‘অপারেশন সিন্দুর’ জবাবে অপারেশন ‘বুনিয়ান-উন-মারসুস’ : ভারত-পাকিস্তান বিরোধের নতুন অধ্যায় ড্রোন যুদ্ধ
- আপডেট সময় : ১২:৪১:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ মে ২০২৫
- / 371

ভারতের সামরিক অভিযানের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় শনিবার ‘বুনিয়ান-উন-মারসুস’ নামের একটি সামরিক অভিযান শুরু করেছে পাকিস্তান। পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারত গত বুধবার ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালু করে। এই পাল্টাপাল্টি উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় শনিবার পাকিস্তানের তিনটি বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। এর পাল্টা জবাবে ভারতের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলার ঘোষণা দেয় পাকিস্তান। একই দিনে ইসলামাবাদ নিজেদের সামরিক অভিযানের নাম প্রকাশ করে।
পাকিস্তানের জিও টিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বুনিয়ান-উন-মারসুস’ নামটি এসেছে কোরআন থেকে। শব্দগুচ্ছটির অর্থ হলো ‘গলিত সীসা দিয়ে গড়া একটি অটুট প্রাচীর’, যা প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে শক্তি, ঐক্য ও দৃঢ়তার।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। হামলার আগে ভারতের ‘কাপুরুষোচিত’ আক্রমণে নিহত শিশুদের প্রতি সম্মান জানাতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র বাহনের সামনে তাদের নাম লেখা ব্যানার নিয়ে সেনাদের দেখা গেছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যম প্রো-পাকিস্তানি জানায়, ‘বুনিয়ান-উন-মারসুস’ শব্দবন্ধটি কোরআনের সূরা আস-সাফ থেকে নেওয়া, যার অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে এমনভাবে যুদ্ধ করে যেন একটি সুসংবদ্ধ প্রাচীর।” ভারতের হামলার বিপরীতে এটি পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ ও শক্ত প্রতিরোধের প্রতীক বলেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। হামলাকারীরা পর্যটকদের একত্র করে তাদের ধর্ম জানার পর স্ত্রী-সন্তানদের সামনে গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনার স্মরণে দিল্লি সামরিক অভিযানের নাম দেয় ‘সিঁদুর’— যা হিন্দু নারীদের স্বামীর জীবনের প্রতীক। স্বামীর মৃত্যুতে নারীরা আর সিঁদুর পরেন না।

ভারতের বিমানবাহিনীর রাফাল জঙ্গিবিমান
ভারত-পাকিস্তান বিরোধের নতুন রূপ ড্রোন যুদ্ধ
প্রথমবারের মতো ড্রোন যুদ্ধে জড়াল ভারত ও পাকিস্তান— দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। বৃহস্পতিবার (৮ মে ২০২৫) রাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের তিনটি সামরিক স্থাপনায় ড্রোন হামলার অভিযোগ করে ভারত।
ইসলামাবাদ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং পাল্টা দাবি করে, তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতের ২৫টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। দিল্লি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিক্রিয়ামূলক এই পাল্টাপাল্টি আচরণ দুই দেশের বহু পুরোনো সংঘাতকে এক নতুন, এবং আরও বিপজ্জনক, পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাহারা মতিসেক বিবিসিকে বলেন, “ভারত-পাকিস্তান বিরোধ এখন ড্রোন যুগে প্রবেশ করেছে। এ ধরনের ‘অদৃশ্য চোখ’ এবং চালকবিহীন হামলা উত্তেজনা বাড়াতেও পারে, কমাতেও পারে।”
তিনি আরও বলেন, “যে পক্ষ এই আকাশে ড্রোন যুদ্ধের নেতৃত্ব নেবে, তারা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, পুরো আকাশসীমায় আধিপত্য বিস্তার করবে।”
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারতের বিমান ও গোলাবর্ষণে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বুধবার সকাল থেকে অন্তত ৩৬ জন নিহত এবং ৫৭ জনের বেশি আহত হয়েছে।
অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, পাকিস্তানি গোলায় তাদের ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে।
নয়া দিল্লির বক্তব্য, পেহেলগামের হামলার প্রতিশোধ নিতে মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তান এবং তার নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চলে জঙ্গি আস্তানায় হামলা চালানো হয়েছে।
তবে পাকিস্তান পেহেলগামের ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানিয়েছে, করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডিসহ বিভিন্ন শহরে ভারতের ২৫টি ড্রোন তারা গুলি করে নামিয়েছে।
বিবিসি জানায়, ইসরায়েলি প্রযুক্তির ‘হারোপ’ ড্রোনগুলো প্রতিহত করতে অস্ত্রের পাশাপাশি আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিও ব্যবহার করেছে পাকিস্তান।
ভারত দাবি করেছে, তারা লাহোরসহ পাকিস্তানের কয়েকটি বিমান প্রতিরক্ষা রাডার নিষ্ক্রিয় করেছে, যদিও ইসলামাবাদ এই দাবি অস্বীকার করেছে। বর্তমান যুদ্ধক্ষেত্রে লেজার-নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং চালকবিহীন আকাশযান নির্ভুল ও কার্যকর হামলার নতুন দিগন্ত তৈরি করেছে।
ড্রোনগুলো শত্রু পক্ষের রাডার সক্রিয় করে দিতে পারে, যাতে পরে ওই লক্ষ্যে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত হানা সম্ভব হয়। এতে মানবচালিত বিমানের ঝুঁকিও কমে।
অধ্যাপক মতিসেক বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও এমন প্রযুক্তির ব্যবহারে ড্রোন শত্রু বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করার এক কার্যকর উপায় হয়ে উঠেছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ড্রোন বহরে ইসরায়েলি প্রযুক্তির আধিপত্য রয়েছে। হেরন, হারপি ও হারোপ ড্রোনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য শনাক্ত করে হামলা চালাতে সক্ষম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘হেরন’ ড্রোনকে ভারতের নজরদারি চোখ বলা হয়, যেটি যুদ্ধেও ব্যবহারযোগ্য। ‘আইএআই সার্চার এমকে-টু’ মডেলের ড্রোনটিও ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত আকাশে থেকে ৩০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে এবং ২৩,০০০ ফুট উচ্চতায় উড়তে পারে।
ভারতের হাতে এখনো যুদ্ধক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোনের সংখ্যা সীমিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪০০ কোটি ডলারে ৩১টি ‘এমকিউ-৯বি প্রিডেটর’ ড্রোন কেনার চুক্তি হয়েছে। এসব ড্রোন ৪০ ঘণ্টা উড়তে এবং ৪০,০০০ ফুট উচ্চতায় অভিযান চালাতে সক্ষম।
ভারত বর্তমানে ‘সোয়ার্ম ড্রোন’ কৌশলেও জোর দিয়েছে— যেখানে অনেক ছোট ড্রোন একসঙ্গে আক্রমণ করে শত্রু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে।
লাহোরভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক ইজাজ হায়দার বলেন, পাকিস্তানের ড্রোন বহর অনেক বড় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে চীনের ‘সিএইচ-৪’, তুরস্কের ‘বেয়ারাকতার আকিনসি’ এবং পাকিস্তানের নিজস্ব ‘বুরাক’ ও ‘শাহপার’ ড্রোন।
পাকিস্তান ‘লোইটারিং মিউনিশন’ প্রযুক্তিও ব্যবহার করছে, যা তাদের ড্রোন সক্ষমতা বাড়িয়েছে। তাদের বিমানবাহিনী এক বছর ধরেই চালকবিহীন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে।
তিনি বলেন, পাকিস্তান এখন ‘লয়্যাল উইংম্যান’ ড্রোন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে— যেখানে এই ড্রোনগুলো মানুষচালিত বিমানের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ব্যবহৃত হয়।
অধ্যাপক মতিসেকের মতে, ভারতের জন্য ইসরায়েলি হেরন ও হারোপ ড্রোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর পাকিস্তান তুরস্ক ও চীনের প্রযুক্তির ওপর বেশি নির্ভর করছে।
ভারতীয় সামরিক বিশ্লেষক মনোজ যোশির মতে, ড্রোন ব্যবহার তুলনামূলকভাবে ‘সংযত’ পদক্ষেপ হলেও এটি বৃহৎ আকারের সংঘাতের সূচনা হতে পারে।
তিনি বলেন, “ড্রোনে তুলনামূলক কম অস্ত্র থাকায় এগুলো যুদ্ধবিমান বা বড় ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় অপেক্ষাকৃত হালকা হামলা হিসেবে দেখা যায়। তবে এটি যদি বিস্তৃত বিমান হামলার অংশ হয়, তাহলে পরিস্থিতির রূপ বদলে যাবে।”
ইজাজ হায়দারের ব্যাখ্যায়, জম্মুতে পাকিস্তানি ড্রোনের তৎপরতা ভারতের ‘উসকানির’ একটি কৌশলগত প্রতিক্রিয়া, যা সর্বাত্মক প্রতিশোধ নয়।
“ভারতের বিরুদ্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক হামলা হলে তা আরও বিস্তৃত হবে, যেখানে চালকসহ ও চালকবিহীন উভয় ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে।”
মনোজ যোশি বলেন, “আমরা যে ড্রোন যুদ্ধ দেখছি, তা হয়তো খুব দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তবে এটি বড় কোনো যুদ্ধের প্রারম্ভিক ইঙ্গিতও হতে পারে। সময়ই বলবে, কোন পথে পরিস্থিতি গড়াবে।”


















