যেভাবে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ইরান-ইসরায়েল
- আপডেট সময় : ১১:১১:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
- / 291

ইরানে একতরফা হামলা চালিয়ে যুদ্ধের শুরুটা করেছিল ইসরায়েল। এরপর উভয়পক্ষের মধ্যে টানা ১২ দিন ধরে চলে তুমুল যুদ্ধ।
শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে বসে। আর এতে এই যুদ্ধ আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক রুপ নেওয়ার অবস্থায় চলে গিয়েছিল।
ঠিক এমন অবস্থার মধ্যেই সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। নিজের সোশাল মিডিয়া ট্রুথ সোশালে এক পোস্টে তিনি লেখেন, “ইসরায়েল ও ইরান পুরোপুরি ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।”
সোমবার এক শীর্ষস্থানীয় হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ার আগে ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানান, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিও যুদ্ধবিরতির আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা ওয়াশিংটনের সময় অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টা কয়েক মিনিট পর দেওয়া হয়। এত দ্রুত ও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘোষণাটি আসায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিজ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও হতবাক হন।
ট্রাম্পের ঘোষণা দেওয়ার পর ইসরায়েল তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। বরং ট্রাম্পের ঘোষণার তিন ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল আবার ইরানের ওপর হামলা চালায়। এতে প্রশ্ন ওঠে, আদৌ কি সব পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল?
ট্রাম্পকে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে সহায়তা করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। গত দুই মাস ধরে এই তিনজনই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করার একটি চুক্তির জন্য কাজ করছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা জানান, গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ইরানি পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় সামরিক হামলা যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু করার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছিল।
তবে ইরান কী কী শর্তে সম্মত হয়েছে, বা তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদের অবস্থান সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে কি না—এই বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি।
নিউ ইয়র্ক টাইমস ও আল জাজিরা জানায়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোমবার রাতেই তার মন্ত্রিসভা, সামরিক ও গোয়েন্দা প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বৈঠক শেষে এক সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, ইসরায়েল ইরানে পরিচালিত অভিযানে তাদের সব লক্ষ্য অর্জন করেছে। এমনকি এর থেকেও অনেক বেশি সাফল্য এসেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এখন আর তাৎক্ষণিক হুমকি নয়। ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ইসরায়েলের ওপর যে হুমকি ছিল তাও শেষ হয়েছে।
এরপর ইসরায়েল সরকার জানিয়েছে, তারা একটি পারস্পরিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
ট্রাম্প সোশাল মিডিয়ায় পরে আরেক পোস্টে লেখেন, “ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর হয়েছে। দয়া করে কেউ এটিকে লঙ্ঘন করবেন না!।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ইতোমধ্যেই এই যুদ্ধবিরতিতে সম্মতির কথা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ইরান সরকারের কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ও দেশটির সরকারি সংবাদ মাধ্যমেও এবিষয়ে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে ফার্স নিউজ জানিয়েছে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত দাবির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
তিনি সোশাল মিডিয়া এক্সে লেখেন, “ইরান বহুবার পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েল—ইরান নয়।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এখন পর্যন্ত কোনও যুদ্ধবিরতি বা সামরিক অভিযান বিরতির কোনও ‘চুক্তি’ হয়নি। তবে যদি ইসরায়েলি দখলদার শাসন ব্যবস্থা আজ ভোর ৪টার (তেহরান সময়) আগেই ইরানি জনগণের ওপর তাদের অবৈধ আগ্রাসন বন্ধ করে, তাহলে আমরা আর প্রতিক্রিয়া জানাতে আগ্রহী নই।”
আরাগচি আরও বলেন, “আমাদের সামরিক অভিযানের সমাপ্তি সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে।”
ট্রাম্পের বক্তব্য অনুসারে, যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়া শুরু হবে মঙ্গলবার সকাল ১০টায়। আর তা ২৪ ঘণ্টায় ধাপে ধাপে কার্যকর হবে। প্রথমে ইরান সব সামরিক অভিযান বন্ধ করবে। এর ১২ ঘণ্টা পর ইসরায়েলও একই পথে হাঁটবে। ২৪ ঘণ্টা পূর্ণ হওয়ার পর, বিশ্বের সামনে ১২ দিনের যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি উদযাপন করা হবে।
ট্রাম্পের ঘোষণার মধ্যেই তেহরানের উত্তরে ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ব্যাপক বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। সাংবাদিকেরা জানান, যুদ্ধ শুরুর পর এটি ছিল সবচেয়ে জোরালো হামলাগুলোর অন্যতম।
এর আগে সোমবার, ইরান কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। বিশ্লেষকদের মতে, হামলাটি ছিল খুবই হিসেব করে নেওয়া একটি পাল্টা জবাব। গত সপ্তাহে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিক্রিয়ায় এটি করা হয়। হামলার মাত্রা ছিল সীমিত এবং অনেকটা ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে একজন শীর্ষ ইরানি জেনারেলকে হত্যার পর ইরানের প্রতিক্রিয়ার মতোই।
সোমবার ইরান যে হামলা চালায়, সেটির লক্ষ্য ছিল আল-উদেইদ এয়ার বেস। এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। এই হামলা তাৎক্ষণিকভাবে উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয় যে, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত বড় ধরনের আকার নিতে পারে।
তবে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সংঘাতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই হামলার তাৎক্ষণিক প্রভাব সীমিত ছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ইরান যে ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, তার মধ্যে ১৩টিই ভূপাতিত করা হয়েছে। ঘাঁটিতে অবস্থানরত প্রায় ১০ হাজার সেনার কেউই আহত বা নিহত হননি।
যুক্তরাষ্ট্রের এক সামরিক মুখপাত্র জানান, বাকি একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইচ্ছাকৃতভাবে মাটিতে পড়তে দেওয়া হয়, যেটি কোনও ক্ষতি করেনি।
সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক আর্থ ইমেজিং কোম্পানি প্ল্যানেট ল্যাবসের তোলা স্যাটেলাইট ছবি থেকে দেখা যায়, হামলার আগেই ঘাঁটিটি প্রায় ফাঁকা করে ফেলা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতি ছিল অতি সামান্য।
সোমবার ইরানের তিনজন কর্মকর্তা জানান, তারা আগেভাগেই এই হামলার বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিল যাতে হতাহতের সংখ্যা কম হয়। এতে করে তারা একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক হামলার জবাব দিতে পেরেছে, আবার অন্যদিকে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ এড়ানোর একটি পথও খুলে দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও বলেন, ইরান এই হামলার আগে পূর্বসতর্কতা দিয়েছিল। তিনি সোশাল মিডিয়ায় লেখেন, “বিশ্ববাসীকে অভিনন্দন, এখন শান্তির সময়!”
ঠিক একই ধরনের কৌশল দেখা গিয়েছিল ২০২০ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্র একটি ড্রোন হামলায় ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে হত্যা করে। এটি ছিল ইরান ও দেশটির জনগণের জন্য একটি গভীর আঘাত। কারণ বহু ইরানিই সোলাইমানিকে জাতীয় বীর হিসেবে দেখতেন। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তখন তীব্র প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেন।
কিন্তু কয়েকদিন পর ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার আগেভাগেই ইরাক সরকারকে সতর্ক করে। তৎকালীন ইরাকি প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদির কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, তারা ইরান থেকে “একটি আনুষ্ঠানিক মৌখিক বার্তা” পেয়েছে, যেখানে জানানো হয়েছিল—জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান হামলা শুরু করতে যাচ্ছে বা শিগগিরই করবে, এবং হামলা সীমাবদ্ধ থাকবে কেবল সেইসব স্থানে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা অবস্থান করছিল।
পেন্টাগনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইরান দুইটি ঘাঁটি—আল-আসাদ ও এরবিলে ২৪টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। ওই হামলার পর দুই পক্ষই অনেকটা শান্ত হয়ে পড়ে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ সোশাল মিডিয়ায় লেখেন, তারা আত্মরক্ষার্থে প্রয়োজনীয় মাত্রায় জবাব দিয়েছে এবং তাদের লক্ষ্য যুদ্ধ নয়। তবে কোনও আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরক্ষা করবেই।
২০২০ সালের মতোই আল-উদেইদ ঘাঁটিতে ইরানের এই সাম্প্রতিক হামলার ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের পরিমাণ খুবই কম।
এদিকে ইরান ও ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক অবস্থান প্রকাশ করেছেন ইসরায়েলি রাজনীতিক ও ডানপন্থী দল ইসরায়েল বেইতেনুর নেতা অ্যাভিগডর লিবারম্যান। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ইরান সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া একটি বড় ভুল হবে।
তিনি এক্স-এ লিখেছেন, “আহত সিংহকে জীবিত রেখে দেওয়ার চেয়ে ভয়ংকর কিছু নেই। এটি নিশ্চিতভাবেই আমাদেরকে দুই বা তিন বছরের মধ্যে আরও ভয়াবহ এক যুদ্ধে ঠেলে দেবে।”
ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সদস্য দান ইলাউজ বলেছেন, সরকার যদি কোনও চুক্তি সই করে, তবে তা শুধুমাত্র “ইরানের আত্মসমর্পণের চুক্তি” হওয়া উচিত।
এক্স-এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ইলাউজ বলেন, “ইরানের শাসনব্যবস্থা এমন এক ব্যবস্থা যার সঙ্গে চুক্তি করা যায় না—এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা যাকে পরাজিত করতে হয়। ইরানকে পরাজিত করা না হলে তারা নতুন নতুন উপায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবে।”






















