নরসিংদীর মাধবদী কীভাবে শক্তিশালী ভূমিকম্পের কেন্দ্রে পরিণত হলো?
- আপডেট সময় : ১২:৫০:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
- / 94
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী নরসিংদীর মাধবদীতে শুক্রবার যে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল, তার প্রভাবে কেঁপে ওঠে ঢাকাসহ সারা দেশ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন অন্তত দশ জন এবং আহত হয়েছেন পাঁচশোর বেশি মানুষ।
ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নরসিংদীর মাধবদী উপজেলায়, মাটির প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়, তা আগেই জমে থাকা শক্তির ফল বলে জানিয়েছেন দেশি–বিদেশি সংস্থা ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানায়, বাংলাদেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ এই ভূমিকম্পে মৃদু বা মাঝারি ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন।
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পটিকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ কম্পন বলে উল্লেখ করেছে আবহাওয়া বিভাগও।
এর পরদিন শনিবার আবারও মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। আবহাওয়া অফিস জানায়, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ৩ দশমিক ৩, যার কেন্দ্র ছিল নরসিংদীর পলাশ উপজেলা।
ফলে প্রশ্ন উঠেছে—মাধবদীর ভূমিকম্প ঢাকায় এত তীব্র ঝাঁকুনি সৃষ্টি করল কেন? কিংবা এ সম্পর্কে আর কী তথ্য জানা যাচ্ছে?
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার মনে করেন, ভূগর্ভে ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনই মাধবদী ভূমিকম্পের মূল কারণ।
মাধবদীর ভূমিকম্প বিষয়ে আরও যা জানা যায়
বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যায়, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ কয়েকটি টেকটনিক প্লেটে বিভক্ত, যেগুলো তরল পদার্থের ওপর ভাসমান অবস্থায় একে অপরের সাপেক্ষে চলাচল করছে। এই চলাচলের ফলে বিভিন্ন স্থানে সাব-প্লেট বা ফল্ট লাইন তৈরি হয়। বাংলাদেশেও এমন কয়েকটি ফল্ট লাইন রয়েছে।
প্লেটগুলো যখন সরে যায়, ধাক্কা খায় বা আটকে যায়, তখন শক্তি জমা হতে থাকে। শিলা সেই চাপ সহ্য করতে না পারলে পুরোনো বা নতুন ফাটল ভেঙে শক্তি হঠাৎ বেরিয়ে আসে—এটাই ভূমিকম্প।
ইউএসজিএস জানায়, ১৯৫০ সালের পর ওই অঞ্চলে ৫ দশমিক ৫ বা তার বেশি মাত্রার অন্তত ১৪টি ভূমিকম্প হয়েছে।
বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের প্রধান দুই উৎস হলো—
-
ডাউকি ফল্ট: ময়মনসিংহ-জামালগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলে বিস্তৃত প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ফল্ট লাইন।
-
সিলেট–চট্টগ্রাম–পার্বত্য চট্টগ্রাম–টেকনাফ হয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত আরেকটি ভয়াবহ উৎস।
টেকটনিক অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশে পশ্চিমে ইন্ডিয়ান প্লেট, পূর্বে বার্মা প্লেট, আর উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেট অবস্থিত।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার জানান, ইন্ডিয়ান প্লেট পূর্ব দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে বার্মা প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে, ফলে একটি শক্তিশালী সাবডাকশন জোন তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের এই সেগমেন্টে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি জমা হয়ে আছে। এটি বের হবেই।”
তার মতে, মাধবদীর কেন্দ্রস্থল সেই সাবডাকশন সেগমেন্টেই এবং সেখানকার প্লেট লকড ছিল। ক্ষুদ্র অংশ খুলে যাওয়াতেই শুক্রবারের ভূমিকম্প হয়েছে।
তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, “অল্প শক্তি বেরিয়ে যাওয়ায় সামনে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল।”
এদিকে, শনিবার মাধবদীর পর একই জেলার পলাশ উপজেলায় ৩ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির।
৮০০ বছর ধরে শক্তি জমছে
বিশেষজ্ঞদের মতে, সংশ্লিষ্ট প্লেট সীমানায় আট শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে শক্তি জমা হচ্ছে। সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন—“এ শক্তি বের হওয়াই নিয়ম। মাধবদীর ভূমিকম্পের কারণে সামনে এটি আরও সহজে বের হতে পারে। তা হলে ঢাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
ইতিহাস বলছে, বড় ভূমিকম্পে নদীর গতিপথও বদলে যেতে পারে—
-
১৭৯৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদ নতুন পথ নেয়।
-
১৭৬২ সালের ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার উপরে উঠে আসে।
-
১৯২২ ও ১৮৬৮ সালে সিলেট–মৌলভীবাজার–কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়েছিল।
-
১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্ট অঞ্চলে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন—যে উৎসেই বড় ভূমিকম্প ঘটুক, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে সবচেয়ে বড় ক্ষতির ঝুঁকি ঢাকাতেই।

















