বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়: আবেদনে শীর্ষে বাংলাদেশ
- আপডেট সময় : ১০:২০:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫
- / 48
যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাড়ছে বাংলাদেশিদের। আবেদন যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে প্রত্যাখ্যানের হারও। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে আশ্রয় চাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়—এটি নতুন কিছু নয়। তবে তরুণদের বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে আবেদন করাও এই প্রবণতায় ভূমিকা রাখছে। বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য, ভুয়া তথ্যের কারণে প্রকৃত আশ্রয়প্রার্থীরাই শেষ পর্যন্ত সমস্যায় পড়ছেন। প্রতিবেদন করেছেন সাদ্দিফ অভি।
যুক্তরাজ্যে আশ্রয় আবেদনে শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশ
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের আবেদন করেছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৫১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। পাকিস্তান, ইরিত্রিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের নাগরিকরা আশ্রয় আবেদনকারীদের মধ্যে শীর্ষ পাঁচে রয়েছেন। যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি পাঁচজন আবেদনকারীর দুইজন এই পাঁচ দেশের নাগরিক—যা মোট আবেদনকারীর ৩৯ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্য প্রকাশিত হয় ২৭ নভেম্বর।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর ২২ হাজার থেকে ৪৬ হাজার আশ্রয় আবেদন জমা পড়ত। কিন্তু ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এ সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক বছরটি ছিল রেকর্ড-সম, ১৯৭৯ সালের পর সর্বোচ্চ, যা ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
ইউকে বর্ডার কন্ট্রোল জানাচ্ছে—সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আশ্রয়ের আবেদন আরও বেড়েছে এবং এই দুই দেশের বেশিরভাগ আবেদনকারী ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের পর আশ্রয় আবেদন করেছে। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অভিবাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ফলে ভারতসহ এসব দেশের তরুণদের স্টাডি ও ওয়ার্ক ভিসায় আগমনও বেড়েছে।
ইউরোপে আশ্রয় আবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়
ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুনে ইউরোপে আশ্রয় আবেদনকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তিন নম্বরে। ওই মাসে ২ হাজার ৭৩৫টি আবেদন জমা পড়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ কম।
ইউরোপে বাংলাদেশিদের ৯৬ শতাংশ আবেদন খারিজ
ইইউর তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের শুরু থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রথমবার আশ্রয়ের আবেদন করেছেন ৫৭ হাজার ৫৫০ জন বাংলাদেশি। ২০২৪ সালে আবেদন মঞ্জুরের হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। আর ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ৪৫ হাজার ১২৯টি আবেদন এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
তারা জানিয়েছে, চলতি বছরের জুনে ফ্রান্স, ইতালি ও গ্রিস আবেদন নিষ্পত্তির হার বাড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর সংখ্যাও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদন প্রতি বছর বাড়ছে
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে (২০২০–২০২৪) বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
২০২৪ সালে জাতিসংঘে নিবন্ধিত বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৪৭৩ জন। একই বছরে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন ১ লাখ ৮ হাজার ১৩১ জন বাংলাদেশি—যাদের বেশিরভাগই ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে নিবন্ধিত।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যে আরও দেখা যায়—এই আশ্রয়প্রার্থীরা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, সাইপ্রাস, বসনিয়া ও অস্ট্রিয়ায় আবেদন করেছেন। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর ও পাপুয়া নিউগিনিতে বাংলাদেশিরা আশ্রয় চেয়েছেন। এশিয়ায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকংসহ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও আবেদন রয়েছে। ২০২৪ সালে পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়ায় ছয়জন বাংলাদেশি শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন।
২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতিসংঘে নিবন্ধিত বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যাও বছরে বছরে উর্ধ্বমুখী। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৭৮০—যা ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ১২৬-এ।
রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার আবেদনেও একই প্রবণতা দেখা যায়—২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী আবেদন করেছে ৭৫ হাজার ৮৬৭ জন বাংলাদেশি। ২০২২ সালে ছিল ৬১ হাজার ২৯৮, ২০২১ সালে ৬৫ হাজার ৪৯৫ এবং ২০২০ সালে ৬৪ হাজার ৬৩৬। এর আগের দুই বছরেও আবেদন সংখ্যা ছিল প্রায় ৬২ হাজারের কাছাকাছি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অভিবাসন নীতির পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে আশ্রয় আবেদন বাড়ে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে বিদেশে আশ্রয় চাওয়ার প্রবণতা বাড়া স্বাভাবিক। মানবাধিকারভিত্তিক সুযোগ থাকায় ইউরোপে কেউ কেউ তা ব্যবহার করেন, আবার কেউ অপব্যবহারও করেন।
তিনি জানান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন নীতি বদলাচ্ছে—কোথাও দক্ষ জনশক্তির ওপর জোর, কোথাও অনিয়মিত প্রবেশের বিরুদ্ধে কঠোরতা বাড়ছে। দেশের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী ও সীমিত চাকরির সুযোগও অনেককে বিদেশমুখী করছে।
তার ভাষায়, দেশের মধ্যম আয়ের পরিবারের তরুণরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। বিদেশে পড়াশোনা বা স্কলারশিপ পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। তাই অনেকে অন্য পথ খোঁজে। কঠোর স্টুডেন্ট ভিসা নীতির কারণে কেউ কেউ পরে অ্যাসাইলাম আবেদন করছে। কিন্তু ইউরোপে আশ্রয় পাওয়া কঠিন—সত্যিকারের ঝুঁকি ও প্রমাণ না থাকলে আবেদন নাকচ হয়।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘বিদেশে আশ্রয় প্রার্থীদের সবারই রাজনৈতিক কারণ থাকে না। অনেকেই অনিয়মিত পথে গিয়ে পরে রাজনৈতিক আশ্রয় দাবি করেন—ইউরোপ, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘ফলে দেখা যায়, রাজনৈতিক আশ্রয় অনুমোদনের হার এক শতাংশেরও কম। কারণ তাদের কাগজপত্র ঠিক থাকে না, তারা অবৈধভাবে ঢুকে দীর্ঘ সময় থাকার আশায় আবেদন করে। এতে প্রকৃত আশ্রয়প্রার্থীরাই বিপদে পড়ে—বাংলাদেশিদের আবেদন ভুয়া মনে করায় প্রত্যাখ্যানও বাড়ছে।’’



















