অবৈধ পথে লিবিয়া হয়ে ইতালি, ৬ মাসে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি
- আপডেট সময় : ১২:৩২:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫
- / 195
২০২৩ সালে উন্নত জীবনের আশায় দালালের ফাঁদে পড়ে সাগর ও তানজির লিবিয়া পাড়ি জমান। তাদের খরচ হয়েছিল প্রায় ৪ লাখ টাকা করে। আলমগীর আরও আগে, আড়াই বছর আগে, ৩ লাখ টাকা ব্যয় করে লিবিয়া যান। দালালরা তাদের ইতালিতে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাঠালেও বাস্তবে সেখানে পৌঁছেই তারা এক মাফিয়া চক্রের হাতে বিক্রি হয়ে পড়েন। ত্রিপোলিতে আরও ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে মাসের পর মাস নির্যাতন সইতে হয় তাদের। অবশেষে বাংলাদেশ দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় ৯ জুলাই তারা দেশে ফেরেন। একইদিনে আরও ১৪১ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়।
৬ মাসে সাগর পাড়ি দিয়েছেন প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি
অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছেন হাজারো বাংলাদেশি। এ যাত্রায় অনেকেই নিখোঁজ বা প্রাণ হারাচ্ছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৯,৭৩৫ জন বাংলাদেশি ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করেন। গত বছরের তুলনায় এ প্রবণতা বেড়েছে ১০ শতাংশ।
আইওএম-এর তথ্যমতে, এ বছর এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরে ৭১৮ জন অভিবাসী মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭০১ জনের মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ১২ শতাংশই বাংলাদেশি।
দালালের ফাঁদে ইউরোপের স্বপ্ন
ফেরত আসা তানজির শেখ বলেন,
“লিবিয়ায় আমাদের দিনের পর দিন বেঁধে রাখা হতো, লোহার রড দিয়ে পেটানো হতো। নির্যাতনের ভিডিও পরিবারকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ আদায় করত পাচারকারীরা। মরুভূমিতে ফেলে যাওয়া হয়েছিল, মনে হয়েছিল আর বাঁচবো না।”
সিলেটের মোশাররফ হোসেন জানান, আট লাখ টাকা খরচ করে ইতালি যেতে গিয়ে ধরা পড়ে দুই মাস জেল খাটতে হয় তাকে। দেশে ফিরে হাতে আছে শুধু আইওএম-এর দেওয়া ৬ হাজার টাকা ও একটি ব্যাগ।
বেনগাজীর গানফুদা ডিটেনশন সেন্টার থেকে ২১ আগস্ট দেশে ফিরেছেন আরও ১৭৪ জন। তাদের কারও খরচ হয়েছে ১০ লাখ, কারও বা ১৪ লাখ টাকা।
কাওসার নামের এক ফেরতপ্রাপ্ত জানান,
“ডিটেনশন সেন্টারে লবণ মিশ্রিত পানি খেতে হতো। পুরো মাসে একদিনও বাইরে যাওয়া যেত না, এক রুমেই বন্দি থাকতে হতো।”
ব্র্যাকের গবেষণা: ৭৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার
২০২৪ সালে ব্র্যাক ৫৫৭ জন লিবিয়া ফেরত বাংলাদেশির অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে জানায়—
-
সবাইকে ইউরোপে চাকরির লোভ দেখানো হলেও বাস্তবে চাকরি পাননি কেউ।
-
৬৩% যাত্রাপথে বন্দি হন, এর মধ্যে ৯৩% ক্যাম্পে আটক ছিলেন।
-
৭৯% শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
-
৬৮% স্বাধীন চলাফেরার সুযোগ হারান।
-
৫৪% কখনও নিয়মিত খাবার পাননি।
ব্র্যাকের শরিফুল হাসান বলেন,
“শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, কুমিল্লা— এসব জেলায় মানুষ বেশি টার্গেট হয়। দালালরা তাদেরকে ইউরোপের চাকরির স্বপ্ন দেখাচ্ছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
সাত মাসে লিবিয়া থেকে ফিরেছেন ১,৫৪৫ জন
লিবিয়ায় আটক ও বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনছে বাংলাদেশ দূতাবাস ও আইওএম।
-
গত ৭ মাসে ফিরেছেন ১,৫৪৫ জন।
-
২০২৩ সালের জুলাই থেকে এখনও পর্যন্ত ফিরেছেন ৫,৭০০ জন।
-
২০১৯ সাল থেকে মোট ফিরেছেন ১০,৭২৮ জন।
মানবপাচারকারীও গ্রেফতার
২১ আগস্ট লিবিয়া থেকে ফিরিয়ে আনা যাত্রীদের মধ্যেই ছিলেন পাচারচক্রের সক্রিয় সদস্য সাখাওয়াত হোসেন (৪২)। বিমানবন্দরেই তাকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
তিনি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, ৪০০–৫০০ বাংলাদেশিকে চারটি নৌকায় করে লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান জানান,
“মানবপাচার রোধে অভিযান চলছে। গ্রেফতার আসামির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের অন্যান্য সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।”





















