেবে যখন বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির মধ্যেও আমরা ইসলামের মহিমা কায়েম করব, এটাই হবে বাংলাদেশের জনগণের সামনে এগিয়ে যাবার আপনার অগ্রযাত্রা। এটা আমরা করব। রাজনৈতিক নয়, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে হবে সামাজিকভাবে’

গণ অভ্যুত্থানে দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ফেইসবুকে লিখেছিলেন ফরহাদ মজহার। অনেকের মতে তিনি জুলাই আন্দোলনের অন্যতম ‘নেপথ্যের নায়ক’।

তার ভাষ্য ছিল, আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করতে হবে, কিন্তু সামজিকভাবে পুনর্বাসনেরও দরকার আছে।

ওই লেখায় ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটির ব্যাখ্যা করে ইনসাইড আউটের আলোচনায় তিনি বলেন, “প্রথমত, একটা গণঅভ্যুত্থান যখন ঘটে, তখন আমাদেরকে হিস্ট্রিকে নতুন করে পুনর্বিবেচনা করতে হয়। গণঅভ্যুত্থান মানে হল বিদ্যমান যে ইতিহাসের বয়ান, এটাকে প্রশ্ন করা। ফলে স্বভাবতই এই পর্যন্ত যে ইতিহাসটা লেখা হয়েছে, যেটা মূলত আওয়ামী লীগ লিখেছে। এই ইতিহাসের বয়ানটাকে প্রশ্ন করার জন্য এই নিষিদ্ধের প্রশ্নটা আসে।

“দ্বিতীয় হল যে আওয়ামী লীগ একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন। তার যে মতাদর্শের ভিত্তি এবং তার রাষ্ট্র পরিচালনার যে নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করার যে ইতিহাস রয়েছে…ফলে এটা একান্তই একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের দল যদি নিষিদ্ধ হতে পারে, মুসোলিনির দল যদি নিষিদ্ধ হতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে না কেন? এটা হচ্ছে প্রথম ব্যাপার। কিন্তু আমার কথা কিন্তু এতটুকু থামার ছিল না।”

আওয়ামী লীগকে দল আকারে নিষিদ্ধ করা হলেও দলটির কর্মী, সমর্থকদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন মজহার। তার যুক্তি– দলটি ‘ফ্যাসিস্ট’ হলেও সমর্থকরা তা নন।

“আমার যে জিনিসটা ছিল সেটা হল এই যে এর সঙ্গে (নিষিদ্ধ) আপনাকে এটা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন, নেলসন ম্যান্ডেলার যে চিন্তাটা ছিল… মানে আমাদের সমাজে যে ক্ষতগুলো তৈরি হয়েছে, কিছু ক্ষত ঐতিহাসিক। এতগুলো লোককে আপনি মারলেন, এতগুলো লোককে আপনি গুম করলেন, কোনো ন্যায়বিচার পায়নি জনগণ। এই যে সমাজে যে ক্ষতটা তৈরি হয়েছে…এই ক্ষতের ফলে বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক তারা তো আর ফ্যাসিস্ট না। দলটা ফ্যাসিস্ট। ফলে সে সমর্থকদের যে প্রত্যাশা ছিল সে মানুষগুলোকেও তো সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করতে হবে।”

নিজের চিন্তার স্পষ্ট প্রকাশ করে ফরহাদ মহজার বলেন, “দল আকারে নিষিদ্ধ করতে হবে। কথাটা খুব পরিষ্কার। কিন্তু সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের প্রয়োজন আছে। এজন্যই আপনাকে এ দুটো কাজ একসঙ্গে করতে হবে। একটা হল যে নিষিদ্ধ করা এবং পাশাপাশি সামাজিকভাবে পুনর্বাসন। রাজনৈতিক পুনর্বাসন না। এটা খুব পরিষ্কার থাকতে হবে।”

তার ভাষ্য, “ফ্যাসিস্ট কোনো মতের বা কোনো মতাদর্শের রাজনৈতিক পুনর্বাসন চলবে না। কিন্তু সমাজে যারা আছেন, যে মানুষগুলো সমাজের অন্তর্গত তাদের সামাজিক পুনর্বাসন, সামাজিক পুনঃশিক্ষা নতুন করে ইতিহাস পাঠ, নতুন করে যে বয়ান, জনগণের যে বয়ান, এটা এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া ‘পোয়েটিক জাস্টিস’
স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়াটকে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং যুগপৎ ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলে মনে করেন চিন্তক ফরহাদ মজহার।

তিনি বলেন, “এটাকে আমি ট্র্যাজেডিক মনে করি না। এটাকে বলে পোয়েটিক জাস্টিস। পোয়েটিক জাস্টিসটা হল বাংলাদেশের জনগণ শেখ মুজিবকে মেনে নিয়েছে, তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। তিনি কী জন্য নেতা ছিলেন, তিনি প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়েছিলেন। সেজন্য তাকে সত্তরে নির্বাচিত করেছিল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য। পাকিস্তানের সংবিধান মানে…সেখানে কী ছিল?

”এলএফওর অধীনে সে সংবিধান প্রণয়ন করার কথা ছিল একটা ইসলামী সংবিধান। একটা ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন করবার জন্য বাংলাদেশের জনগণ বা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছিল।”

ফরহাদ মজহারের মতে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করে শেখ মুজিবুর রহমান সেই চিন্তার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছিলেন।

তিনি বলেন, “কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ যখন হল, শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জনগণের সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের যে ঘোষণা, স্বাধীনতার যে প্রক্লেমেশন, এটাকে তিনি অস্বীকার করলেন। সম্পূর্ণ। অস্বীকার করে তিনি এমন একটা সংবিধান আরোপ করলেন কাদের দ্বারা, যারা আসলে আইনগত দিক থেকে ছিলেন পাকিস্তানি। কারণ, তারা পাকিস্তানের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত কোনো দল তারা ছিলেন না।

“ফলে বাহাত্তর সালে তাদের সংবিধান চাপিয়ে দেবার, সংবিধান প্রণয়ন করার কোনো রাজনৈতিক এবং আইনগত অধিকার ছিল না। এই সংবিধানের কারণে আমরা একটা ফ্যাশিস্ট শাসন দেখলাম দীর্ঘ এতটা বছর। তারই শাস্তি। এটাকে এজন্য বলেছি এটা পোয়েটিক জাস্টিস। যে আজকে সে বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা একটা নিষিদ্ধ দল আকারে ঘোষিত হল। এবং অন্তর্বর্তী সরকার এটা করেছে। ফলে আমি মনে করেছি তারা সঠিক কাজটা করেছেন।”

নিষিদ্ধের ফল ‘ইতিবাচক হবে’
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার যে প্রক্রিয়ায় সরকার হাঁটছে সেটি সঠিক এবং সরকার ঠিক পথেই হাঁটছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ফলাফল কী হবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ইতিবাচক হবে নিঃসন্দেহে। প্রথম কথা হচ্ছে যে এটা হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের যে ক্ষোভ, বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণদের যে দাবি, সেই দাবির প্রতিফলন। এবং সরকার শুধু এইটা দাবি করে কিন্তু থেমে থাকেনি। তারা যে ভুলটা শুরুতে করেছে সে ভুলটা হল– এই জুলাই ঘোষণা যে তারা দেননি, এখন তারা বলছেন যে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তারা নতুন ঘোষণা দেবে। যেই ঘোষণাই আসুক, একটা ঘোষণা দেবেন।”

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে হওয়া উচিত নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা একান্তই ছাত্রদের। যারা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এটা তাদের ঘোষণা হবে। যেটা আমি মনে করি, ড. ইউনুসের এই নীতিটা ভুল নীতি। তার প্রথম বুদ্ধি ছিল– ছাত্ররা তাদের ঘোষণা দেবে। সমাজে জনগণ রয়েছে। জনগণ যদি মনে করে যে ছাত্রদের ঘোষণা গ্রহণযোগ্য, তারা গ্রহণ করবে। যদি গ্রহণযোগ্য মনে না করে…জনগণকে বিচার করতে দিন।

”এখানে রাজনৈতিক দলের তো কোনো প্রশ্ন আসছে না। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো দল হিসেবে তো গণঅভ্যুত্থান করেনি। গণঅভ্যুত্থান করেছে জনগণ।”

অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব জনগণকে দিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, “কর্তা-সত্ত্বা হল জনগণ। ফলে জনগণের পক্ষে ছাত্র-তরুণরা ঘোষণা দেবে। এটা হচ্ছে নীতি। এটাকে প্রতিহত করা হয়েছে। সেদিক থেকে আমি মনে করি যে, আওয়ামী লীগকে যে নিষিদ্ধকরণ সন্ত্রাস আইনে এবং তার বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত, এটা সঠিক। এবং তার সঙ্গে তারা যেটা বলেছেন যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণা দিতে হবে। এটা আরও ভালো এবং দেখা যাচ্ছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে।

“তার সঙ্গে এখন যদি তারা যুক্ত করেন এই নেলসন ম্যান্ডেলার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন জাস্টিস কমিশনের আদলে এখানেও একটা রিকনসিলেশন কনস্ট্রাকশনের একটা পদ্ধতি, একটা প্রক্রিয়া তারা শুরু করে, তাহলে স্বভাবতই তারা সঠিক পথে আছে।”

ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন কেন জরুরি? ব্যাখ্যা দিলেন ফরহাদ মজহার

দীর্ঘ সময় ধরে দেশে গুম, খুন, হত্যার মত নানা রাষ্ট্রীয় অপরাধের ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক যে ‘ক্ষত’ তৈরি হয়েছে, তা সারাতে এবং অপরাধীদের ‘শোধরাতে’ দক্ষিণ আফ্রিকার আদলে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন জরুরি বলে মনে করছেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। কী করবে সেই কমিশন? ফরহাদ মজহার বলছেন, এই কমিশন অবশ্যই অপরাধীর বিচারের ব্যবস্থা করবে। সেই সঙ্গে অপরাধগুলো কেন ঘটেছে, কারা এর হুকুম দিয়েছে, কারা করেছে, তা খুঁজে বের করবে। যারা হুকুমের অধীন হয়ে অপরাধ করেছে, কমিশনের কাছে তারা অপরাধ স্বীকার করবে, কারণ ‘স্বীকারোক্তি ছাড়া ক্ষমা মেলে না’। এই সতান্বেষণ আর বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যদি মীমাংসা করা না হয়, ক্ষত যদি সারানো না যায়, তাহলে সমাজে বড় ধরনের ‘অস্থিতিশীলতা’ দেখা দেওয়ার শঙ্কা থেকে যাবে বলে তিনি মনে করছেন।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শনিবার বিকালে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর দ্বিতীয় খসড়ার ওপর মতবিনিময় সভা হয়।

সেখানে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করার কথা বলেন। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে প্রধান বিচারপতিসহ একটি দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন বলে অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন উপদেষ্টা।

বর্ণবাদের বিভাজন দূর করে সংহতি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৫ সালে ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করে দক্ষিণ আফ্রিকা। সত্য উদ্ঘাটন, বিচার ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে দেশটিতে ওই কমিশন করা হয়।

অপরাধীদের ‘শোধরাতেই’ কমিশন জরুরি
কেন এবং কীভাবে এ কমিশন গঠিত হবে, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলছেন, তিনি বহু আগে থেকেই এ কমিশনের কথা বলে আসছেন। “এমনকি জামায়াতের যখন বিচার হয়; আওয়ামী লীগের আমলে; সেই সময়ও আমি আওয়ামী লীগকে বলেছিলাম আপনারা এ ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন জাতীয় একটা কমিশন গঠন করুন এবং একাত্তরে অপরাধগুলো মীমাংসা করুন।”

এই চিন্তক বলেন, “এ সমাজের যে ক্ষত, সামাজিক ক্ষত, সমাজের যে রাজনৈতিক ক্ষত, সমাজের যে সাংস্কৃতিক বিভ্রম, সমাজের যে তাত্ত্বিক বিচ্যুতি, এটা যেন আমরা শোধরাতে পারি। তো আমার কথা তো তখন শোনেনি। এবারও এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রত্যেককে…ব্যক্তিগতভাবে জামায়াতে ইসলামের আমির শফিকুর রহমানকে আমি বলেছি, বিএনপিকে বলেছি, তারেককে বলেছি টেলিফোনে। আমি সকলকে বলেছি, আমাদের অবশ্যই অবিলম্বে একটা রেকনসিলিয়েশন এবং রিকনস্ট্রাকশন কাউন্সিল গড়া দরকার।”

তিনি বলেন, “আমি বারবারই এটা বলেছি, কেউ কিন্তু আমার কথা শোনেনি। গতকাল নতুন গুম আইন নিয়ে একটা আলোচনা চলেছিল, সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি তখন এ কথাটা বলেছি আবার। এবং আমি খুশি হয়েছি যে আমাদের আইন উপদেষ্টা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরহাদ ভাই, আমরা এটা ভাবছি এবং আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছি এটা আরও জানতে এবং আপনাকে আমরা জানাব এর কী অগ্রগতি হয়’।”

পারস্পরিক শত্রুতা এবং বিভাজন দূর করতে এ কমিশন গঠন জরুরি বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের বাস্তবতায় এর কী নাম দেব, তাতে কী শর্ত থাকবে, এটা আমরা নিজেরা আলোচনা করতে পারব। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসেন এবং যারা ফ্যাসিস্ট নন, তারা একটা মতাদর্শ ধারণ করেন। আমি একমত নাও হতে পারি তার সঙ্গে, ইতিহাস সম্পর্কে তার একটা পঠন থাকতে পারে, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা যেন সমাজে আলাপ-আলোচনার, তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে একটা নতুন বাংলাদেশের নতুন বয়ান তৈরি করতে পারি। একই সঙ্গে আমাদের যে পারস্পরিক শত্রুতা, যে বিভাজনগুলো ঘটছে, সেগুলো মীমাংসা করতে পারি।

“এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, যারা এই গুমের সঙ্গে জড়িত, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ে জড়িত, বিভিন্ন রকম অত্যাচার-দমনে জড়িত, তাদের বিচার তো আপনাকে করতেই হবে। এর তো কোনো বিকল্প হতে পারে না।” তবে কমিশন গঠন করা ছাড়া সেই বিচারিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

“আপনি যখন এটা বিচার করতে যাবেন, আপনি কি মনে করেন যে সমাজ তখন খুব স্থিতিশীল থাকবে? স্থিতিশীল থাকবে না। কারণ, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে অনেক শক্তিশালী ব্যক্তি জড়িত, অনেক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান জড়িত, আমার নাম বলা দরকার নাই।”

উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “ধরুন আপনি গুমের জন্য, আয়নাঘরের জন্য কারো বিচার করতে যাচ্ছেন, যখন বিচার করতে যাবেন, আপনাকে সার্ভিং জেনারেলদের বিচার করতে হবে। আপনি কি পারবেন? এটা কি সম্ভব? আপনি সার্ভিং জেনারেলদের বিচার করতে গেলে বাংলাদেশে একটা অভ্যুত্থান হয়ে যাবে। ফলে আপনি কী করবেন?”

যেভাবে কাজ করবে কমিশন
ফরহাদ মজহার বলেন, “এটা করার পদ্ধতি হচ্ছে– নাম্বার ওয়ান সেই প্রাতিষ্ঠানিক ইন্টিগ্রিটি, সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রথমত এই বিচারটা করার সুযোগ দেওয়া। প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, সমাজে একটা ট্রুথ এবং রেকনসিলিয়েশনটা থাকুক। যারা হুকুমের অধীন হয়ে অপরাধ করেছেন, তারা স্বীকার করুক।

“স্বীকারোক্তি ছাড়া তো ক্ষমা হয় নারে ভাই। আপনি যদি শেয়ার করেন, ভাই এই এই কারণে আমার এই কয়েকটা করতে বাধ্য হয়েছি। তা নাহলে তো আপনি ক্ষমা পাবেন না। কারণ, ক্ষমার তো কোনো সুযোগ নাই, অপরাধে যে কেউ করতে পারি। তওবা করলে তো আল্লাহ পর্যন্ত মাফ করে দেয়।”

এই কলামনিস্ট বলেন, “সত্যটা জানা দরকার। আমার সন্তানকে আপনি গুম করেছেন, তার লাশটা আমি খুঁজে পাইনি। আমার স্বামীকে আপনি গুম করেছেন, তার লাশ কোথায় আছে আমি জানি না। এবং যে কারণে তার যে সম্পত্তি, কারা পাবে কারা পাবে না, আদৌ তিনি বেঁচে আছেন কি বেঁচে নেই, এটা আমি জানি না। এত বড় নিষ্ঠুরতা তো আমরা টিকিয়ে রাখতে পারব না।”

তিনি বলেন, “আমি মনে করি যে সেনাবাহিনীতে যদি কোনো মানুষ এই অপরাধ করে থাকেন, তারা ভেবে দেখবেন, এত বড় একটা ক্ষত রেখে আমরা তো বাংলাদেশকে নতুন করে গঠন করতে পারব না।

“একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই ধরনের রেকনসিলিয়েশন অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন অথবা ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন, আপনি যে নামই দেন না কেনো, কিছু আসে যায় না, এর মাধ্যমে আপনি এটার মীমাংসা করেন। যদি আপনি মীমাংসা না করেন, আপনি কী করবেন? আপনি বাংলাদেশকে চরম একটা অস্থিতিশীল জায়গায় ঠেলে দেবেন। এবং একই সঙ্গে আপনি কী করবেন? আপনি সেনাবাহিনী বনাম জনগণের মধ্যে একটা মারাত্মক বিভেদ তৈরি করবেন।”

‘প্রজ্ঞার সাথে করতে হবে’
সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি হলে তা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

“ফলে যা কিছু কাজ আমরা করি না কেন, অত্যন্ত সতর্কভাবে, অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে, অত্যন্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে এগুলো ডিল করতে হবে। সে ধরনের প্রজ্ঞাবান মানুষ থাকতে হবে।”

এ প্রক্রিয়ায় কোনো আপস করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রথম কথা হল যাদেরকে গুম করা হয়েছে, যেসব পরিবারের প্রতি অত্যাচার হয়েছে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের প্রতি ইনসাফ কায়েম করতে হবে। এটা কোনো নেগোসিয়েবল না। যতক্ষণ এটার ইনসাফ না করবেন, তাদের প্রেতাত্মা আমাদের পেছনে ঘুরে ফিরবে। সেই একাত্তরের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াবে। ফলে এটা করতেই হবে। যারা বাধা দিচ্ছেন এখন, তারা কিন্তু বাধা দিয়ে মুক্তি পাবেন না। সেজন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। আশা করব আইন উপদেষ্টা অবিলম্বে এ প্রক্রিয়া শুরু করবেন।”

‘নিষেধাজ্ঞার দায় আওয়ামী লীগের’
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে শনিবার আওয়ামী লীগকে যে নিষিদ্ধ করা হল, তাতে তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের দায়ও দেখছেন ফরহাদ মজহার। নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটিও তার ভাবনা মোতাবেক হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

এই তাত্ত্বিক বলেন, “এখন পর্যন্ত সেভাবেই হয়েছে। অনেক ঘাটতি আছে, কিন্তু প্রথমত যে কথাটা বলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার– আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া পর্যন্ত; ঠিকই আছে। তারা তো একটা বিচার চাইছেন। তার আগে যদি আওয়ামী লীগ, যদি শেখ হাসিনা ভারতে বসে ক্রমাগত প্রভোক না করত, যদি আবদুল হামিদ পালিয়ে না যেতেন এবং ছাত্রলীগ, যে কোনো কথা বললে হামলা খেয়ে পড়ে ফেইসবুকে, তাদের যে হামলা ক্রমাগত চলছে…ফলে আজ বাধ্য হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এ বিচারটা সাঙ্গ হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত একটা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে এবং এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। এটার মধ্যে তো আমি তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত দেখছি না। আমার চিন্তার সঙ্গে খুবই সংগতিপূর্ণ।”

রাজনৈতিক দলের কাছে ইউনূসের ‘নতজানু’ হওয়ার যুক্তি নেই

গণঅভ্যুত্থানের ‘প্রতীক’ হওয়া সত্বেও মাঠের অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলের ‘পেছনে ছুটছেন’ বলে মনে করেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, যার যুক্তি তিনি দেখছেন না। জনগণের সামষ্টিক ‘কর্তা-সত্তার’ বাইরে মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাদাভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, এমন পর্যবেক্ষেণ এসেছে তার কাছ থেকে।

ফরহাদ মজহারের মতে, প্রধান উপদেষ্টার এমন সাধারণ মনোভাবের কারণে জনগণের মধ্যে ‘বিভক্তি’ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, “এটা তার রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার জন্য হয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক দলের কাছে তার নতজানু হওয়ার কোনো যুক্তি নাই। তিনি, তাকেতো জনগণ বসিয়েছে।”

ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতার সরকার নয়, এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন এই চিন্তক। তার মতে, এ কারণে সংস্কার কার্যক্রম ইতোমধ্যে ‘ব্যর্থ’ হয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানের ‘কর্তা’ জনগণ
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের যখন পতন ঘটে তখন মুহাম্মদ ইউনূস ফ্রান্সে। সেখান থেকে ৮ অগাস্ট দেশে ফেরার পর সেদিনই রাষ্ট্রপতির কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার শপথ নেন। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা সরকারপ্রধানের পদে বসানোর কারণে মুহাম্মদ ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের ‘প্রতীক’ হয়ে ওঠেন মন্তব্য করে কলামনিস্ট ফরহাদ মজহার বলেন, “তাকে কোনো রাজনৈতিক দল কিন্তু এই পদে বসায় নাই। এটা জনগণ, ছাত্ররা তাকে বসিয়েছে।

“এবং তারা ছাত্ররা বসিয়েছে, কীভাবে বসিয়েছে? গণঅভ্যুত্থানের প্রতীক আকারে তিনি বসেছেন। তো সেই প্রতীককে কেন রাজনৈতিক দলের পায়ে তিনি বিসর্জন দিলেন? তিনি তো নিজেই ক্ষমতাবান।”

ছাত্র-জনতার আন্দোলেনে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ বিষয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলের আকারে গণঅভ্যুত্থান হয় নাই। যারা অংশগ্রহণ করেছে তারা গণঅভ্যুত্থানের শক্তি আকারে অংশগ্রহণ করেছে। অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দলকে আলাদা ‘লেজিটিমেসি’ দিয়ে মারাত্মক ক্ষতি করেছেন।

“কারণ আপনি জনগণের যে পলিটিক্যাল এজেন্সি, তার যে রাজনৈতিক কর্তা-সত্তা, এটাকে আপনি অস্বীকার করে কতগুলো লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণির রাজনৈতিক দলের কর্তা-সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটা তো হতে পারে না। কারণ এখানে তো গণঅভ্যুত্থান করেছে জনগণ।”

সেই জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কীভাবে ছিল, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “সে জনগণের মধ্যে কি রাজনৈতিক দলের কর্মী নাই? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে।

“আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু আমি যখন অংশগ্রহণ করেছি, তা আমিতো সে আমার মতাদর্শকে বাদ দিয়ে সবার সঙ্গে সামষ্টিকভাবে একমত হয়েছি।”

গণঅভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে আনাটা ‘সঠিক’ থাকলেও ‘রাজনৈতিক ময়দানের’ অভিজ্ঞতা না থাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ‘দুর্বল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ফরহাদ মজহার।

তিনি বলেন, “আমরা চাইবার আন্তর্জাতিক যে কারণ ছিল এটা সঠিক ছিল, সন্দেহ নেই। কারণ আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক যে দ্বন্ধ, এই বিরোধগুলোর ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা রাখতে পারেন, তিনি প্রাণপণ সে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন, এটা আমি বাইরে খুব সহজে বুঝতে পারি।

“কিন্তু আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি, সেটা হল সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব দুর্বল। আমরা যারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকি, তাদের চিন্তা চেতনা, তর্ক বিতর্ক যে রাজনীতির একেবারে উত্তপ্ত জায়গাগুলো, এ গরম ময়দানগুলো সম্পর্কে তার খুব একটা ধারণা নেই। সে ধারণা না থাকার কারণে তিনি গণমানুষের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা ঘাটতি দেখছি।”

প্রধান উপদেষ্টার এভাবে রাজনৈতিক দলের কাছে যাওয়ার কারণে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে ‘বাজে কথা’ শুনতে হচ্ছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলের কাছে কবে নির্বাচন, কবে নির্বাচন, কবে নির্বাচন- এসব বাজে কথা শুনতে তিনি গেছেন। আমরা কি বলেছি তাকে এটা করতে? আমরাতো এটা বলি নাই তাকে এটা করতে।

“তার তো উচিত ছিল জনগণের কাছে যাওয়া। তিনি যখনই জনগণের কাছে দেবেন, স্বভাবতই তাদের, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা জনগণ আকারে বিভিন্ন জায়গায় থাকলে তারা যাবে, কথা শুনবে। তার সঙ্গে কথা বলে তাদের কথা প্রকাশ করবে।”

নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সুযোগ মুহাম্মদ ইউনূসই তৈরি করে দিয়েছেন, যার দরকার ছিল না বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় এই কলামনিস্ট বলেন, “কারণ এই গণঅভ্যুত্থানের কর্তা রাজনৈতিক দল নয়, জনগণ। এই শিক্ষাটুকু তার রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে, তিনি এটা ধরতে পারেন নাই। তাকে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমার কাজ। যে, এখানে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল না। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল তাদের কর্মীদের ভূমিকা ছিল, তারা জনগণ আকারে অংশগ্রহণ করেছে। সকলেই আমরা জনগণ তার মধ্যে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক দলের সুবিধা তারা নিতে থাকে। এটা তো হবে না।”

বিদেশ থেকে এনে রাষ্ট্রীয় পদে বসানো ‘মারাত্মক ভুল’
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে ‘সঠিক রাজনৈতিক পরামর্শ’ দিতে পারে এমন কেউ উপদেষ্টা পরিষদে নেই বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার। সরকারে কিংবা বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে বিদেশিদের নিয়ে আসার পক্ষে না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) যাদেরকে বিদেশ থেকে এনেছেন বিভিন্ন কমিশনে, কিংবা তারা উপদেষ্টা হিসেবে আমি এটার পক্ষে না।

“কারণটা হচ্ছে এই যে, যে তর্কটা উঠেছে তারা ব্যক্তি হিসেবে মন্দ ব্যক্তি, আমি তা বলছি না। আমি তাদের অনেককে খুবই পছন্দ করি, অনেকে আমার বন্ধুও বটে এবং তাদের আমি বন্ধু বলে আমি স্বীকার করি। কিন্তু আপনি একটা রাষ্ট্রকে ছোট করতে পারেন না।”

রাষ্ট্রকে ছোটো করা হয় কীভাবে তার ব্যাখ্যায় এ চিন্তক বলেন, “সেটি হল-যদি কেউ বিদেশি নাগরিক হয় বা দ্বৈত পাসপোর্টধারী হয়, আপনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে তাকে দিতে পারেন না, এটা গ্রহণযোগ্য না। এটা গ্রহণযোগ্য না।

“তাকে কী পারেন? আপনি তাকে পরামর্শক রাখতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি যখনই তাকে একটা রাষ্ট্রীয় পদে দিচ্ছেন, যখন তার আদেশটা বাধ্যতামূলক হয় অন্যের পালন করাটা, এটা ভুল সিদ্ধান্ত। এটা মারাত্মক ভুল।”

‘ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের নায়ক নন, ফল’
গণঅভ্যুত্থানের পর আসা মুহাম্মদ ইউনূসের জনগণের কথা শোনার কথা থাকলেও তার প্রতিফলন সেভাবে না দেখার কথা বলছেন ফরহাদ মজহার। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন দলের ঘেরাও কর্মসূচির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “তিনি কি গতকাল জনগণের কথা শোনেননি?

“কেন ছাত্রদেরকে তার যে অফিস, এটাকে ঘেরাও করতে হল। তার আগেই কি তার বুঝা উচিত ছিল না, তাদের ক্ষোভটা কোথায়? তাদের কষ্টটা কোথায়? তারাই তো তাকে এনেছে। তিনি তো গণভ্যুত্থানের নায়ক নন, তিনি গণভ্যুত্থানের ফল। এটা তো ভুলে গেলে চলবে না।”

মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ও পেছনে ‘একশ ভাগ থাকা এবং সমর্থন করার’ প্রত্যয় জানিয়ে এই চিন্তক বলেন, “কিন্তু তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া আমার কাজ। এই ভুলগুলো তাকে শোধরাতে হবে। ফলে তাকে সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক উপদেশ দেবার, রাজনৈতিক উপদেষ্টা, এটা তার দরকার।

“এ উপদেশটা তার দরকার এবং আমরা আনন্দচিত্তে তার পক্ষে এটা করব। যখনই তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হবে, অন্যায় ক্ষোভ, এটা আমরা প্রতিহত করব।”

‘আমরা তাকে ঠিক করব’
সংস্কার কার্যক্রম ইতোমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। তার মতে, সামনের ‘সংকট’ মোকাবেলার উপায় কী হবে, তা নির্ভর করবে জনগণের লড়াইয়ের উপর। এটা মুহাম্মদ ইউনূসের উপর নির্ভর করবে না।

তিনি বলেন, “ব্যর্থতো হতেই পারেন। তিনি তো কাজ করতে আসছেন। ব্যর্থ হলে কি তিনি ব্যর্থ হয়ে যাবেন? তার মানে কি ডক্টর ইউনূস খারাপ হয়ে গেল তার জন্য? তিনি কাজ করতে এসছেন, আমরা তাকে সহায়তা করছি, তাকে ঠিক করব আমরা। আমরা যেহেতু তাকে নিয়ে এসেছি, তাকে আমরা ঠিক করব।”

প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের মনোভাব ঠিক থাকলেও শুরুর দিকে অনেকে তাকে ‘ভুল পথে নিয়ে চলে গেছে’, এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ফরহাদ মজহারের বলেন, “তিনি হয়তো বুঝতে পারেন না, তো হতেই পারে। একটা রাজনৈতিক নেতা তো নন তিনি। ফলে আমাকেতো বুঝতে হবে যে, আমি কোন বাস্তবতার মধ্যে বাস করছি।”

‘সংবিধান সংস্কারের পক্ষে ছিলাম না’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শুরু থেকেই সংবিধান সংস্কারের পক্ষে না থাকার কথা বলেছেন অভ্যুত্থানের সময় আলোচনায় থাকা এই চিন্তক। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই সংবিধানের অধীনে ঢোকানোই ঠিক হয় নাই।”

সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, “এখানে আমি তাদের সঙ্গে একমতই না।

“আমি কথাটা পরিষ্কার করে বলছি। আমি বারবারই বলেছি, বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরে উচিত ছিল এই সংবিধানের অধীনে সরকারটাকে না ঢোকানো, একটা পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা।

“ফলে ডক্টর ইউনূস কিন্তু আসলে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন একজন প্রধান উপদেষ্টা বা সরকার নন। তার হাতে পূর্ণ ক্ষমতা নাই। এই পূর্ণ ক্ষমতার নাই বলে এটাকে আমি বলি ‘সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার’।”

সেনাবাহিনী সমর্থন না করলে এই সরকার একদম ‘টিকে থাকতে পারবে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আজকে আমাদের সেনাপ্রতিষ্ঠান যদি তাকে সমর্থন না করে, তাহলে এই সরকার একদম টিকে থাকতে পারবে না।

“তো এই একটা দুর্বল সরকারের পক্ষে কোনো সংস্কার করা, ইতিবাচক কোনো সংস্কার করা অসম্ভব, এটা এক নম্বর যুক্তি। দুই নম্বরটা হল এই, তিনি যাদের নিয়ে কমিশন বানিয়েছেন, এটা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া।”

কারা চাপিয়ে দিয়েছে?
জবাবে ফরহাদ মজহার বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসই চাপিয়ে দিয়েছেন উপর থেকে; বেছে বেছে নিয়েছেন। “এরা (কমিশন সদস্য) কি গণঅভ্যুত্থানে ছিলেন? এরা কি গণঅভ্যুত্থানকে প্রতিনিধিত্ব করেন? করেন কেউ? আমি দেখিনিতো আন্দোলনের সময়। তাদের কোনো বক্তব্য দেখি নাই। এরা কি করে হঠাৎ করে এলেন? অনেকে ‘ওয়ার অন টেররের’ পক্ষে বইপত্র লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে।”

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সম্পর্কে এই কলামনিস্টের পর্যবেক্ষণ হল- বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের অবস্থান জানেন না তিনি। ফরহাদ মজহার বলেন, “তার (প্রধান উপদেষ্টা) নিরাপত্তা উপদেষ্টার অবস্থানতো আমরা জানি না, বাংলাদেশের সম্পর্কে। এরাতো পরীক্ষিত নন।

“এদেরতো কোনো মতাদর্শিকভাবে আমরা চিনি না। তিনি তাদের ধরে নিয়ে এসেছেন কী করে? ধরে নিয়ে এসেছেন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে; টেকনিক্যাল এক্সপার্ট বলে কিছু নাই। এটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, ইউ নিড পলিটিক্যাল এক্সপার্টাইজ। আপনার রাজনৈতিকভাবে সচেতন, যারা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ।”

লোক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এমন ‘দুর্বলতা’ এবং জনগণকে ‘কর্তৃত্ব’ না দেওয়ার কারণে সংস্কার কার্যক্রম ব্যর্থ হবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তার (প্রধান উপদেষ্টা) এই তথাকথিত সংস্কার ব্যর্থ হবে। আরও ব্যর্থ হবার কারণটা হচ্ছে এই, তিনি জনগণকে এজেন্সি দিচ্ছেন না।

“জনগণ গণঅভ্যুত্থান করেছে, এটা তিনি এখনো স্বীকার করেননি। তিনি ধরে নিচ্ছেন, এটা রাজনৈতিক দলগুলো করেছে। ফলে তিনি আলোচনা করছেন কার সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলার সঙ্গে। তারাতো এই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তাদের কর্মীরা যুক্ত ছিল, দল আকারে নয়।”

নারী সংস্কার কমিশন খারাপ কী বলেছে, ধর্ম সংস্কার তো করতে বলেনি

নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে কেউ একমত না হতে পারেন, সুপারিশ নিয়ে তর্কও হতে পারে; কিন্তু নারীদের অপমান করার মত ‘ইসলামের নৈতিকতা বিরোধী’ কাজ কেন ধার্মভিত্তিক দলগুলো করছে, সেই প্রশ্ন রেখেছেন চিন্তক ও কলামনিস্ট ফরহাদ মজহার। তিনি বলেছেন, “নারীরা তো ধর্ম সংস্কার করতে বসেননি। আপনি তাদের… সব কথাতো শোনার দরকার নাই আপনার। আপনি বলেন এতে আমরা একমত হইনি। কিন্তু তারা কি বলবে, খুব ছোট্ট কথা তারা বলবে। তারা বলবে, পারিবারিক আইন আছে এটা থাকবে। তারা তো বলেনি পারিবারিক আইন সংস্কার করো। একবারও বলেনি।”

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা অন্তবর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন খাতে ১১টি সংস্কার কমিশন করেছে। এর মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়, সেখানে ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এরপরই নারী কমিশন ও সুপারিশ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।

ফরহাদ মজহার বলেন, “এ পর্যন্ত যতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে, অধিকাংশ কমিশনের রিপোর্টই খুব বেশি ইতিবাচক নয়। কিন্তু সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি, কোনো সমস্যা নেই। আমরা বলব- এ সমস্ত সুপারিশের মধ্যে সত্যিকারের গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট নেই। একটা মাত্র (নারী) কমিশনের রিপোর্ট ছাড়া। আরেকটি আছে শুনেছি, সেটা হচ্ছে শ্রম কমিশন। নারী কমিশনতো বিতর্ক থাকবে। নারী কমিশন যেহেতু গণঅভ্যুত্থান, জনগণের অভিপ্রায়কে রিপ্রেজেন্ট করে, ফলে বিতর্কিত হবেই।”

সংস্কার কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার- এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও এসেছে। তবে দেশের ইসলামপন্থীদের অন্যতম প্ল্যাটফরম হেফাজতে ইসলাম নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে, জামায়াতে ইসলামীও কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।

ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামি পারিবারিক আইন নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ কমিশন দিয়েছে, হেফাজতের আপত্তি মূলত সেই জায়গায়।

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নারীর ব্যক্তি অধিকারের কথা সংস্কার কমিশন তুলে ধরেছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, “সে ব্যক্তি অধিকারের বলে, সে যদি মনে করে যে তার সম্পত্তির বণ্টনটা রাষ্ট্রের আইনের দ্বারা ঠিক হবে, তবে এটা খারাপ কি কথা বলেছে? খারাপ তো কথা কিছু বলেনি। আমি যদি মনে করি যে পারিবারিক আইনের মধ্যে সম্পদ বন্টন আমার চাই না; আমি ব্যক্তি, আমি একজন নাগরিক, আমি কি চাইতে পারি না রাষ্ট্রের কাছে? এটার মধ্যে কী বিরোধ আছে? তারা কি বলেছে যে শরীয়াহ আইন বদলাও? তারা কি বলছে কোরানকে নতুন করে ইন্টারপ্রেট কর? আমি তো দেখিনি, তাদের কোনো লেখায় পড়িনি, কোথাও নেই।”

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পারিবারিক সম্পত্তিতে সমান অধিকার, অভিভাবক হিসেবে নারীর সমান অধিকারসহ বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। এছাড়া নারীদের অধিকার রক্ষায় স্বতন্ত্র স্থায়ী নারী বিষয়ক কমিশন তৈরি করা; অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ সংশোধন করে সন্তানের ওপর নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা; যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা; শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা এসব সুপারিশও রয়েছে।

যৌনকর্মীদের শ্রমিকের স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ নিয়েও অবমাননাকর ভাষায় কমিশনকে আক্রমণ করেছেন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কেউ কেউ। এমনকি হেফাজতে ইসলামের এক সমাবেশে নারী সংস্কার কমিশনকে ‘বেশ্যা কমিশনও’ বলা হয়েছে, যা নিয়ে পরে সংগঠনটি দুঃখ প্রকাশ করেছে।

সেই প্রসঙ্গ ধরে ফরহাদ মজহারের ভাষ্য, যৌনকর্মীর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর মানবিক এবং রাজনৈতিক বিষয়।

“ফিলোসফাররা বলে, বেয়ার লাইফ। বেয়ার লাইফ মানে তাদের জীবনের কোনো আইনে সুরক্ষা নেই। ফলে রাষ্ট্র তাদেরকে রক্ষা করে না নির্যাতন থেকে, বিভিন্ন রকম অত্যাচার হামলা, কোনো সুরক্ষা নেই। তার সবচেয়ে বড় সিম্বল হচ্ছে যাদেরকে বলি যৌনকর্মী।

“নারী কমিশনের রিপোর্টটা বাদ দেন, ফেলে দেন বঙ্গোপসাগরে। আপনি তাদের জন্য কী করতে চান? বলেন সে তো নাগরিক দেশের, একটা অধিকার আছে। হয় আপনি এটাকে এখান থেকে বন্ধ করে দিন, আপনি তাকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুন। আপনি তে কিছু একটা করবেন। তাহলে আইনি সংস্কারের কথা যদি ওঠে তাহলে অবশ্যই তাকে কোনো না কোনো নাগরিক অধিকার আপনাকে দিতে হবে।”

যৌনকর্মী হিসেবে কাজের জন্য যে বয়সের সার্টিফিকেট নিতে হয়, সে কথা তুলে ধরে ফরহাম মজহার বলেন, “তাহলে কেন আপনি নারী কমিশনের সমালোচনা করছেন? রাষ্ট্র ইতোমধ্যে হস্তক্ষেপ করছে (সার্টিফিকেট দিয়ে)। রাষ্ট্র যদি হস্তক্ষেপই করে থাকে তাহলে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতেই হবে। রাষ্ট্র তুমি যখন স্বীকৃতি দিচ্ছ সে যৌনকর্ম করতে পারে; রাষ্ট্র যখন সার্টিফিকেট দিচ্ছ সে যৌনকর্ম করতে পারে, তাহলে তার নাগরিক অধিকার স্বীকার করবেন না কেন।”

তিনি বলেন, “যেসব ইসলামিস্টরা সমালোচনা করছে, তাদের তো এতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোথাও মিছিল করতে দেখিনি যে ‘আমরা কোনো যৌনকর্মী চাই না’। কিন্তু ইসলামে একটা বিরাট ব্যাপার আছে। কোনো মেয়ে যদি তার পেটের তাগিদে এ ধরনের যৌনকর্মে লিপ্ত হয়, শাস্তি কার আগে হবে, সে এলাকার ইমামের। কারণ, ইসলাম তো সমাজকেন্দ্রিক।

“…তারা কেন পুনর্বাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে না? এটা তো ইসলামবিরোধী পথ। …যৌন কর্মকে বন্ধ করতে চান? তাহলে ইসলামের মানবিক দিক নিয়ে এগিয়ে আসেন। আপনি এখন কি করলেন? মেয়েদেরকে বেশ্যা বলে গালি দিলেন।”

মেয়ের ছবি ছাপিয়ে পেটানো, অপমান করার পর যখন ‘হাসিনা’ নাম দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও সমালোচনা করেন ফরহাদ মজহার।

ইসলামের নামে নারীদের অপমান করার মতো ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।

এ গবেষক বলেন, “…এগুলো চলবে না। মেয়েদের এত অপমান করছেন কেন? এটা ঘোরতর ইসলামবিরোধী, ইসলামের নীতি নৈতিকতা বিরোধী কাজ।…দেশের মানুষ কী শিখল এখানে? নারীদেরকে এভাবে অপমান করায় আমাদের মুখোজ্জ্বল হয়েছে কি? না আমরা নিচে নেমেছি? এটা তো ঠিক হয়নি। আসেন তর্ক করেন, অসুবিধা নেই।”

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

এখন লড়াই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে: ফরহাদ মজহার

আপডেট সময় : ০৮:৩০:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫

আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়াকে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ আখ্যা দিয়ে এর ফলাফল ‘ইতিবাচক’ হবে বলেই মনে করছেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তার মতে, এখন বাংলাদেশের জনগণের সামনের লড়াই ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে। জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে তাতে সব ধরনের ‘ফ্যাসিবাদী’ শক্তিকে মোকাবেলা করার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গঠনের রাজনীতি করার তাগিদ এসেছে তার তরফে। তার মতে, ফ্যাসিবাদী কোনো মতের বা কোনো মতাদর্শের রাজনৈতিক পুনর্বাসন চলবে না, যা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। তবে দলটির কর্মী-সমর্থকদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করতে হবে।

রোববার (১১ মে ২০২৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন ফরহাদ মজহার। অনেকের মতে তিনি জুলাই গণ অভ্যুত্থানের নেপথ্যের অন্যতম নায়ক। বাংলাদেশে নানা ধরনের ‘ফ্যাসিস্ট’ প্রবণতা বিদ্যমান থাকা এবং তা থেকে মুক্তির উপায় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদীদের দুটো চরিত্র আছে। এটা তো একই মুদ্রার দুই পিঠ। একটা হল– তার সেকুলার চরিত্র, আরেকটা হচ্ছে তার ধর্মীয় জাতিবাদী চরিত্র। দুটোই জাতিবাদের দুটো পিঠ। ওটা হল সেকুলার জাতিবাদ। এটা হল ধর্মীয় জাতিবাদ। “ফলে বাংলাদেশের জনগণের সামনে দুটো শত্রু। এই দুটো শত্রুর বিরুদ্ধে তাকে লড়াই করতে। আমরা ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুরু করেছি। জনগণ এখন বুঝতেছে ধর্মীয় জাতিবাদ কী ভয়ংকর। এটার বিরুদ্ধে লড়াই হবে।”

জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবির মুখে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম শনিবার রাতে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সম্পর্কিত প্রজ্ঞাপন সোমবার জারি হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। একই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিকে জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনার সিদ্ধান্তও হয়েছে। ‘ইনসাইড আউটের’ আলোচনায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, সমকালীন রাজনীতি, রাজনীতির প্রতিবন্ধকতা, ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরেন ফরহাদ মজহার। গ্রন্থনা করেছেন মাছুম কামাল ও জি এম মোস্তাফিজুল আলম।

ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কেন এবং কীভাবে লড়াই
ফরহাদ মজহার যে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেছেন, সেটি কার বিরুদ্ধে, কীভাবে হবে সেটির ব্যাখ্যাও তিনি করেছেন। এর আগে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ একাই শুধু ‘ফ্যাসিস্ট’ নয়, বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ধর্মীয় নানান ‘ফ্যাসিস্ট’ প্রবণতা রয়েছে।

তারা কারা সেই ব্যাখায় ইনসাইড আউটে তিনি বলেন, “প্রথমত তিনটা ভাগ করবেন আপনি।

”আমাদের লড়তে হচ্ছে প্রথমত ফ্যাসিবাদ…এটা ইডিওলজি, এরপর হল ‘ফ্যাসিস্ট শক্তি’। এটা কিন্তু ইডিওলজি না, এটা অর্গানাইজড। ইডিওলজি যখন একটা অর্গানাইজড সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তি আকারে হাজির থাকে, এটা হল একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি। আর তিন নম্বর হল–‘ফ্যাসিস্ট সংবিধান’।”

‘সেক্যুলার ফ্যাসিবাদ যেটা বাঙালি জাতিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের নামে তৈরি হয়েছিল’ সেটা এরই মধ্যে মোকাবেলা করা হয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।

চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, “সেকুলার ফ্যাসিবাদ আমরা মোকাবেলা করেছি। কিন্তু একই সঙ্গে আরেকটা– ধর্মীয় জাতিবাদ। ধর্মের নামে মনে করে যে, তার অবস্থানই সহীহ। আর সকলে তার শত্রু এবং তাদের বিরুদ্ধে তারা একটা সংগ্রাম করে। যে শক্তিটা মাজার ভাঙে ইসলামের নামে, যে শক্তিটা ইসলামের নামে মেয়েকে অপমান করে, যে ফ্যাসিবাদ এই ইসলামের নামে তার যে মহিমা, তার যে ফিলোসফিক্যাল শক্তি, সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এটাকে একটা পরকালবাদী ধর্ম আকারে হাজির করে।”

সমাজের যেকোনো প্রকার ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রাকে যে বাধা দেয় ক্রমাগত, এটা কি ফ্যাসিবাদ নয়– সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি।

ধর্মীয় জাতিবাদেরও পতন হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের যদি পতন ঘটে থাকে তাহলে ধর্মীয় জাতিবাদেরও পতন ঘটবে। কারণ ধর্মীয় জাতিবাদের কোনো প্রকার স্থান বিশ্ব ইতিহাসে হবে না। আর বাংলাদেশে ইতিহাসে এটা কখনো হবে না। কিন্তু ইসলামের হবে। ইসলাম ভিন্ন জিনিস। ইসলামী যারা, যদি কেউ সত্যিকারের মোমিন বা মুসলমান হয়ে থাকে তার প্রথম শিক্ষা ইসলাম জাতিবাদ বিরোধী। ইসলাম কোনো প্রকার জাতিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না।”

আর কাউকে নিষিদ্ধের দাবি উঠবে?
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে ঘিরে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান; পতন ঘটে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলের।

আন্দোলনের মধ্যেই আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিবাদ’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগের দাবি জোরালো হতে থাকে। সরকার পতনের পর আন্দোলন দমাতে শক্তিপ্রয়োগ ও ’গণহত্যার’ অভিযোগ তুলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারাসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও দলের বিচারের দাবি আসছে।

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অন্যান্য ‘ফ্যাসিবাদের’ কথাও বলে আসছে ফরহাদ মজহার। সেক্ষেত্রে অন্য কোনো দলকেও নিষিদ্ধের দাবি আসবে কি না রোববার ‘ইনসাইড আউট’ অনুষ্ঠানের আলোচনায় এই প্রশ্ন ছিল তার কাছে।

জবাবে তিনি বলেন, “সেটা নির্ভর করছে তাদের তৎপরতা দেখে। যেমন ধরেন, আজকে যে এক ধরনের ইসলামপন্থিকে দেখলাম, যারা শাপলা চত্বরটা বানাতে দেয়নি আমাদের ধর্মের নামে; যে মিনার তৈরি করাটা খারাপ। স্মৃতিটাকে তারা ধ্বংস করেছে। শেখ হাসিনা যেভাবে এই তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রদের হত্যা করেছে, যে রক্তপাত ঘটিয়েছে, এটাকে ধামাচাপার দেওয়ার জন্য যারা শেখ হাসিনাকে কওমি জননী বলেছে এবং কওমি জননী বলার মধ্য দিয়ে যারা শাপলা চত্বরকে একটা ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ বানাতে যারা বাধা দিয়েছে, এরা তো স্বভাবতই বাংলাদেশের মুসলমানদের দুষমন।”

এক যুগ আগে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডেকেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। শাহবাগের আন্দোলনের বিপরীতে ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে সেখানে তারা অবস্থান নিলে তাদের হঠাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বল প্রয়োগ করলে সেখানে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে।

তখনকার সেই প্রেক্ষাপটের কথা তুলে ধরে ধর্মীয় গোষ্ঠী শাপলা ছেড়ে শাহবাগ দখল করেছে বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার। বলেন, “এরা এখন কী করছে? এরা এখন শাহবাগ দখল করতে আসছে। শাহবাগ তো তোমার জায়গা না। তোমার জায়গা ছিল শাপলা। যেখানে শাপলা ছিল সিম্বল। শাপলা ছিল আমাদের লড়াইয়ের জায়গা। শাপলা ছিল আমাদের স্মৃতিচিহ্ন। সে স্মৃতিচিহ্নকে তোমরা ধ্বংস করেছ। ধ্বংস করে এসে এখন তোমরা শাহবাগকে অপবিত্র করতে এসেছ।

”এটা তো চলবে না। এভাবে তো রাজনীতি চলবে না। এই হচ্ছে ফ্যাসিজমের চরিত্র। এই ফ্যাসিজমকে ধরিয়ে দেওয়াটা এটা আমাদের এখনকার কাজ।”

এই গোষ্ঠীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, “যারা মাজার ভেঙেছে, যারা মাজার ভাঙে এবং যারা মেয়েদেরকে অপমান করে, মেয়েদেরকে কোনো প্রকার সম্মান দেয় না, মেয়েদেরকে তাদের দাসি-বাদী মনে করে। আপনি কি মনে করে বাংলাদেশের জনগণ গণঅভ্যুত্থানের পরে এদেরকে সহ্য করবে? অবশ্যই সহ্য করবে না।

”ফলে এইজন্য আমরা মনে করি যে, সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে এবং মোকাবেলা করার মধ্য দিয়ে একটা নতুন বাংলাদেশ গঠন করবার রাজনীতি আমাদের করতে যাবে।”

‘ধর্মীয় জাতিবাদীরা আওয়ামী লীগেরই দোসর’
ফরহাদ মজহার মনে করেন, যারা ইসলাম ধর্মের হয়ে নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা দেয়, মাজার ভাঙে, তারা আওয়ামী লীগেরই দোসর। তিনি বলেন, “যারাই মুসলিম জাতিবাদের নামে, ইসলামী জাতিবাদের নামে, ধর্মীয় জাতিবাদের নামে রাজনীতি করতে চাইছে, তারা আওয়ামী লীগেরই দোসর। দেখবেন তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা আনার জন্য নানা রকম তৎপরতা এখন বাংলাদেশে শুরু করেছে। ফলে এখনকার লড়াই একান্ত ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ইসলামের মহিমা কায়েম করার লড়াই।”

বাঙালি মানেই মুসলমান বাঙালিই বোঝায় বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। বলেন, “বাঙালি মানে কিন্তু কলকাতার বাঙালি বোঝায় না। আমরা যুদ্ধ করে বাঙালি হয়েছি। ফলে বাঙালি বলতে সবসময় মুসলমান বাঙালিই বোঝায়।

”সেই দিক থেকে ইসলামের মহিমা যখন আমরা আত্মস্থ করব বাঙালি হিসেবে…আমরা তো আরব না, আমরা তো ইরানি না, আমরা তুরানি না, ফলে আমরা আরব হিসেবে নয়, বাংলাভাষী বাংলা সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হিসেবে যখন বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির মধ্যেও আমরা ইসলামের মহিমা কায়েম করব, এটাই হবে বাংলাদেশের জনগণের সামনে এগিয়ে যাবার আপনার অগ্রযাত্রা। এটা আমরা করব। রাজনৈতিক নয়, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে হবে সামাজিকভাবে’

গণ অভ্যুত্থানে দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ফেইসবুকে লিখেছিলেন ফরহাদ মজহার। অনেকের মতে তিনি জুলাই আন্দোলনের অন্যতম ‘নেপথ্যের নায়ক’।

তার ভাষ্য ছিল, আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করতে হবে, কিন্তু সামজিকভাবে পুনর্বাসনেরও দরকার আছে।

ওই লেখায় ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটির ব্যাখ্যা করে ইনসাইড আউটের আলোচনায় তিনি বলেন, “প্রথমত, একটা গণঅভ্যুত্থান যখন ঘটে, তখন আমাদেরকে হিস্ট্রিকে নতুন করে পুনর্বিবেচনা করতে হয়। গণঅভ্যুত্থান মানে হল বিদ্যমান যে ইতিহাসের বয়ান, এটাকে প্রশ্ন করা। ফলে স্বভাবতই এই পর্যন্ত যে ইতিহাসটা লেখা হয়েছে, যেটা মূলত আওয়ামী লীগ লিখেছে। এই ইতিহাসের বয়ানটাকে প্রশ্ন করার জন্য এই নিষিদ্ধের প্রশ্নটা আসে।

“দ্বিতীয় হল যে আওয়ামী লীগ একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন। তার যে মতাদর্শের ভিত্তি এবং তার রাষ্ট্র পরিচালনার যে নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করার যে ইতিহাস রয়েছে…ফলে এটা একান্তই একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের দল যদি নিষিদ্ধ হতে পারে, মুসোলিনির দল যদি নিষিদ্ধ হতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে না কেন? এটা হচ্ছে প্রথম ব্যাপার। কিন্তু আমার কথা কিন্তু এতটুকু থামার ছিল না।”

আওয়ামী লীগকে দল আকারে নিষিদ্ধ করা হলেও দলটির কর্মী, সমর্থকদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন মজহার। তার যুক্তি– দলটি ‘ফ্যাসিস্ট’ হলেও সমর্থকরা তা নন।

“আমার যে জিনিসটা ছিল সেটা হল এই যে এর সঙ্গে (নিষিদ্ধ) আপনাকে এটা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন, নেলসন ম্যান্ডেলার যে চিন্তাটা ছিল… মানে আমাদের সমাজে যে ক্ষতগুলো তৈরি হয়েছে, কিছু ক্ষত ঐতিহাসিক। এতগুলো লোককে আপনি মারলেন, এতগুলো লোককে আপনি গুম করলেন, কোনো ন্যায়বিচার পায়নি জনগণ। এই যে সমাজে যে ক্ষতটা তৈরি হয়েছে…এই ক্ষতের ফলে বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক তারা তো আর ফ্যাসিস্ট না। দলটা ফ্যাসিস্ট। ফলে সে সমর্থকদের যে প্রত্যাশা ছিল সে মানুষগুলোকেও তো সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করতে হবে।”

নিজের চিন্তার স্পষ্ট প্রকাশ করে ফরহাদ মহজার বলেন, “দল আকারে নিষিদ্ধ করতে হবে। কথাটা খুব পরিষ্কার। কিন্তু সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের প্রয়োজন আছে। এজন্যই আপনাকে এ দুটো কাজ একসঙ্গে করতে হবে। একটা হল যে নিষিদ্ধ করা এবং পাশাপাশি সামাজিকভাবে পুনর্বাসন। রাজনৈতিক পুনর্বাসন না। এটা খুব পরিষ্কার থাকতে হবে।”

তার ভাষ্য, “ফ্যাসিস্ট কোনো মতের বা কোনো মতাদর্শের রাজনৈতিক পুনর্বাসন চলবে না। কিন্তু সমাজে যারা আছেন, যে মানুষগুলো সমাজের অন্তর্গত তাদের সামাজিক পুনর্বাসন, সামাজিক পুনঃশিক্ষা নতুন করে ইতিহাস পাঠ, নতুন করে যে বয়ান, জনগণের যে বয়ান, এটা এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া ‘পোয়েটিক জাস্টিস’
স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়াটকে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং যুগপৎ ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলে মনে করেন চিন্তক ফরহাদ মজহার।

তিনি বলেন, “এটাকে আমি ট্র্যাজেডিক মনে করি না। এটাকে বলে পোয়েটিক জাস্টিস। পোয়েটিক জাস্টিসটা হল বাংলাদেশের জনগণ শেখ মুজিবকে মেনে নিয়েছে, তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। তিনি কী জন্য নেতা ছিলেন, তিনি প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়েছিলেন। সেজন্য তাকে সত্তরে নির্বাচিত করেছিল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য। পাকিস্তানের সংবিধান মানে…সেখানে কী ছিল?

”এলএফওর অধীনে সে সংবিধান প্রণয়ন করার কথা ছিল একটা ইসলামী সংবিধান। একটা ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন করবার জন্য বাংলাদেশের জনগণ বা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছিল।”

ফরহাদ মজহারের মতে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করে শেখ মুজিবুর রহমান সেই চিন্তার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছিলেন।

তিনি বলেন, “কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ যখন হল, শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জনগণের সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের যে ঘোষণা, স্বাধীনতার যে প্রক্লেমেশন, এটাকে তিনি অস্বীকার করলেন। সম্পূর্ণ। অস্বীকার করে তিনি এমন একটা সংবিধান আরোপ করলেন কাদের দ্বারা, যারা আসলে আইনগত দিক থেকে ছিলেন পাকিস্তানি। কারণ, তারা পাকিস্তানের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত কোনো দল তারা ছিলেন না।

“ফলে বাহাত্তর সালে তাদের সংবিধান চাপিয়ে দেবার, সংবিধান প্রণয়ন করার কোনো রাজনৈতিক এবং আইনগত অধিকার ছিল না। এই সংবিধানের কারণে আমরা একটা ফ্যাশিস্ট শাসন দেখলাম দীর্ঘ এতটা বছর। তারই শাস্তি। এটাকে এজন্য বলেছি এটা পোয়েটিক জাস্টিস। যে আজকে সে বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা একটা নিষিদ্ধ দল আকারে ঘোষিত হল। এবং অন্তর্বর্তী সরকার এটা করেছে। ফলে আমি মনে করেছি তারা সঠিক কাজটা করেছেন।”

নিষিদ্ধের ফল ‘ইতিবাচক হবে’
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার যে প্রক্রিয়ায় সরকার হাঁটছে সেটি সঠিক এবং সরকার ঠিক পথেই হাঁটছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ফলাফল কী হবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ইতিবাচক হবে নিঃসন্দেহে। প্রথম কথা হচ্ছে যে এটা হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের যে ক্ষোভ, বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণদের যে দাবি, সেই দাবির প্রতিফলন। এবং সরকার শুধু এইটা দাবি করে কিন্তু থেমে থাকেনি। তারা যে ভুলটা শুরুতে করেছে সে ভুলটা হল– এই জুলাই ঘোষণা যে তারা দেননি, এখন তারা বলছেন যে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তারা নতুন ঘোষণা দেবে। যেই ঘোষণাই আসুক, একটা ঘোষণা দেবেন।”

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে হওয়া উচিত নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা একান্তই ছাত্রদের। যারা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এটা তাদের ঘোষণা হবে। যেটা আমি মনে করি, ড. ইউনুসের এই নীতিটা ভুল নীতি। তার প্রথম বুদ্ধি ছিল– ছাত্ররা তাদের ঘোষণা দেবে। সমাজে জনগণ রয়েছে। জনগণ যদি মনে করে যে ছাত্রদের ঘোষণা গ্রহণযোগ্য, তারা গ্রহণ করবে। যদি গ্রহণযোগ্য মনে না করে…জনগণকে বিচার করতে দিন।

”এখানে রাজনৈতিক দলের তো কোনো প্রশ্ন আসছে না। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো দল হিসেবে তো গণঅভ্যুত্থান করেনি। গণঅভ্যুত্থান করেছে জনগণ।”

অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব জনগণকে দিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, “কর্তা-সত্ত্বা হল জনগণ। ফলে জনগণের পক্ষে ছাত্র-তরুণরা ঘোষণা দেবে। এটা হচ্ছে নীতি। এটাকে প্রতিহত করা হয়েছে। সেদিক থেকে আমি মনে করি যে, আওয়ামী লীগকে যে নিষিদ্ধকরণ সন্ত্রাস আইনে এবং তার বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত, এটা সঠিক। এবং তার সঙ্গে তারা যেটা বলেছেন যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণা দিতে হবে। এটা আরও ভালো এবং দেখা যাচ্ছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে।

“তার সঙ্গে এখন যদি তারা যুক্ত করেন এই নেলসন ম্যান্ডেলার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন জাস্টিস কমিশনের আদলে এখানেও একটা রিকনসিলেশন কনস্ট্রাকশনের একটা পদ্ধতি, একটা প্রক্রিয়া তারা শুরু করে, তাহলে স্বভাবতই তারা সঠিক পথে আছে।”

ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন কেন জরুরি? ব্যাখ্যা দিলেন ফরহাদ মজহার

দীর্ঘ সময় ধরে দেশে গুম, খুন, হত্যার মত নানা রাষ্ট্রীয় অপরাধের ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক যে ‘ক্ষত’ তৈরি হয়েছে, তা সারাতে এবং অপরাধীদের ‘শোধরাতে’ দক্ষিণ আফ্রিকার আদলে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন জরুরি বলে মনে করছেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। কী করবে সেই কমিশন? ফরহাদ মজহার বলছেন, এই কমিশন অবশ্যই অপরাধীর বিচারের ব্যবস্থা করবে। সেই সঙ্গে অপরাধগুলো কেন ঘটেছে, কারা এর হুকুম দিয়েছে, কারা করেছে, তা খুঁজে বের করবে। যারা হুকুমের অধীন হয়ে অপরাধ করেছে, কমিশনের কাছে তারা অপরাধ স্বীকার করবে, কারণ ‘স্বীকারোক্তি ছাড়া ক্ষমা মেলে না’। এই সতান্বেষণ আর বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যদি মীমাংসা করা না হয়, ক্ষত যদি সারানো না যায়, তাহলে সমাজে বড় ধরনের ‘অস্থিতিশীলতা’ দেখা দেওয়ার শঙ্কা থেকে যাবে বলে তিনি মনে করছেন।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শনিবার বিকালে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর দ্বিতীয় খসড়ার ওপর মতবিনিময় সভা হয়।

সেখানে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করার কথা বলেন। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে প্রধান বিচারপতিসহ একটি দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন বলে অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন উপদেষ্টা।

বর্ণবাদের বিভাজন দূর করে সংহতি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৫ সালে ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করে দক্ষিণ আফ্রিকা। সত্য উদ্ঘাটন, বিচার ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে দেশটিতে ওই কমিশন করা হয়।

অপরাধীদের ‘শোধরাতেই’ কমিশন জরুরি
কেন এবং কীভাবে এ কমিশন গঠিত হবে, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলছেন, তিনি বহু আগে থেকেই এ কমিশনের কথা বলে আসছেন। “এমনকি জামায়াতের যখন বিচার হয়; আওয়ামী লীগের আমলে; সেই সময়ও আমি আওয়ামী লীগকে বলেছিলাম আপনারা এ ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন জাতীয় একটা কমিশন গঠন করুন এবং একাত্তরে অপরাধগুলো মীমাংসা করুন।”

এই চিন্তক বলেন, “এ সমাজের যে ক্ষত, সামাজিক ক্ষত, সমাজের যে রাজনৈতিক ক্ষত, সমাজের যে সাংস্কৃতিক বিভ্রম, সমাজের যে তাত্ত্বিক বিচ্যুতি, এটা যেন আমরা শোধরাতে পারি। তো আমার কথা তো তখন শোনেনি। এবারও এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রত্যেককে…ব্যক্তিগতভাবে জামায়াতে ইসলামের আমির শফিকুর রহমানকে আমি বলেছি, বিএনপিকে বলেছি, তারেককে বলেছি টেলিফোনে। আমি সকলকে বলেছি, আমাদের অবশ্যই অবিলম্বে একটা রেকনসিলিয়েশন এবং রিকনস্ট্রাকশন কাউন্সিল গড়া দরকার।”

তিনি বলেন, “আমি বারবারই এটা বলেছি, কেউ কিন্তু আমার কথা শোনেনি। গতকাল নতুন গুম আইন নিয়ে একটা আলোচনা চলেছিল, সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি তখন এ কথাটা বলেছি আবার। এবং আমি খুশি হয়েছি যে আমাদের আইন উপদেষ্টা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরহাদ ভাই, আমরা এটা ভাবছি এবং আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছি এটা আরও জানতে এবং আপনাকে আমরা জানাব এর কী অগ্রগতি হয়’।”

পারস্পরিক শত্রুতা এবং বিভাজন দূর করতে এ কমিশন গঠন জরুরি বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের বাস্তবতায় এর কী নাম দেব, তাতে কী শর্ত থাকবে, এটা আমরা নিজেরা আলোচনা করতে পারব। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসেন এবং যারা ফ্যাসিস্ট নন, তারা একটা মতাদর্শ ধারণ করেন। আমি একমত নাও হতে পারি তার সঙ্গে, ইতিহাস সম্পর্কে তার একটা পঠন থাকতে পারে, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা যেন সমাজে আলাপ-আলোচনার, তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে একটা নতুন বাংলাদেশের নতুন বয়ান তৈরি করতে পারি। একই সঙ্গে আমাদের যে পারস্পরিক শত্রুতা, যে বিভাজনগুলো ঘটছে, সেগুলো মীমাংসা করতে পারি।

“এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, যারা এই গুমের সঙ্গে জড়িত, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ে জড়িত, বিভিন্ন রকম অত্যাচার-দমনে জড়িত, তাদের বিচার তো আপনাকে করতেই হবে। এর তো কোনো বিকল্প হতে পারে না।” তবে কমিশন গঠন করা ছাড়া সেই বিচারিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

“আপনি যখন এটা বিচার করতে যাবেন, আপনি কি মনে করেন যে সমাজ তখন খুব স্থিতিশীল থাকবে? স্থিতিশীল থাকবে না। কারণ, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে অনেক শক্তিশালী ব্যক্তি জড়িত, অনেক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান জড়িত, আমার নাম বলা দরকার নাই।”

উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “ধরুন আপনি গুমের জন্য, আয়নাঘরের জন্য কারো বিচার করতে যাচ্ছেন, যখন বিচার করতে যাবেন, আপনাকে সার্ভিং জেনারেলদের বিচার করতে হবে। আপনি কি পারবেন? এটা কি সম্ভব? আপনি সার্ভিং জেনারেলদের বিচার করতে গেলে বাংলাদেশে একটা অভ্যুত্থান হয়ে যাবে। ফলে আপনি কী করবেন?”

যেভাবে কাজ করবে কমিশন
ফরহাদ মজহার বলেন, “এটা করার পদ্ধতি হচ্ছে– নাম্বার ওয়ান সেই প্রাতিষ্ঠানিক ইন্টিগ্রিটি, সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রথমত এই বিচারটা করার সুযোগ দেওয়া। প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, সমাজে একটা ট্রুথ এবং রেকনসিলিয়েশনটা থাকুক। যারা হুকুমের অধীন হয়ে অপরাধ করেছেন, তারা স্বীকার করুক।

“স্বীকারোক্তি ছাড়া তো ক্ষমা হয় নারে ভাই। আপনি যদি শেয়ার করেন, ভাই এই এই কারণে আমার এই কয়েকটা করতে বাধ্য হয়েছি। তা নাহলে তো আপনি ক্ষমা পাবেন না। কারণ, ক্ষমার তো কোনো সুযোগ নাই, অপরাধে যে কেউ করতে পারি। তওবা করলে তো আল্লাহ পর্যন্ত মাফ করে দেয়।”

এই কলামনিস্ট বলেন, “সত্যটা জানা দরকার। আমার সন্তানকে আপনি গুম করেছেন, তার লাশটা আমি খুঁজে পাইনি। আমার স্বামীকে আপনি গুম করেছেন, তার লাশ কোথায় আছে আমি জানি না। এবং যে কারণে তার যে সম্পত্তি, কারা পাবে কারা পাবে না, আদৌ তিনি বেঁচে আছেন কি বেঁচে নেই, এটা আমি জানি না। এত বড় নিষ্ঠুরতা তো আমরা টিকিয়ে রাখতে পারব না।”

তিনি বলেন, “আমি মনে করি যে সেনাবাহিনীতে যদি কোনো মানুষ এই অপরাধ করে থাকেন, তারা ভেবে দেখবেন, এত বড় একটা ক্ষত রেখে আমরা তো বাংলাদেশকে নতুন করে গঠন করতে পারব না।

“একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই ধরনের রেকনসিলিয়েশন অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন অথবা ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন, আপনি যে নামই দেন না কেনো, কিছু আসে যায় না, এর মাধ্যমে আপনি এটার মীমাংসা করেন। যদি আপনি মীমাংসা না করেন, আপনি কী করবেন? আপনি বাংলাদেশকে চরম একটা অস্থিতিশীল জায়গায় ঠেলে দেবেন। এবং একই সঙ্গে আপনি কী করবেন? আপনি সেনাবাহিনী বনাম জনগণের মধ্যে একটা মারাত্মক বিভেদ তৈরি করবেন।”

‘প্রজ্ঞার সাথে করতে হবে’
সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি হলে তা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

“ফলে যা কিছু কাজ আমরা করি না কেন, অত্যন্ত সতর্কভাবে, অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে, অত্যন্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে এগুলো ডিল করতে হবে। সে ধরনের প্রজ্ঞাবান মানুষ থাকতে হবে।”

এ প্রক্রিয়ায় কোনো আপস করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রথম কথা হল যাদেরকে গুম করা হয়েছে, যেসব পরিবারের প্রতি অত্যাচার হয়েছে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের প্রতি ইনসাফ কায়েম করতে হবে। এটা কোনো নেগোসিয়েবল না। যতক্ষণ এটার ইনসাফ না করবেন, তাদের প্রেতাত্মা আমাদের পেছনে ঘুরে ফিরবে। সেই একাত্তরের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াবে। ফলে এটা করতেই হবে। যারা বাধা দিচ্ছেন এখন, তারা কিন্তু বাধা দিয়ে মুক্তি পাবেন না। সেজন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। আশা করব আইন উপদেষ্টা অবিলম্বে এ প্রক্রিয়া শুরু করবেন।”

‘নিষেধাজ্ঞার দায় আওয়ামী লীগের’
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে শনিবার আওয়ামী লীগকে যে নিষিদ্ধ করা হল, তাতে তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের দায়ও দেখছেন ফরহাদ মজহার। নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটিও তার ভাবনা মোতাবেক হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

এই তাত্ত্বিক বলেন, “এখন পর্যন্ত সেভাবেই হয়েছে। অনেক ঘাটতি আছে, কিন্তু প্রথমত যে কথাটা বলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার– আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া পর্যন্ত; ঠিকই আছে। তারা তো একটা বিচার চাইছেন। তার আগে যদি আওয়ামী লীগ, যদি শেখ হাসিনা ভারতে বসে ক্রমাগত প্রভোক না করত, যদি আবদুল হামিদ পালিয়ে না যেতেন এবং ছাত্রলীগ, যে কোনো কথা বললে হামলা খেয়ে পড়ে ফেইসবুকে, তাদের যে হামলা ক্রমাগত চলছে…ফলে আজ বাধ্য হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এ বিচারটা সাঙ্গ হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত একটা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে এবং এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। এটার মধ্যে তো আমি তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত দেখছি না। আমার চিন্তার সঙ্গে খুবই সংগতিপূর্ণ।”

রাজনৈতিক দলের কাছে ইউনূসের ‘নতজানু’ হওয়ার যুক্তি নেই

গণঅভ্যুত্থানের ‘প্রতীক’ হওয়া সত্বেও মাঠের অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলের ‘পেছনে ছুটছেন’ বলে মনে করেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, যার যুক্তি তিনি দেখছেন না। জনগণের সামষ্টিক ‘কর্তা-সত্তার’ বাইরে মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাদাভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, এমন পর্যবেক্ষেণ এসেছে তার কাছ থেকে।

ফরহাদ মজহারের মতে, প্রধান উপদেষ্টার এমন সাধারণ মনোভাবের কারণে জনগণের মধ্যে ‘বিভক্তি’ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, “এটা তার রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার জন্য হয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক দলের কাছে তার নতজানু হওয়ার কোনো যুক্তি নাই। তিনি, তাকেতো জনগণ বসিয়েছে।”

ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতার সরকার নয়, এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন এই চিন্তক। তার মতে, এ কারণে সংস্কার কার্যক্রম ইতোমধ্যে ‘ব্যর্থ’ হয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানের ‘কর্তা’ জনগণ
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের যখন পতন ঘটে তখন মুহাম্মদ ইউনূস ফ্রান্সে। সেখান থেকে ৮ অগাস্ট দেশে ফেরার পর সেদিনই রাষ্ট্রপতির কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার শপথ নেন। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা সরকারপ্রধানের পদে বসানোর কারণে মুহাম্মদ ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের ‘প্রতীক’ হয়ে ওঠেন মন্তব্য করে কলামনিস্ট ফরহাদ মজহার বলেন, “তাকে কোনো রাজনৈতিক দল কিন্তু এই পদে বসায় নাই। এটা জনগণ, ছাত্ররা তাকে বসিয়েছে।

“এবং তারা ছাত্ররা বসিয়েছে, কীভাবে বসিয়েছে? গণঅভ্যুত্থানের প্রতীক আকারে তিনি বসেছেন। তো সেই প্রতীককে কেন রাজনৈতিক দলের পায়ে তিনি বিসর্জন দিলেন? তিনি তো নিজেই ক্ষমতাবান।”

ছাত্র-জনতার আন্দোলেনে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ বিষয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলের আকারে গণঅভ্যুত্থান হয় নাই। যারা অংশগ্রহণ করেছে তারা গণঅভ্যুত্থানের শক্তি আকারে অংশগ্রহণ করেছে। অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দলকে আলাদা ‘লেজিটিমেসি’ দিয়ে মারাত্মক ক্ষতি করেছেন।

“কারণ আপনি জনগণের যে পলিটিক্যাল এজেন্সি, তার যে রাজনৈতিক কর্তা-সত্তা, এটাকে আপনি অস্বীকার করে কতগুলো লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণির রাজনৈতিক দলের কর্তা-সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটা তো হতে পারে না। কারণ এখানে তো গণঅভ্যুত্থান করেছে জনগণ।”

সেই জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কীভাবে ছিল, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “সে জনগণের মধ্যে কি রাজনৈতিক দলের কর্মী নাই? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে।

“আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু আমি যখন অংশগ্রহণ করেছি, তা আমিতো সে আমার মতাদর্শকে বাদ দিয়ে সবার সঙ্গে সামষ্টিকভাবে একমত হয়েছি।”

গণঅভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে আনাটা ‘সঠিক’ থাকলেও ‘রাজনৈতিক ময়দানের’ অভিজ্ঞতা না থাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ‘দুর্বল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ফরহাদ মজহার।

তিনি বলেন, “আমরা চাইবার আন্তর্জাতিক যে কারণ ছিল এটা সঠিক ছিল, সন্দেহ নেই। কারণ আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক যে দ্বন্ধ, এই বিরোধগুলোর ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা রাখতে পারেন, তিনি প্রাণপণ সে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন, এটা আমি বাইরে খুব সহজে বুঝতে পারি।

“কিন্তু আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি, সেটা হল সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব দুর্বল। আমরা যারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকি, তাদের চিন্তা চেতনা, তর্ক বিতর্ক যে রাজনীতির একেবারে উত্তপ্ত জায়গাগুলো, এ গরম ময়দানগুলো সম্পর্কে তার খুব একটা ধারণা নেই। সে ধারণা না থাকার কারণে তিনি গণমানুষের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা ঘাটতি দেখছি।”

প্রধান উপদেষ্টার এভাবে রাজনৈতিক দলের কাছে যাওয়ার কারণে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে ‘বাজে কথা’ শুনতে হচ্ছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলের কাছে কবে নির্বাচন, কবে নির্বাচন, কবে নির্বাচন- এসব বাজে কথা শুনতে তিনি গেছেন। আমরা কি বলেছি তাকে এটা করতে? আমরাতো এটা বলি নাই তাকে এটা করতে।

“তার তো উচিত ছিল জনগণের কাছে যাওয়া। তিনি যখনই জনগণের কাছে দেবেন, স্বভাবতই তাদের, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা জনগণ আকারে বিভিন্ন জায়গায় থাকলে তারা যাবে, কথা শুনবে। তার সঙ্গে কথা বলে তাদের কথা প্রকাশ করবে।”

নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সুযোগ মুহাম্মদ ইউনূসই তৈরি করে দিয়েছেন, যার দরকার ছিল না বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।

তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় এই কলামনিস্ট বলেন, “কারণ এই গণঅভ্যুত্থানের কর্তা রাজনৈতিক দল নয়, জনগণ। এই শিক্ষাটুকু তার রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে, তিনি এটা ধরতে পারেন নাই। তাকে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমার কাজ। যে, এখানে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল না। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল তাদের কর্মীদের ভূমিকা ছিল, তারা জনগণ আকারে অংশগ্রহণ করেছে। সকলেই আমরা জনগণ তার মধ্যে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক দলের সুবিধা তারা নিতে থাকে। এটা তো হবে না।”

বিদেশ থেকে এনে রাষ্ট্রীয় পদে বসানো ‘মারাত্মক ভুল’
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে ‘সঠিক রাজনৈতিক পরামর্শ’ দিতে পারে এমন কেউ উপদেষ্টা পরিষদে নেই বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার। সরকারে কিংবা বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে বিদেশিদের নিয়ে আসার পক্ষে না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) যাদেরকে বিদেশ থেকে এনেছেন বিভিন্ন কমিশনে, কিংবা তারা উপদেষ্টা হিসেবে আমি এটার পক্ষে না।

“কারণটা হচ্ছে এই যে, যে তর্কটা উঠেছে তারা ব্যক্তি হিসেবে মন্দ ব্যক্তি, আমি তা বলছি না। আমি তাদের অনেককে খুবই পছন্দ করি, অনেকে আমার বন্ধুও বটে এবং তাদের আমি বন্ধু বলে আমি স্বীকার করি। কিন্তু আপনি একটা রাষ্ট্রকে ছোট করতে পারেন না।”

রাষ্ট্রকে ছোটো করা হয় কীভাবে তার ব্যাখ্যায় এ চিন্তক বলেন, “সেটি হল-যদি কেউ বিদেশি নাগরিক হয় বা দ্বৈত পাসপোর্টধারী হয়, আপনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে তাকে দিতে পারেন না, এটা গ্রহণযোগ্য না। এটা গ্রহণযোগ্য না।

“তাকে কী পারেন? আপনি তাকে পরামর্শক রাখতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি যখনই তাকে একটা রাষ্ট্রীয় পদে দিচ্ছেন, যখন তার আদেশটা বাধ্যতামূলক হয় অন্যের পালন করাটা, এটা ভুল সিদ্ধান্ত। এটা মারাত্মক ভুল।”

‘ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের নায়ক নন, ফল’
গণঅভ্যুত্থানের পর আসা মুহাম্মদ ইউনূসের জনগণের কথা শোনার কথা থাকলেও তার প্রতিফলন সেভাবে না দেখার কথা বলছেন ফরহাদ মজহার। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন দলের ঘেরাও কর্মসূচির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “তিনি কি গতকাল জনগণের কথা শোনেননি?

“কেন ছাত্রদেরকে তার যে অফিস, এটাকে ঘেরাও করতে হল। তার আগেই কি তার বুঝা উচিত ছিল না, তাদের ক্ষোভটা কোথায়? তাদের কষ্টটা কোথায়? তারাই তো তাকে এনেছে। তিনি তো গণভ্যুত্থানের নায়ক নন, তিনি গণভ্যুত্থানের ফল। এটা তো ভুলে গেলে চলবে না।”

মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ও পেছনে ‘একশ ভাগ থাকা এবং সমর্থন করার’ প্রত্যয় জানিয়ে এই চিন্তক বলেন, “কিন্তু তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া আমার কাজ। এই ভুলগুলো তাকে শোধরাতে হবে। ফলে তাকে সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক উপদেশ দেবার, রাজনৈতিক উপদেষ্টা, এটা তার দরকার।

“এ উপদেশটা তার দরকার এবং আমরা আনন্দচিত্তে তার পক্ষে এটা করব। যখনই তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হবে, অন্যায় ক্ষোভ, এটা আমরা প্রতিহত করব।”

‘আমরা তাকে ঠিক করব’
সংস্কার কার্যক্রম ইতোমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। তার মতে, সামনের ‘সংকট’ মোকাবেলার উপায় কী হবে, তা নির্ভর করবে জনগণের লড়াইয়ের উপর। এটা মুহাম্মদ ইউনূসের উপর নির্ভর করবে না।

তিনি বলেন, “ব্যর্থতো হতেই পারেন। তিনি তো কাজ করতে আসছেন। ব্যর্থ হলে কি তিনি ব্যর্থ হয়ে যাবেন? তার মানে কি ডক্টর ইউনূস খারাপ হয়ে গেল তার জন্য? তিনি কাজ করতে এসছেন, আমরা তাকে সহায়তা করছি, তাকে ঠিক করব আমরা। আমরা যেহেতু তাকে নিয়ে এসেছি, তাকে আমরা ঠিক করব।”

প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের মনোভাব ঠিক থাকলেও শুরুর দিকে অনেকে তাকে ‘ভুল পথে নিয়ে চলে গেছে’, এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ফরহাদ মজহারের বলেন, “তিনি হয়তো বুঝতে পারেন না, তো হতেই পারে। একটা রাজনৈতিক নেতা তো নন তিনি। ফলে আমাকেতো বুঝতে হবে যে, আমি কোন বাস্তবতার মধ্যে বাস করছি।”

‘সংবিধান সংস্কারের পক্ষে ছিলাম না’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শুরু থেকেই সংবিধান সংস্কারের পক্ষে না থাকার কথা বলেছেন অভ্যুত্থানের সময় আলোচনায় থাকা এই চিন্তক। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই সংবিধানের অধীনে ঢোকানোই ঠিক হয় নাই।”

সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, “এখানে আমি তাদের সঙ্গে একমতই না।

“আমি কথাটা পরিষ্কার করে বলছি। আমি বারবারই বলেছি, বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরে উচিত ছিল এই সংবিধানের অধীনে সরকারটাকে না ঢোকানো, একটা পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা।

“ফলে ডক্টর ইউনূস কিন্তু আসলে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন একজন প্রধান উপদেষ্টা বা সরকার নন। তার হাতে পূর্ণ ক্ষমতা নাই। এই পূর্ণ ক্ষমতার নাই বলে এটাকে আমি বলি ‘সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার’।”

সেনাবাহিনী সমর্থন না করলে এই সরকার একদম ‘টিকে থাকতে পারবে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আজকে আমাদের সেনাপ্রতিষ্ঠান যদি তাকে সমর্থন না করে, তাহলে এই সরকার একদম টিকে থাকতে পারবে না।

“তো এই একটা দুর্বল সরকারের পক্ষে কোনো সংস্কার করা, ইতিবাচক কোনো সংস্কার করা অসম্ভব, এটা এক নম্বর যুক্তি। দুই নম্বরটা হল এই, তিনি যাদের নিয়ে কমিশন বানিয়েছেন, এটা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া।”

কারা চাপিয়ে দিয়েছে?
জবাবে ফরহাদ মজহার বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসই চাপিয়ে দিয়েছেন উপর থেকে; বেছে বেছে নিয়েছেন। “এরা (কমিশন সদস্য) কি গণঅভ্যুত্থানে ছিলেন? এরা কি গণঅভ্যুত্থানকে প্রতিনিধিত্ব করেন? করেন কেউ? আমি দেখিনিতো আন্দোলনের সময়। তাদের কোনো বক্তব্য দেখি নাই। এরা কি করে হঠাৎ করে এলেন? অনেকে ‘ওয়ার অন টেররের’ পক্ষে বইপত্র লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে।”

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সম্পর্কে এই কলামনিস্টের পর্যবেক্ষণ হল- বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের অবস্থান জানেন না তিনি। ফরহাদ মজহার বলেন, “তার (প্রধান উপদেষ্টা) নিরাপত্তা উপদেষ্টার অবস্থানতো আমরা জানি না, বাংলাদেশের সম্পর্কে। এরাতো পরীক্ষিত নন।

“এদেরতো কোনো মতাদর্শিকভাবে আমরা চিনি না। তিনি তাদের ধরে নিয়ে এসেছেন কী করে? ধরে নিয়ে এসেছেন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে; টেকনিক্যাল এক্সপার্ট বলে কিছু নাই। এটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, ইউ নিড পলিটিক্যাল এক্সপার্টাইজ। আপনার রাজনৈতিকভাবে সচেতন, যারা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ।”

লোক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এমন ‘দুর্বলতা’ এবং জনগণকে ‘কর্তৃত্ব’ না দেওয়ার কারণে সংস্কার কার্যক্রম ব্যর্থ হবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তার (প্রধান উপদেষ্টা) এই তথাকথিত সংস্কার ব্যর্থ হবে। আরও ব্যর্থ হবার কারণটা হচ্ছে এই, তিনি জনগণকে এজেন্সি দিচ্ছেন না।

“জনগণ গণঅভ্যুত্থান করেছে, এটা তিনি এখনো স্বীকার করেননি। তিনি ধরে নিচ্ছেন, এটা রাজনৈতিক দলগুলো করেছে। ফলে তিনি আলোচনা করছেন কার সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলার সঙ্গে। তারাতো এই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তাদের কর্মীরা যুক্ত ছিল, দল আকারে নয়।”

নারী সংস্কার কমিশন খারাপ কী বলেছে, ধর্ম সংস্কার তো করতে বলেনি

নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে কেউ একমত না হতে পারেন, সুপারিশ নিয়ে তর্কও হতে পারে; কিন্তু নারীদের অপমান করার মত ‘ইসলামের নৈতিকতা বিরোধী’ কাজ কেন ধার্মভিত্তিক দলগুলো করছে, সেই প্রশ্ন রেখেছেন চিন্তক ও কলামনিস্ট ফরহাদ মজহার। তিনি বলেছেন, “নারীরা তো ধর্ম সংস্কার করতে বসেননি। আপনি তাদের… সব কথাতো শোনার দরকার নাই আপনার। আপনি বলেন এতে আমরা একমত হইনি। কিন্তু তারা কি বলবে, খুব ছোট্ট কথা তারা বলবে। তারা বলবে, পারিবারিক আইন আছে এটা থাকবে। তারা তো বলেনি পারিবারিক আইন সংস্কার করো। একবারও বলেনি।”

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা অন্তবর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন খাতে ১১টি সংস্কার কমিশন করেছে। এর মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়, সেখানে ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এরপরই নারী কমিশন ও সুপারিশ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।

ফরহাদ মজহার বলেন, “এ পর্যন্ত যতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে, অধিকাংশ কমিশনের রিপোর্টই খুব বেশি ইতিবাচক নয়। কিন্তু সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি, কোনো সমস্যা নেই। আমরা বলব- এ সমস্ত সুপারিশের মধ্যে সত্যিকারের গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট নেই। একটা মাত্র (নারী) কমিশনের রিপোর্ট ছাড়া। আরেকটি আছে শুনেছি, সেটা হচ্ছে শ্রম কমিশন। নারী কমিশনতো বিতর্ক থাকবে। নারী কমিশন যেহেতু গণঅভ্যুত্থান, জনগণের অভিপ্রায়কে রিপ্রেজেন্ট করে, ফলে বিতর্কিত হবেই।”

সংস্কার কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার- এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও এসেছে। তবে দেশের ইসলামপন্থীদের অন্যতম প্ল্যাটফরম হেফাজতে ইসলাম নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে, জামায়াতে ইসলামীও কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।

ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামি পারিবারিক আইন নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ কমিশন দিয়েছে, হেফাজতের আপত্তি মূলত সেই জায়গায়।

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নারীর ব্যক্তি অধিকারের কথা সংস্কার কমিশন তুলে ধরেছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, “সে ব্যক্তি অধিকারের বলে, সে যদি মনে করে যে তার সম্পত্তির বণ্টনটা রাষ্ট্রের আইনের দ্বারা ঠিক হবে, তবে এটা খারাপ কি কথা বলেছে? খারাপ তো কথা কিছু বলেনি। আমি যদি মনে করি যে পারিবারিক আইনের মধ্যে সম্পদ বন্টন আমার চাই না; আমি ব্যক্তি, আমি একজন নাগরিক, আমি কি চাইতে পারি না রাষ্ট্রের কাছে? এটার মধ্যে কী বিরোধ আছে? তারা কি বলেছে যে শরীয়াহ আইন বদলাও? তারা কি বলছে কোরানকে নতুন করে ইন্টারপ্রেট কর? আমি তো দেখিনি, তাদের কোনো লেখায় পড়িনি, কোথাও নেই।”

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পারিবারিক সম্পত্তিতে সমান অধিকার, অভিভাবক হিসেবে নারীর সমান অধিকারসহ বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। এছাড়া নারীদের অধিকার রক্ষায় স্বতন্ত্র স্থায়ী নারী বিষয়ক কমিশন তৈরি করা; অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ সংশোধন করে সন্তানের ওপর নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা; যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা; শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা এসব সুপারিশও রয়েছে।

যৌনকর্মীদের শ্রমিকের স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ নিয়েও অবমাননাকর ভাষায় কমিশনকে আক্রমণ করেছেন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কেউ কেউ। এমনকি হেফাজতে ইসলামের এক সমাবেশে নারী সংস্কার কমিশনকে ‘বেশ্যা কমিশনও’ বলা হয়েছে, যা নিয়ে পরে সংগঠনটি দুঃখ প্রকাশ করেছে।

সেই প্রসঙ্গ ধরে ফরহাদ মজহারের ভাষ্য, যৌনকর্মীর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর মানবিক এবং রাজনৈতিক বিষয়।

“ফিলোসফাররা বলে, বেয়ার লাইফ। বেয়ার লাইফ মানে তাদের জীবনের কোনো আইনে সুরক্ষা নেই। ফলে রাষ্ট্র তাদেরকে রক্ষা করে না নির্যাতন থেকে, বিভিন্ন রকম অত্যাচার হামলা, কোনো সুরক্ষা নেই। তার সবচেয়ে বড় সিম্বল হচ্ছে যাদেরকে বলি যৌনকর্মী।

“নারী কমিশনের রিপোর্টটা বাদ দেন, ফেলে দেন বঙ্গোপসাগরে। আপনি তাদের জন্য কী করতে চান? বলেন সে তো নাগরিক দেশের, একটা অধিকার আছে। হয় আপনি এটাকে এখান থেকে বন্ধ করে দিন, আপনি তাকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করুন। আপনি তে কিছু একটা করবেন। তাহলে আইনি সংস্কারের কথা যদি ওঠে তাহলে অবশ্যই তাকে কোনো না কোনো নাগরিক অধিকার আপনাকে দিতে হবে।”

যৌনকর্মী হিসেবে কাজের জন্য যে বয়সের সার্টিফিকেট নিতে হয়, সে কথা তুলে ধরে ফরহাম মজহার বলেন, “তাহলে কেন আপনি নারী কমিশনের সমালোচনা করছেন? রাষ্ট্র ইতোমধ্যে হস্তক্ষেপ করছে (সার্টিফিকেট দিয়ে)। রাষ্ট্র যদি হস্তক্ষেপই করে থাকে তাহলে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতেই হবে। রাষ্ট্র তুমি যখন স্বীকৃতি দিচ্ছ সে যৌনকর্ম করতে পারে; রাষ্ট্র যখন সার্টিফিকেট দিচ্ছ সে যৌনকর্ম করতে পারে, তাহলে তার নাগরিক অধিকার স্বীকার করবেন না কেন।”

তিনি বলেন, “যেসব ইসলামিস্টরা সমালোচনা করছে, তাদের তো এতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোথাও মিছিল করতে দেখিনি যে ‘আমরা কোনো যৌনকর্মী চাই না’। কিন্তু ইসলামে একটা বিরাট ব্যাপার আছে। কোনো মেয়ে যদি তার পেটের তাগিদে এ ধরনের যৌনকর্মে লিপ্ত হয়, শাস্তি কার আগে হবে, সে এলাকার ইমামের। কারণ, ইসলাম তো সমাজকেন্দ্রিক।

“…তারা কেন পুনর্বাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে না? এটা তো ইসলামবিরোধী পথ। …যৌন কর্মকে বন্ধ করতে চান? তাহলে ইসলামের মানবিক দিক নিয়ে এগিয়ে আসেন। আপনি এখন কি করলেন? মেয়েদেরকে বেশ্যা বলে গালি দিলেন।”

মেয়ের ছবি ছাপিয়ে পেটানো, অপমান করার পর যখন ‘হাসিনা’ নাম দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও সমালোচনা করেন ফরহাদ মজহার।

ইসলামের নামে নারীদের অপমান করার মতো ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।

এ গবেষক বলেন, “…এগুলো চলবে না। মেয়েদের এত অপমান করছেন কেন? এটা ঘোরতর ইসলামবিরোধী, ইসলামের নীতি নৈতিকতা বিরোধী কাজ।…দেশের মানুষ কী শিখল এখানে? নারীদেরকে এভাবে অপমান করায় আমাদের মুখোজ্জ্বল হয়েছে কি? না আমরা নিচে নেমেছি? এটা তো ঠিক হয়নি। আসেন তর্ক করেন, অসুবিধা নেই।”