ঢাকা ০৮:১৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না কুকুরছানা হত্যা মামলায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে ২ বছরের শিশু খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিতে ঢাকায় আসছেন জুবাইদা যুক্তরাজ্যের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী! কাতারের রাজপরিবারের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যেসব অত্যাধুনিক সুবিধা রয়েছে কাকরদিয়া–তেরাদল–আলিপুর এডুকেশন ট্রাস্ট ইউকের আত্নপ্রকাশ

বাংলাদেশের পর নেপাল, কতটা অস্বস্তিতে ভারত

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০৬:২৮:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / 197
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শ্রীলঙ্কার দুই বছর পর বাংলাদেশ, তার এক বছর পর নেপাল; তিন সীমানার তিন দেশে গণবিক্ষোভের মুখে সরকার পতন দেখতে হলো ভারতকে। গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) নেপালে কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) ও কংগ্রেসের জোট সরকার ফেইসবুক, ইউটিউবসহ সোশাল মিডিয়া অ্যাপ বন্ধ করে দিলে বিক্ষোভে নামে তরুণ প্রজন্ম।

সেই বিক্ষোভ দমনে সরকার কারফিউ জারি করে সেনা নামালে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে সহিংস। তাতে সোমবার ১৯ জন নিহত হলে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের পূঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে।

মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবন, মন্ত্রী-রাজনীতিকদের বাড়িতে বাড়িতে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন। তাকেসহ মন্ত্রীদের প্রাণে বাঁচাতে হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া হয় রাজধানী থেকে।

অনেকের কাছে কাঠমাণ্ডুর এই দৃশ্য গত বছর বাংলাদেশে এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া গণবিক্ষোভে সরকার পতনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হলেও নেপালের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ঐতিহাসিক; যোগাযোগ, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে বিশেষ।

নেপালের সঙ্গে পাঁচটি রাজ্য উত্তরখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, সিকিম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে ভারতের ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটারের সীমান্ত, তার অনেকটাই উন্মুক্ত।

সীমান্তের ওপারের গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি নয়া দিল্লি স্বাভাবিকভাবেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দ্রুত প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।

সহিংস সংঘাতের মধ্যে মঙ্গলবার ওলির সরকারের পতনের পরপরই এক্সে দেওয়া একটি পোস্টে তিনি লেখেন, “নেপালের সহিংসতা হৃদয়বিদারক। অনেক তরুণ প্রাণ হারিয়েছে দেখে আমি মর্মাহত।”

নেপালের স্থিতিশীলতা রক্ষার ওপর জোর দিয়ে তিনি নেপালের ‘সকল ভাই-বোনকে’ শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানান।

মঙ্গলবার মোদী তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে নেপাল পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাও করেন।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় গণবিক্ষোভে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের দেশ ছেড়ে পালানোর মতো নেপালের ঘটনাও ভারতকে অবাক করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বিশেষ করে, কে পি শর্মা ওলির দিল্লি সফরের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার সরকারের পতনের এই ঘটনা অবাক করেছে অনেককে।

নেপালের ভৌগলিক অবস্থান কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দেশটিতে যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য উদ্বেগের।

নেপাল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বিবিসিকে বলেন, “চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড নেপালের ঠিক বিপরীতে। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি নেপাল দিয়েই গঠিত হয়ে নিচে এসেছে।”

এই অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে ভারতে থাকা নেপালিদের ওপরও। আনুমানিক ৩৫ লাখ নেপালি ভারতে বিভিন্ন কাজে যুক্ত রয়েছে। সংখ্যাটি এর বেশিও হতে পারে।

নেপাল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ এবং সীমান্তের এলাকাগুলোতে উভয় দেশের মানুষের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে।

উভয় দেশের মানুষ ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই যাতায়াত করতে পারে। ১৯৫০ সালের একটি চুক্তির অধীনে নেপালিরা ভারতে কোনও বাধা ছাড়াই কাজ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটানের পাশাপাশি নেপালই একমাত্র দেশ, যাদের ভারত এই ধরনের সুবিধা দেয়।

এছাড়া বিশেষ এক চুক্তির আওতায় নেপালের ৩২ হাজার গোর্খা সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সংযুক্ত।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) অধ্যাপক সঙ্গীতা থাপলিয়ালের মতে, যেহেতু সীমান্ত উন্মুক্ত, তাই উভয় দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উভয় দিকের পরিবারগুলো একে অন্যের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান নেপালে। যার মধ্যে হিমালয়ের কোলঘেঁষা মুক্তিনাথ মন্দির অন্যতম। প্রতি বছর ভারত থেকে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এই মন্দিরে পূজা দিতে যায়।

অন্যদিকে কাঠমান্ডু ভারতীয় পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, বিশেষত তেল এবং খাদ্যের জন্য। ভারত-নেপালের বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৮৫০ কোটি ডলারের।

বুধবার কাঠমান্ডুতে সহিংসতা বন্ধ হয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের তোড়জোড় আপাত শান্তি ফেরার ইঙ্গিত দিলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতকে একটি কঠিন কূটনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যেতে হবে। কারণ নেপালি বিক্ষোভকারীদের সেদেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে নিয়েই ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে।

নয়া দিল্লি আবার এই তিনটি দলের- ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (সিপিএন – ইউএমএল), শের বাহাদুর দেউবা নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেস এবং পুষ্প কমল দাহাল (প্রচণ্ড) নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী কেন্দ্র)- সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে।

‘হিমালয়কন্যা’ নেপালকে নিজের বলয়ে রাখতে ভারত ও চীন উভয়ই সব সময় সচেষ্ট। দেশ দুটির বিরুদ্ধে নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে।

নেপালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সেনাবাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও এই সরকারের প্রকৃতি কেমন হবে, সে বিষয়ে কোনও ধারণা এখনও মিলছে না।

অধ্যাপক থাপলিয়ালের মতে, যেহেতু নতুন সরকার বা নেতৃত্বের আকার অনিশ্চিত, ভারত সতর্ক থাকবে। কারণ নয়া দিল্লি আরেকটি বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি চাইবে না।

বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নয়া দিল্লির ছিল নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু তাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার পর নয়া দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক বেশ শীতল।

নেপাল ও ভারতের মধ্যেও কিছু বিরোধও ছিল, যা এখন দিল্লিকে অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে সামলাতে হবে।

২০১৯ সালে ভারত একটি মানচিত্র প্রকাশ করার পর নেপালিরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল, কারণ সেই মানচিত্রে চীনের সীমান্তের কাছাকাছি একটি অঞ্চলকে ভারতের ভূখণ্ড হিসেবে দেখানো হয়, যা নেপালও তাদের ভূখণ্ড দাবি করে।

কাঠমান্ডুও তখন নিজস্ব মানচিত্র প্রকাশ করে বিতর্কিত অঞ্চলগুলো নেপালের অংশ হিসাবে দেখায়। তার ফলে কূটনৈতিক টানাপড়েন দেখা দেয়।

সম্প্রতি, ভারত ও চীন একটি বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় বাণিজ্য পুনরায় শুরু করতে একমত হয়, যা আবার নেপালের দাবি করা এলাকা।

গত মাসে চীন সফরকালে অলি এই বিষয়টি চীনা নেতৃত্বের কাছে উত্থাপন করে ‘লিপুলেখ পাস’কে একটি বাণিজ্য রুট হিসাবে ব্যবহারের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসেন। তবে এরপর ভারত সফরে যাওয়ার ঠিক আগেই ক্ষমতাচ্যুত হলেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত নেপালের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে যেকোনো মতপার্থক্য নিরসনে যোগাযোগ করবে এবং ক্ষুব্ধ নেপালি জেন জিদের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাইবে।

অধ্যাপক থাপলিয়াল বলেন, “নেপালি তরুণদের তাদের দেশের মধ্যে সুযোগ সীমিত। ভারতের উচিৎ নেপালি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি বাড়ানো এবং আরও বেশি চাকরির সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা।”

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) নিষ্ক্রিয় থাকায় ভারতের পক্ষে তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অস্থিতিশীলতা মোকাবেলা করা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নেপালের সঙ্কট এমন এক সময় তৈরি হলো, যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রয়েছে তলানিতে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে জমেছে বরফ, মিয়ানমারে চলছে গৃহযুদ্ধ।

“ভারত বৃহৎ শক্তি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে প্রতিবেশীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু তার সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্যও নিরাপদ এবং স্থিতিশীল প্রতিবেশী থাকা প্রয়োজন,” বলছেন মেহতা।

তথ্যসূত্র : বিবিসি

নিউজটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশের পর নেপাল, কতটা অস্বস্তিতে ভারত

আপডেট সময় : ০৬:২৮:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শ্রীলঙ্কার দুই বছর পর বাংলাদেশ, তার এক বছর পর নেপাল; তিন সীমানার তিন দেশে গণবিক্ষোভের মুখে সরকার পতন দেখতে হলো ভারতকে। গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) নেপালে কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) ও কংগ্রেসের জোট সরকার ফেইসবুক, ইউটিউবসহ সোশাল মিডিয়া অ্যাপ বন্ধ করে দিলে বিক্ষোভে নামে তরুণ প্রজন্ম।

সেই বিক্ষোভ দমনে সরকার কারফিউ জারি করে সেনা নামালে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে সহিংস। তাতে সোমবার ১৯ জন নিহত হলে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের পূঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে।

মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবন, মন্ত্রী-রাজনীতিকদের বাড়িতে বাড়িতে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন। তাকেসহ মন্ত্রীদের প্রাণে বাঁচাতে হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া হয় রাজধানী থেকে।

অনেকের কাছে কাঠমাণ্ডুর এই দৃশ্য গত বছর বাংলাদেশে এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া গণবিক্ষোভে সরকার পতনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হলেও নেপালের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ঐতিহাসিক; যোগাযোগ, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে বিশেষ।

নেপালের সঙ্গে পাঁচটি রাজ্য উত্তরখণ্ড, উত্তর প্রদেশ, সিকিম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে ভারতের ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটারের সীমান্ত, তার অনেকটাই উন্মুক্ত।

সীমান্তের ওপারের গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি নয়া দিল্লি স্বাভাবিকভাবেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দ্রুত প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।

সহিংস সংঘাতের মধ্যে মঙ্গলবার ওলির সরকারের পতনের পরপরই এক্সে দেওয়া একটি পোস্টে তিনি লেখেন, “নেপালের সহিংসতা হৃদয়বিদারক। অনেক তরুণ প্রাণ হারিয়েছে দেখে আমি মর্মাহত।”

নেপালের স্থিতিশীলতা রক্ষার ওপর জোর দিয়ে তিনি নেপালের ‘সকল ভাই-বোনকে’ শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানান।

মঙ্গলবার মোদী তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে নেপাল পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাও করেন।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় গণবিক্ষোভে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের দেশ ছেড়ে পালানোর মতো নেপালের ঘটনাও ভারতকে অবাক করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বিশেষ করে, কে পি শর্মা ওলির দিল্লি সফরের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার সরকারের পতনের এই ঘটনা অবাক করেছে অনেককে।

নেপালের ভৌগলিক অবস্থান কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দেশটিতে যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য উদ্বেগের।

নেপাল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বিবিসিকে বলেন, “চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড নেপালের ঠিক বিপরীতে। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি নেপাল দিয়েই গঠিত হয়ে নিচে এসেছে।”

এই অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে ভারতে থাকা নেপালিদের ওপরও। আনুমানিক ৩৫ লাখ নেপালি ভারতে বিভিন্ন কাজে যুক্ত রয়েছে। সংখ্যাটি এর বেশিও হতে পারে।

নেপাল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ এবং সীমান্তের এলাকাগুলোতে উভয় দেশের মানুষের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে।

উভয় দেশের মানুষ ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই যাতায়াত করতে পারে। ১৯৫০ সালের একটি চুক্তির অধীনে নেপালিরা ভারতে কোনও বাধা ছাড়াই কাজ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটানের পাশাপাশি নেপালই একমাত্র দেশ, যাদের ভারত এই ধরনের সুবিধা দেয়।

এছাড়া বিশেষ এক চুক্তির আওতায় নেপালের ৩২ হাজার গোর্খা সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সংযুক্ত।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) অধ্যাপক সঙ্গীতা থাপলিয়ালের মতে, যেহেতু সীমান্ত উন্মুক্ত, তাই উভয় দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উভয় দিকের পরিবারগুলো একে অন্যের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান নেপালে। যার মধ্যে হিমালয়ের কোলঘেঁষা মুক্তিনাথ মন্দির অন্যতম। প্রতি বছর ভারত থেকে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এই মন্দিরে পূজা দিতে যায়।

অন্যদিকে কাঠমান্ডু ভারতীয় পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, বিশেষত তেল এবং খাদ্যের জন্য। ভারত-নেপালের বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৮৫০ কোটি ডলারের।

বুধবার কাঠমান্ডুতে সহিংসতা বন্ধ হয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের তোড়জোড় আপাত শান্তি ফেরার ইঙ্গিত দিলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতকে একটি কঠিন কূটনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যেতে হবে। কারণ নেপালি বিক্ষোভকারীদের সেদেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে নিয়েই ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে।

নয়া দিল্লি আবার এই তিনটি দলের- ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (সিপিএন – ইউএমএল), শের বাহাদুর দেউবা নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেস এবং পুষ্প কমল দাহাল (প্রচণ্ড) নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী কেন্দ্র)- সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে।

‘হিমালয়কন্যা’ নেপালকে নিজের বলয়ে রাখতে ভারত ও চীন উভয়ই সব সময় সচেষ্ট। দেশ দুটির বিরুদ্ধে নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে।

নেপালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সেনাবাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আলোচনা চললেও এই সরকারের প্রকৃতি কেমন হবে, সে বিষয়ে কোনও ধারণা এখনও মিলছে না।

অধ্যাপক থাপলিয়ালের মতে, যেহেতু নতুন সরকার বা নেতৃত্বের আকার অনিশ্চিত, ভারত সতর্ক থাকবে। কারণ নয়া দিল্লি আরেকটি বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি চাইবে না।

বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নয়া দিল্লির ছিল নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু তাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার পর নয়া দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক বেশ শীতল।

নেপাল ও ভারতের মধ্যেও কিছু বিরোধও ছিল, যা এখন দিল্লিকে অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে সামলাতে হবে।

২০১৯ সালে ভারত একটি মানচিত্র প্রকাশ করার পর নেপালিরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল, কারণ সেই মানচিত্রে চীনের সীমান্তের কাছাকাছি একটি অঞ্চলকে ভারতের ভূখণ্ড হিসেবে দেখানো হয়, যা নেপালও তাদের ভূখণ্ড দাবি করে।

কাঠমান্ডুও তখন নিজস্ব মানচিত্র প্রকাশ করে বিতর্কিত অঞ্চলগুলো নেপালের অংশ হিসাবে দেখায়। তার ফলে কূটনৈতিক টানাপড়েন দেখা দেয়।

সম্প্রতি, ভারত ও চীন একটি বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় বাণিজ্য পুনরায় শুরু করতে একমত হয়, যা আবার নেপালের দাবি করা এলাকা।

গত মাসে চীন সফরকালে অলি এই বিষয়টি চীনা নেতৃত্বের কাছে উত্থাপন করে ‘লিপুলেখ পাস’কে একটি বাণিজ্য রুট হিসাবে ব্যবহারের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসেন। তবে এরপর ভারত সফরে যাওয়ার ঠিক আগেই ক্ষমতাচ্যুত হলেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত নেপালের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে যেকোনো মতপার্থক্য নিরসনে যোগাযোগ করবে এবং ক্ষুব্ধ নেপালি জেন জিদের সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাইবে।

অধ্যাপক থাপলিয়াল বলেন, “নেপালি তরুণদের তাদের দেশের মধ্যে সুযোগ সীমিত। ভারতের উচিৎ নেপালি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি বাড়ানো এবং আরও বেশি চাকরির সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা।”

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) নিষ্ক্রিয় থাকায় ভারতের পক্ষে তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অস্থিতিশীলতা মোকাবেলা করা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নেপালের সঙ্কট এমন এক সময় তৈরি হলো, যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রয়েছে তলানিতে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে জমেছে বরফ, মিয়ানমারে চলছে গৃহযুদ্ধ।

“ভারত বৃহৎ শক্তি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে প্রতিবেশীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু তার সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্যও নিরাপদ এবং স্থিতিশীল প্রতিবেশী থাকা প্রয়োজন,” বলছেন মেহতা।

তথ্যসূত্র : বিবিসি