নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যমুনা-কেন্দ্রিক আন্দোলন: আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা, নাকি কৌশলগত অবস্থান?
- আপডেট সময় : ০২:০৯:০১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
- / 243

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নিষেধাজ্ঞার পরও থামছে না যমুনা-কেন্দ্রিক সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বিবেচিত মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার আশপাশে সভা, মিছিল ও গণজমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংগঠন সেখানে কর্মসূচি পালন করছে। এতে প্রশ্ন উঠছে—রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সন্নিকটে নিয়মিত এসব আন্দোলন বন্ধে আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? তবে পুলিশ বলছে, জনদুর্ভোগ এড়াতেই তারা কঠোর না হয়ে কৌশলগতভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদন করেছেন আরমান ভূঁইয়া।
জনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিএমপি কমিশনার পুলিশের অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং III/৭৬)-এর ২৯ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সচিবালয় ও যমুনার আশপাশে যেকোনো ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সর্বশেষ গত ১০ মে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সই করা এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়—বাংলাদেশ সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও সংলগ্ন এলাকা (ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল মোড়, শাহবাগ মোড়, কাকরাইল মোড়, মিন্টো রোড) পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা ও গণজমায়েত নিষিদ্ধ থাকবে। একই ধরনের বিজ্ঞপ্তি ১৩ মার্চ এবং ২০২৪ সালের ২৬ আগস্টেও জারি হয়েছিল।
তারপরও একের পর এক কর্মসূচি
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো নিয়মিতভাবে যমুনা ও আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ছাত্র সংগঠন একের পর এক কর্মসূচি পালন করছে ওই এলাকায়। গত ৮ ও ৯ মে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ কয়েকটি সংগঠন আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনার সামনে অবস্থান নেয়। এরপর ১৪ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যমুনার দিকে লং মার্চ করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। পরে তারা প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে রাতভর অবস্থান এবং পরদিনও কর্মসূচি চালান। ২০ মে পোশাক শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং তারাও প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের এলাকায় অবস্থান করেন। সর্বশেষ ২১ ও ২২ মে দুই দিন ধরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ইশরাককে মেয়র করার দাবিতে যমুনা-কেন্দ্রিক সভা-সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এছাড়া ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাম্য হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রদল ও ঢাবি শিক্ষার্থীরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য কী?
২০ মে কাকরাইল মসজিদের সামনে বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন টিএনজেড গ্রুপের শতাধিক পোশাক শ্রমিক। নিষিদ্ধ এলাকায় আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমিক নেতা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, “আমরা কয়েক মাস ধরে জাতীয় শ্রম ভবনের সামনে আন্দোলন করছিলাম। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনো সমাধান আসেনি। তাই ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করেছি। আর এতে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি ভালো সমাধান পাওয়া গেছে।”
একই প্রশ্নে জবাব দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহিমুর রহমান। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে কিছুই ছোট পরিসরে সমাধান হয় না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে না গেলে দাবি পূরণ হয় না। গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমাদের দাবি জানালেও কোনো সমাধান আসেনি। যখন ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করি, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও রাতভর আন্দোলনের পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সমাধানের আশ্বাস পাওয়া গেছে। তাই বাধ্য হয়েই ওই এলাকায় আন্দোলনে যেতে হয়েছে।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নের মুখে
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আইন প্রয়োগে ধারাবাহিকতা না থাকলে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে যায়। একই এলাকায় কিছু কর্মসূচি দমন করা হলেও অন্যগুলো নির্বিঘ্নে চললে পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত দেয়। কোথাও কোথাও পুলিশ বাধা দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নীরব থাকছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে—ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে না কেন? প্রশাসন কি ইচ্ছাকৃতভাবেই নমনীয় ভূমিকা নিচ্ছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজ বলছেন, একই এলাকায় বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা কার্যকর না হলে এর কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে। তাদের মতে, আইন সমভাবে প্রয়োগ না হলে রাজনৈতিক বিভাজন বাড়বে এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে সন্দেহ তৈরি হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মুখপাত্র উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। কেউ আইন ভাঙলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কখনো কখনো পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা কৌশলী হই, যেন জনদুর্ভোগ না বাড়ে। আমরা চেষ্টা করছি কম বলপ্রয়োগে আইন প্রয়োগ ও তা মানতে বাধ্য করানো। তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
আইন প্রয়োগে সমতা, কঠোরতা ও স্বচ্ছতা জরুরি
যমুনা-কেন্দ্রিক এলাকায় পুলিশের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এতে শুধু নিরাপত্তা নয়, প্রশাসনিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রশ্নও উঠে আসছে। বিশ্লেষকদের মতে, আইন বাস্তবায়নে সমতা, কঠোরতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে নিষেধাজ্ঞাগুলো কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক মনে করেন, পুলিশকে শুধু কঠোর হলেই চলবে না, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি কৌশলগতও হতে হবে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বর্তমানে পুলিশের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা কিছুটা কমে গেছে। শুধু কঠোর অবস্থান নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তাই আন্দোলনকারীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়াতে বাহিনীকে কৌশলে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আন্দোলনকারী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ও আগেভাগে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া জরুরি।”


















