রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে আগুনে পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানার মেশিন অপারেটর নাজমুল ইসলাম প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকালেও নিয়মিত কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
সেদিন বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে শিয়ালবাড়ির একটি কেমিক্যাল গোডাউন ও গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ১৬ জনের মৃত্যু হয় এবং অনেকে নিখোঁজ হন। তাদের মধ্যেই আছেন নাজমুল ইসলাম।
আগুন লাগার পরপরই স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলেন নাজমুল। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শুধু বলেছিলেন, “আগুন আগুন, বাঁচাও।” তারপর লাইন কেটে যায়। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মেলেনি।
নিখোঁজ নাজমুল ইসলামের স্ত্রী বলেন, “আমার সাথে কথা হওয়ার পর থেকে স্বামীর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছি না। ঢাকা মেডিকেল, ইবনে সিনা, ইসলামি মেডিকেল—সব জায়গায় খোঁজ করেছি। কোথাও পাইনি। গার্মেন্টসের মালিককে কল দিয়েছিলাম, উনি বললেন কেউ মারা যায়নি, সবাই নিরাপদে আছে। কিন্তু আমি তো আমার স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছি না।”
কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, “যখন আগুন লাগে, তখন ফোন দিয়ে বলেছিল বাঁচাও। ওইটাই ছিল তার শেষ কথা। তারপর আর কোনো যোগাযোগ নাই।”
এদিকে, আগুনে বহুজনের খোঁজ না মেলায় স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে শিয়ালবাড়ি এলাকা ও আশপাশের সড়ক। কেউ হাসপাতালে ছুটছেন, কেউ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।
মো. শফিকুল ইসলাম হাতে ভাগ্নি মাহিরা (১৪)-র ছবি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে। চোখে-মুখে আতঙ্ক ও কান্না। তিনি বলেন, “আমার ভাগ্নি মাহিরা গার্মেন্টসের তৃতীয় তলায় কাজ করতো। আগুন লাগার পর থেকে খুঁজছি। কোনো হাসপাতালেও পাইনি। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা শুধু ধৈর্য ধরতে বলছে।”
নিখোঁজ নারগিস আক্তারের বড় বোন লাইজু বেগম জানান, “আমার বোন সকাল পৌনে আটটায় কাজে গিয়েছিল। সকাল ১১টার দিকে আগুন লাগার খবর পাই। তার এক সহকর্মী জানায়, আগুন লাগার পর কেউ ভেতর থেকে বের হতে পারেনি। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাইনি।”
সরেজমিনে দেখা যায়, শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর সড়কের দক্ষিণ পাশে শাহ আলম কেমিক্যালের দুইতলা গুদামটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। উপরে ছিল টিনের ছাউনি। আগুনের সূত্রপাত হয় এই গুদাম থেকেই। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা পোশাক কারখানায়। দুই ভবনের মাঝের সরু রাস্তা ফায়ার সার্ভিসের কাজকে ব্যাহত করে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে ১১টা ৫৬ মিনিটে তাদের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। প্রথমে পাঁচটি ইউনিট কাজ শুরু করে; পরে আরও সাতটি ইউনিট যুক্ত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে গার্মেন্টস ও পাশের কেমিক্যাল গুদামে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকেরাও আগুন নেভাতে সহায়তা করেন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম বলেন, “বিভিন্ন দাহ্য রাসায়নিক থাকার কারণে কেমিক্যাল গুদামের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। মরদেহগুলো অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া শনাক্ত করা সম্ভব নয়—চেহারা দেখে বা অন্যভাবে চেনা যাচ্ছে না।”


















