বিশ্ব প্রবীণ দিবস: কতটা পাশে আছি আমরা তাঁদের?
- আপডেট সময় : ০২:৫৪:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ অক্টোবর ২০২৫
- / 271
“নবীনরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, আর প্রবীণরা সেই স্বপ্নের ভিত্তিপ্রস্তর”-এই কথাটির গভীরে যে মানবিকতা, তা উপলব্ধি করা যায় তখনই, যখন আমরা প্রবীণদের চোখে জীবনের অভিজ্ঞতা, ত্যাগ আর নীরব ভালোবাসা দেখি। প্রতিটি সমাজের প্রাণ তার প্রবীণ জনগোষ্ঠী। তারা ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। আমাদের মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। আর সেই শ্রদ্ধাবোধ থেকে জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস, যা প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় প্রবীণদের সম্মান, অধিকার ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে।

এই থিমটি প্রবীণদেরকে কেবল সেবা গ্রহণকারী হিসেবে নয়, বরং সমাজের সক্রিয় নীতিনির্ধারক, নেতৃত্বদাতা ও পরিবর্তনের চালক হিসেবে তুলে ধরে। প্রবীণরা নিজেদের স্বপ্ন, কল্যাণ ও অধিকার নিয়ে আজ আরও সচেতন ও সোচ্চার। তারা শুধু অতীতের গর্ব নন, বর্তমানের শক্তিও বটে। খুব সচেতনভাবেই বলা যায়- প্রবীণরাই আমাদের জীবনের আলো।
প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে, জীবন যাত্রার মান কমছে !
বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় বিশ্বজুড়ে মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দিন বেঁচে থাকেন। ৬০ বছর বা তদূর্ধ্বদেরকে প্রবীণ বলা হয়। ২০১৫ সালে বিশ্বের প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০০ মিলিয়ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( WHO) এর তথ্য মতে, এই সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে ২ বিলিয়নে পৌঁছাবে। অর্থাৎ, তখন বিশ্বের প্রতি পাঁচজনের একজন হবেন প্রবীণ।
মন খারাপের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ভবিষ্যতের এই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ৮৫% বসবাস করবেন নিম্ন ও মধ্য-আয়ের দেশগুলোতে—যেমন বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল ও চীন।
এসব দেশে এমনিতেই প্রবীণদের মানষিক ও স্বাস্থ্যসেবা বিরাট ঝুঁকিতে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের কনসার্ন জানিয়ে বলেছে- খুব কম সময়ের মধ্যেই স্বাস্থ্য, সেবা ও সামাজিক কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে হবে, যেন প্রবীণদের জীবন মানসম্মত হয়।
নির্মম বাস্তবতা হলো- এখন পর্যন্ত এসব দেশে প্রবীণদের নিয়ে বাস্তবভিত্তিক কোন সুনিদৃষ্ট প্রদক্ষেপ নেয়নি।
কোন দেশগুলো সবচেয়ে ভালো প্রবীণবান্ধব?
আলোর কথা হলো বিশ্বের উন্নত অনেক দেশ প্রবীণদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ তৈরি করেছে।
সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশ প্রবীণদের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্পন্ন আবাসন ও সামাজিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করেছে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে অনুকরণীয় দেশ হলো জাপান। দেশটি প্রবীণবান্ধব সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে সুস্থ প্রবীণ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে, যেখানে গড় আয়ু ৮৪.৯ বছর।
পূর্ব এশীয় দেশগুলো যেমন চীন, কোরিয়া ও জাপান প্রবীণদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। ‘Filial piety’ বা পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ববোধ তাদের সংস্কৃতির একটি মৌলিক দিক। এই দেশগুলোর প্রায় ৭৫% প্রবীণ থাকেন তাদের সন্তানদের সঙ্গে।
বিপরীতে, অনেক পশ্চিমা সমাজে প্রবীণরা একাকীত্বে ভোগেন। পশ্চিমা সমাজে প্রবীণদের মূল্যায়ন অনেক সময় কম দেখা যায়, যেখানে বয়সকে ‘দুর্বলতা’ হিসেবে দেখা হয়।
বার্ধক্যে একাকীত্ব: প্রতিরোধের পথ কী?
বার্ধক্যের অন্যতম এক কঠিন বাস্তবতা হলো- একাকীত্ব। গবেষকরা বলছেন, প্রবীণদের কিছু সহজ অভ্যাস ও সংযোগই হতে পারে এর প্রতিষেধক,যেমন বন্ধুর সাথে নিয়মিত কথা বলা বা দেখা করা, প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্তান-নাতিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, স্থানীয় সংগঠনে যুক্ত হওয়া, স্বেচ্ছাসেবায় অংশ নেওয়া, নিজের গল্প ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া ইত্যাদির সমন্বয় থাকলে জীবনের শেষ অধ্যায়ও হতে পারে প্রাণবন্ত।
তবে মোটাদাগে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন একটি প্রণিধানযোগ্য কথা –‘‘যদি আমরা প্রবীণদের পাশে থাকি“।
প্রবীণদের নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ইতিবাচক তথ্য প্রকাশ করেছে জাপান। প্রবীণরা যত্ন,স্নেহ,ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় থাকলে তাদের জীবন -যাপনে বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন আসে জানিয়েছে জাপানের একদল গবেষক। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে- ‘‘যারা বার্ধক্যকে নেতিবাচক নয়, বরং প্রজ্ঞা ও অর্জনের সময় হিসেবে ভাবেন, তাদের গড় আয়ু বেড়ে যায় প্রায় ৭.৫ বছর।’’
অর্থাৎ, বার্ধক্যকে আনন্দ ও গৌরবের বয়স হিসেবে দেখলে শরীর-মন উভয় ভালো থাকে।
ধর্মের চোখে প্রবীণদের মর্যাদা
ইসলামে প্রবীণদের প্রতি সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনে বলা হয়েছে:
“…যদি তোমার নিকট তাঁদের (পিতা-মাতা) একজন অথবা উভয়ের বার্ধক্য অবস্থায় উপনীত হন, তবে তুমি তাঁদেরকে ‘উহ’ শব্দও বলো না এবং ধমক দিও না; বরং সম্মানজনক কথা বলো।”
— সূরা আল-ইসরা, আয়াত ২৩
আরেকটি হাদিস হলো, ‘আমি কি তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তির সংবাদ দেব না? তারা বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে দীর্ঘায়ু লাভ করে এবং সুন্দর আমল করে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
হজরত জারবি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একজন বয়স্ক লোক রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করতে আসল। লোকেরা তার জন্য পথ ছাড়তে বিলম্ব করে। তা দেখে রাসুল (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না, সে আমাদের উম্মত নয়।’ (তিরমিজি : ১৯১৯)।
বুখারি শরীফের ৩১৭৩ হাদিসটি হলো- একবার তিন সাহাবি আব্দুর রহমান বিন সাহাল, মুহাইয়্যাসাহ এবং খুয়াইসা ইবনে মাসুদ নবীজির দরবারে গেলেন। আব্দুর রহমান বিন সাহাল প্রথমে কথা বলতে শুরু করলেন। নবীজি তাঁকে থামিয়ে বললেন, বড়কে আগে কথা বলতে দাও। (কারণ তিনি সবার ছোট ছিলেন) তিনি তখন চুপ হয়ে গেলেন। বাকি দুজন কথা বলা শুরু করলেন।
অভিজ্ঞতার এই মণিমুক্তোরাই আমাদের আলো । পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে প্রবীণরা আমাদের অমূল্য সম্পদ। আমরা হয়তো অবচেতনে ভুলে যাচ্ছি যে, যাপিত জীবনে, দিন দিন আমরাও ‘প্রবীণ‘ নামক একাকী বাড়ির দিকেই হাটছি! আত্নকেন্দ্রীক আমরা বার বার ভুলে যাচ্ছি- তাদের স্নেহ, মমতা,শিক্ষা, দিকনির্দেশনায় আজ আমরা কেউ তরুণ, কেউ যুবক, কেউ একটু বেশী অভিজ্ঞ, সামর্থবান হলেও ঐসময় আমাদের দুয়ারে নিকট ভবিষ্যতে কড়া নাড়বে!
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ( AI) কী কেড়ে নিবে নবীন-প্রবীণ বন্ধন:
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স- এ পা রাখা তারুণ্য হাতের মুঠোয় সকল তথ্য- উপাত্ত নিয়ে চললেও কিছু অমৃত বিষয় ও উপকরণের বিকল্প কোনভাবেই পাওয়া সম্ভব নয় – তা হলো মানুষের স্নেহ, মমতা, আদর, ভালোবাসা। এবং এগুলো দেয়া ও নেয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন। নিখাদভাবে পরিবার ও সমাজ থেকে এসব একজন মানুষ সবচেয়ে বেশী বিনিময়হীন, অকৃত্রিমভাবে অগ্রজদের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে।
প্রবীণরাই আমাদের জীবনবোধের আলো – আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এনিয়ে এখনও বিকল্প কোন যুক্তি বা উদাহরণ সত্যাশ্রিতভাবে দাড় করাতে পারেনি।
আমরা যারা তরুণ অথবা যুবা, তাদের কাছে প্রবীণরা নিছক দায়িত্ব নয়—তারা আমাদের জীবনের গল্পকার, আমাদের পরিচয়ের শিকড়, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য শিক্ষার বাতিঘর।
তাদের জীবনের প্রতিটি ভাঁজে রয়েছে অভিজ্ঞতার অমূল্য রত্ন। তাদের শ্রদ্ধা জানানো মানে আমাদের অতীতকে সম্মান করা। এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি আত্ন নির্ভরশীল ও মানবিক নৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা।
এই আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে আমাদের প্রত্যয় হোক- বৈষম্যহীন সমাজের। যেখানে বয়স নয়, মানুষই হবে সম্মান পাওয়ার প্রধান মানদণ্ড। প্রবীণদের শুধু বেঁচে থাকার নয়, ভালোভাবে বাঁচার অধিকার দেয়াও রাস্ট্র, সমাজ,পরিবারের অন্যতম দায়িত্ব। তারাই আমাদের আজকের আলো, আর কালকের প্রেরণা।
১ অক্টোরকে শুধু নিছক দিন হিসাবে উদযাপন না করে এইদিনে নিজের ব্যক্তিগত জীবন পাল্টে দেয়ার একটি প্রতিশ্রুতি করা যেতে পারে : আজ থেকে বাবা-মা সহ সকল প্রবীণদের সম্মান, যত্ন সহ প্রতিদিন কিছুটা “কোয়ালিটি সময়” ব্যয় করবো।
এই কাজের জন্য আমাদের ব্যক্তিগত সংকল্পই দুপক্ষের জীবনবোধ পাল্টে দিতে যথেষ্ট।
পৃথিবীর সকল বাবা-মা ভালো থাকুন। সকল প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আনোয়ারুল ইসলাম অভি, কবি, সাংবাদিক, সোশ্যাল এন্টারপ্রেনার
১ অক্টোবর,লন্ডন ।



















