ঢাকা ০৬:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’, অন্যদের ওপর ‘করের বোঝা’

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ১১:১০:৪২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫
  • / 264
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে একদিকে কর বৃদ্ধির নানা উদ্যোগ, অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’ ঘোষণা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনটি করেছে বিবিসি বাংলা।

“সরকার কর বাড়ালেও আমাদের বেতন তো তেমন বাড়ে না”, বলছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক মিঠুন শিকদার।

তিনি বলেন, “কারো বেতন বৃদ্ধি সমস্যা নয়, সরকার আমাদের দিকটাও একটু বিবেচনা করুক।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির খবরে কালকেই তো বাজারে জিনিসের দাম বাড়বে।” তার মতে, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত একরকম, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা”।

বাজেট ঘোষণার একদিন পরই সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তারা ১০ শতাংশ এবং পরের গ্রেডের কর্মচারীরা ১৫ শতাংশ আর্থিক সুবিধা পাবেন।

এই ‘বিশেষ সুবিধা’ নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, এভাবে বেতন বৃদ্ধির চেয়ে মহার্ঘ ভাতা কার্যকর করা হলে তারা বেশি উপকৃত হতেন।

“বেতন বৃদ্ধি শুনতে ভালো লাগছে। কিন্তু এর পাশাপাশি করের হারও বাড়ানো হয়েছে, তাই লাভ হবে না। কারণ মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি”, বলছিলেন আরেক কর্মকর্তা।

একদিকে আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাব, অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধার ঘোষণা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অনেককেই বিস্মিত করেছে।

তাদের মতে, বৈষম্য দূর করার কথা বললেও, আওয়ামী লীগের দেখানো আগের পথেই হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা সেই ৪০ শতাংশ মানুষ।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, “কর হার না বাড়িয়ে কেবল করের আওতা বাড়ালেই রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু এই কঠিন পথে না গিয়ে, আগের মতো সহজ পথই বেছে নিয়েছে সরকার।”

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতির অনিশ্চয়তা দূর না করে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’ বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক এবং সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

তাদের মতে, এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

বাজেটে রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব
ক্ষমতা গ্রহণের দশ মাসের মাথায় ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা।

এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য। বাকি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে তোলার পরেও ২ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি ঘাটতি থাকবে।

এবার বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। আগের বছরের মতোই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাৎসরিক করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাখা হয়েছে।

তবে ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য সাধারণ করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তবে এই প্রস্তাবে করদাতাদের ওপর চাপ বেড়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা করের হার ধাপে কিছু পরিবর্তন করে সাত ধাপের পরিবর্তে ছয় ধাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। যদিও সর্বোচ্চ করহার আগের মতোই ৩০ শতাংশ রাখা হয়েছে, ধাপের সীমা কমানোয় অনেকেরই করের হার বেড়ে যাবে।

সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’
২০১৫ সালের পর আর কোনো বেতন কাঠামো প্রণয়ন না হওয়ায়, অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। জুলাই থেকে এই বিশেষ প্রণোদনার হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে নতুন প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দশম থেকে বিশতম গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১৫ শতাংশ হারে এবং নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তারা ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন।

বাজেট ডকুমেন্ট অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় বরাদ্দ করা হয়েছে ৮৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।

ড. সেলিম রায়হান বলছেন, “বিশেষ সুবিধা” টার্মের মধ্যেই আমার আপত্তি আছে। বৈষম্য কমানোর কথা বলে কেবল সরকারি কর্মচারিদের জন্য এই বিশেষ সুবিধা দেয়া সমর্থনযোগ্য নয়।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ বিদ্যমান। ফলে বিশেষ পক্ষকে এভাবে সুবিধা দিলে তা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করবে। ৯০ শতাংশ মানুষ সরকারি চাকরিতে নেই—তাদের কোনো বিশেষ সুবিধা নেই—এটি বড় প্রশ্ন।

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ২০১৫ সালের পরে রিভিশন না হওয়া প্রসঙ্গে ড. রায়হান বলেন, “২০১৫ সালের পর এতদিন অপেক্ষা করা গেছে, তাহলে আরও এক বছরও যেত।”

তার মতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা—এসবই এখন সবচেয়ে জরুরি। সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ সুবিধা এখন অপ্রাসঙ্গিক ও সাংঘর্ষিক।

বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী এবং বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলছেন, সরকার নিজের অপচয় না কমিয়ে বরং সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়িয়ে ব্যয় আরও বাড়াচ্ছে। এতে মূলত ৪০ শতাংশ করদাতার ওপরই চাপ পড়ছে।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে যখন অন্যান্য সেক্টরের চাকরিজীবীরা সমস্যায় আছেন, তখন শুধুমাত্র সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো অনুচিত। “সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো লাগবে, কিন্তু এ মুহূর্তে নয়।”

তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ব্যক্তিখাতের ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছেন না, আর সরকারকে এই বাড়তি বেতন মেটাতে ব্যাংক থেকে আরও ঋণ নিতে হবে।

কর্পোরেট ট্যাক্স নিয়ে ব্যবসায়ীদের মন্তব্য
প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসাবান্ধব নয় বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ।

তিনি বলেন, “আগেও কিছু শ্রেণি যেভাবে সুবিধা পেতো, এবারও তা-ই হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম এবারের বাজেট ভিন্ন হবে। কিন্তু সেরকম কোনো রূপরেখা পাইনি।”

তার দাবি, অর্থনীতির শ্বেতপত্রের ভিত্তিতে বানানো এই বাজেট বাস্তব অর্থনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেনি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর কাঠামোর কারণে দেশের ব্যবসা পরিবেশে চাপ আরও বাড়বে এবং সেটি ভোক্তার ওপরও পড়বে।

ফাহিম মাশরুর বলছেন, আগে লাভ না করলেও মোট আয়ের দশমিক ৬ শতাংশ কর দিত কোম্পানিগুলো, যা এবার এক শতাংশ করা হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা নতুন চাপে পড়বেন। “এর ফলে ব্যাংকের সুদের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি এডিশনাল খরচও বাড়ছে।”

তিনি বলেন, এতে রাজস্ব বোর্ডের চাপ বাড়ছে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, একক লেনদেনে ৫ লাখ টাকার বেশি এবং বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার বেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংক শর্ত বাতিল হওয়ায় কর্পোরেট ট্যাক্সের ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক দিকও আছে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্সের শর্ত শিথিল করা হয়েছে, মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। যদিও এই সুবিধা কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় আছে।

ড. সেলিম রায়হান বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে অংশ নিলে কর্পোরেট কর হ্রাসের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তবে পুঁজিবাজারের মৌলিক দুর্বলতা সমাধান ছাড়া শুধু কর ছাড়ে কোম্পানিগুলো আগ্রহী হবে না।সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, অতীতের মতো এবারও বিভিন্ন পণ্যে করের হার বাড়ানো-কমানোর পেছনে রাজস্ব আয়ের বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

তিনি বলেন, “যখন পরিকল্পনা ছাড়া করহার বাড়ে-কমে, তখন এর বোঝা সাধারণ মানুষের ওপরই পড়ে।” বর্তমানে দেশের কর কাঠামোতে ৭০ শতাংশের বেশি পরোক্ষ কর—যার বোঝা বৈষম্যপূর্ণভাবে সাধারণ মানুষের ওপরই বেশি।

তিনি মনে করেন, “শুধু করহার বাড়িয়ে বা কিছুটা সামঞ্জস্য করে কর ব্যবস্থাপনার সংস্কার হবে না। বরং করের আওতা বাড়ানোই গুরুত্বপূর্ণ।” কিন্তু সরকার আবারও সহজ পথেই হেঁটেছে।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ রাজস্ব থেকে তোলার পরিকল্পনা নিয়েও গবেষণা সংস্থা সিপিডি সন্দেহ প্রকাশ করেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’, অন্যদের ওপর ‘করের বোঝা’

আপডেট সময় : ১১:১০:৪২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে একদিকে কর বৃদ্ধির নানা উদ্যোগ, অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’ ঘোষণা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনটি করেছে বিবিসি বাংলা।

“সরকার কর বাড়ালেও আমাদের বেতন তো তেমন বাড়ে না”, বলছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক মিঠুন শিকদার।

তিনি বলেন, “কারো বেতন বৃদ্ধি সমস্যা নয়, সরকার আমাদের দিকটাও একটু বিবেচনা করুক।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির খবরে কালকেই তো বাজারে জিনিসের দাম বাড়বে।” তার মতে, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত একরকম, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা”।

বাজেট ঘোষণার একদিন পরই সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তারা ১০ শতাংশ এবং পরের গ্রেডের কর্মচারীরা ১৫ শতাংশ আর্থিক সুবিধা পাবেন।

এই ‘বিশেষ সুবিধা’ নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, এভাবে বেতন বৃদ্ধির চেয়ে মহার্ঘ ভাতা কার্যকর করা হলে তারা বেশি উপকৃত হতেন।

“বেতন বৃদ্ধি শুনতে ভালো লাগছে। কিন্তু এর পাশাপাশি করের হারও বাড়ানো হয়েছে, তাই লাভ হবে না। কারণ মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি”, বলছিলেন আরেক কর্মকর্তা।

একদিকে আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাব, অন্যদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধার ঘোষণা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অনেককেই বিস্মিত করেছে।

তাদের মতে, বৈষম্য দূর করার কথা বললেও, আওয়ামী লীগের দেখানো আগের পথেই হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা সেই ৪০ শতাংশ মানুষ।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, “কর হার না বাড়িয়ে কেবল করের আওতা বাড়ালেই রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু এই কঠিন পথে না গিয়ে, আগের মতো সহজ পথই বেছে নিয়েছে সরকার।”

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতির অনিশ্চয়তা দূর না করে সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’ বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক এবং সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

তাদের মতে, এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

বাজেটে রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব
ক্ষমতা গ্রহণের দশ মাসের মাথায় ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা।

এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য। বাকি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে তোলার পরেও ২ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি ঘাটতি থাকবে।

এবার বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। আগের বছরের মতোই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাৎসরিক করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাখা হয়েছে।

তবে ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য সাধারণ করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তবে এই প্রস্তাবে করদাতাদের ওপর চাপ বেড়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা করের হার ধাপে কিছু পরিবর্তন করে সাত ধাপের পরিবর্তে ছয় ধাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। যদিও সর্বোচ্চ করহার আগের মতোই ৩০ শতাংশ রাখা হয়েছে, ধাপের সীমা কমানোয় অনেকেরই করের হার বেড়ে যাবে।

সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’
২০১৫ সালের পর আর কোনো বেতন কাঠামো প্রণয়ন না হওয়ায়, অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় সরকারি চাকরিজীবীদের ‘বিশেষ সুবিধা’ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন। জুলাই থেকে এই বিশেষ প্রণোদনার হার বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে নতুন প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দশম থেকে বিশতম গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১৫ শতাংশ হারে এবং নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তারা ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন।

বাজেট ডকুমেন্ট অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় বরাদ্দ করা হয়েছে ৮৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।

ড. সেলিম রায়হান বলছেন, “বিশেষ সুবিধা” টার্মের মধ্যেই আমার আপত্তি আছে। বৈষম্য কমানোর কথা বলে কেবল সরকারি কর্মচারিদের জন্য এই বিশেষ সুবিধা দেয়া সমর্থনযোগ্য নয়।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ বিদ্যমান। ফলে বিশেষ পক্ষকে এভাবে সুবিধা দিলে তা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করবে। ৯০ শতাংশ মানুষ সরকারি চাকরিতে নেই—তাদের কোনো বিশেষ সুবিধা নেই—এটি বড় প্রশ্ন।

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ২০১৫ সালের পরে রিভিশন না হওয়া প্রসঙ্গে ড. রায়হান বলেন, “২০১৫ সালের পর এতদিন অপেক্ষা করা গেছে, তাহলে আরও এক বছরও যেত।”

তার মতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা—এসবই এখন সবচেয়ে জরুরি। সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ সুবিধা এখন অপ্রাসঙ্গিক ও সাংঘর্ষিক।

বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী এবং বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলছেন, সরকার নিজের অপচয় না কমিয়ে বরং সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়িয়ে ব্যয় আরও বাড়াচ্ছে। এতে মূলত ৪০ শতাংশ করদাতার ওপরই চাপ পড়ছে।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে যখন অন্যান্য সেক্টরের চাকরিজীবীরা সমস্যায় আছেন, তখন শুধুমাত্র সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো অনুচিত। “সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো লাগবে, কিন্তু এ মুহূর্তে নয়।”

তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ব্যক্তিখাতের ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছেন না, আর সরকারকে এই বাড়তি বেতন মেটাতে ব্যাংক থেকে আরও ঋণ নিতে হবে।

কর্পোরেট ট্যাক্স নিয়ে ব্যবসায়ীদের মন্তব্য
প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসাবান্ধব নয় বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ।

তিনি বলেন, “আগেও কিছু শ্রেণি যেভাবে সুবিধা পেতো, এবারও তা-ই হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম এবারের বাজেট ভিন্ন হবে। কিন্তু সেরকম কোনো রূপরেখা পাইনি।”

তার দাবি, অর্থনীতির শ্বেতপত্রের ভিত্তিতে বানানো এই বাজেট বাস্তব অর্থনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেনি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর কাঠামোর কারণে দেশের ব্যবসা পরিবেশে চাপ আরও বাড়বে এবং সেটি ভোক্তার ওপরও পড়বে।

ফাহিম মাশরুর বলছেন, আগে লাভ না করলেও মোট আয়ের দশমিক ৬ শতাংশ কর দিত কোম্পানিগুলো, যা এবার এক শতাংশ করা হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা নতুন চাপে পড়বেন। “এর ফলে ব্যাংকের সুদের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি এডিশনাল খরচও বাড়ছে।”

তিনি বলেন, এতে রাজস্ব বোর্ডের চাপ বাড়ছে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, একক লেনদেনে ৫ লাখ টাকার বেশি এবং বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার বেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংক শর্ত বাতিল হওয়ায় কর্পোরেট ট্যাক্সের ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক দিকও আছে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্সের শর্ত শিথিল করা হয়েছে, মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। যদিও এই সুবিধা কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় আছে।

ড. সেলিম রায়হান বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে অংশ নিলে কর্পোরেট কর হ্রাসের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তবে পুঁজিবাজারের মৌলিক দুর্বলতা সমাধান ছাড়া শুধু কর ছাড়ে কোম্পানিগুলো আগ্রহী হবে না।সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, অতীতের মতো এবারও বিভিন্ন পণ্যে করের হার বাড়ানো-কমানোর পেছনে রাজস্ব আয়ের বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

তিনি বলেন, “যখন পরিকল্পনা ছাড়া করহার বাড়ে-কমে, তখন এর বোঝা সাধারণ মানুষের ওপরই পড়ে।” বর্তমানে দেশের কর কাঠামোতে ৭০ শতাংশের বেশি পরোক্ষ কর—যার বোঝা বৈষম্যপূর্ণভাবে সাধারণ মানুষের ওপরই বেশি।

তিনি মনে করেন, “শুধু করহার বাড়িয়ে বা কিছুটা সামঞ্জস্য করে কর ব্যবস্থাপনার সংস্কার হবে না। বরং করের আওতা বাড়ানোই গুরুত্বপূর্ণ।” কিন্তু সরকার আবারও সহজ পথেই হেঁটেছে।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ রাজস্ব থেকে তোলার পরিকল্পনা নিয়েও গবেষণা সংস্থা সিপিডি সন্দেহ প্রকাশ করেছে।