ঢাকা ০৭:৩২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা

তারেক, বাবরসহ সব আসামির খালাসের রায় বহাল
‘নিহতদের আত্মার সুবিচার নিশ্চিতে স্বাধীন তদন্ত প্রয়োজন’ রায় থেকে বাদ

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০২:০৪:১০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / 142

২১ আগস্টে গ্রেনেড হামালার স্থল

অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীবিরোধী সমাবেশে ২১ বছর আগে চালানো গ্রেনেড হামলার বহুল আলোচিত মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামির খালাস বহাল রেখেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারকের আপিল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণা করে।

হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ সংশোধন

খালাসের রায় বহাল রাখলেও হাই কোর্টের রায়ের একটি অংশ সংশোধন করেছে আপিল বিভাগ। হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছিল, ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঠিক ও স্বাধীন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্ট সেই অংশ চূড়ান্ত রায়ে বাদ দিয়েছে।

আলোচিত হামলার পটভূমি

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে চালানো গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হয়। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তোলে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে ২০১২ সালে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলায় অংশ নেয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি)-এর জঙ্গিরা, যারা বিদেশি জঙ্গিদের সহযোগিতা নেয়। তদন্তে উঠে আসে, তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’ ছিল এই ষড়যন্ত্রের পেছনে। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয় পাকিস্তান থেকে।

জজ আদালতের রায়

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জজ আদালত বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল।

২০১৮ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন মন্তব্য করেছিলেন, “‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ এই হামলা ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা।” তিনি আরও বলেন, “রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ থাকবেই। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করা গ্রহণযোগ্য নয়।”

হাই কোর্টের রায়

দণ্ডিত আসামিরা আপিল করেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আবেদন ‘ডেথ রেফারেন্স’ আকারে হাই কোর্টে যায়।

২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর হাই কোর্টের বেঞ্চ (বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেন) আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আবেদন খারিজ করে দেয়। আপিল না করা আসামিরাও খালাস পান।

হাই কোর্ট মন্তব্য করে, পুনঃতদন্তের আদেশ ছিল ‘আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’, আর সম্পূরক অভিযোগপত্রও ছিল ‘অবৈধ’। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল—
“সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করার ভিত্তি অবৈধ এবং আইনের বিচারে তা টেকে না।”

জনমতের প্রশ্ন

হাই কোর্টের রায়ের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তোলেন— গ্রেনেড হামলায় নিহত ২৪ জনের পরিবার কি তবে সুবিচার থেকে বঞ্চিত হবে?

১৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৭৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ২১ আগস্টের হামলা দেশের ইতিহাসে ‘একটি জঘন্য ও মর্মান্তিক’ ঘটনা। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমান।

রায়ে বলা হয়, “নিহতদের আত্মার প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে সঠিক ও স্বাধীন তদন্ত প্রয়োজন, যা এখনো এই মামলায় অনুপস্থিত। এজন্য মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত, যাতে দক্ষ সংস্থার মাধ্যমে পুনরায় তদন্ত করা যায়।”

তবে আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে হাই কোর্টের এই অংশ বাদ দেয়।

রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের অবস্থান

রাষ্ট্রপক্ষ চেয়েছিল জজ আদালতের দেওয়া সাজার রায় বহাল রাখতে। অন্যদিকে আসামিপক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে হাই কোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখার আবেদন করে। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের আবেদনই নাকচ হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্যাহ আল মাহমুদ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবু সাদাত মো. সায়েম ভূঞা ও সাদিয়া আফরিন। আসামিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।

কী ঘটেছিল সেদিন?

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল। মাঝখানে ট্রাক এনে মঞ্চ বানানো হয়েছিল।

শেখ হাসিনা ভাষণ শেষে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে গুলির শব্দ।

রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে শত শত জুতো-স্যান্ডেল, রক্তাক্ত দেহ, আহতদের আর্তনাদ। আহতদের বাঁচাতে এগিয়ে গেলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। অভিযোগ ওঠে, পুলিশ আলামত নষ্ট করতে তৎপর হয়।

ঘটনাস্থলেই মারা যান ১৬ জন। আইভী রহমান হাসপাতালে ৫৮ ঘণ্টা লড়াই করে মারা যান। পরে আরও অনেকে মারা যান— সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।

মঞ্চে নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। তবে গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মামলা বৃত্তান্ত

পরদিন মতিঝিল থানার এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ মামলা করেন। তদন্তে ধাপে ধাপে পুলিশের ব্যর্থতা ও গড়িমসি স্পষ্ট হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন তদন্তে জানা যায়, নোয়াখালীর জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তি’ ছিল সাজানো নাটক।

২০০৮ সালে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবির দুটি অভিযোগপত্র দেন— হত্যার মামলা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা। ২২ জনকে আসামি করা হয়। একই বছরের অক্টোবরে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে তা মঞ্জুর হয়। সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ ২০১১ সালে আরও ৩০ জনকে যুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন, যেখানে তারেক রহমানসহ বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নাম আসে।

মুফতি হান্নান আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হামলায় তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতা এবং পরিকল্পনা-বাস্তবায়নের বিস্তারিত তুলে ধরে।

২০১২ সালে সম্পূরক আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জন সাক্ষ্য দেন। আসামিদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন ২০ জন।

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর জজ আদালত ৪৯ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়। এর মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড।

কার কী সাজা হয়েছিল?

১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড

  • সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর

  • সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু

  • হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ

  • এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম

  • এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী

  • হুজি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন

  • আরও কয়েকজন জঙ্গি ও সহযোগী

১৯ জনের যাবজ্জীবন

  • বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান

  • সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী

  • সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ

  • আরও কয়েকজন হুজি নেতা ও বিএনপি নেতাকর্মী

১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড

  • সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী

  • পুলিশের বিশেষ সুপার রুহুল আমিন

  • সিআইডির কর্মকর্তা মুন্সি আতিকুর রহমান ও আব্দুর রশীদ

  • সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা

  • সাবেক আইজিপি শহিদুল হক

  • খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক

  • আরও কয়েকজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা

হাই কোর্টে অগ্রগতি

২০১৮ সালের রায়ের দেড় মাস পর মামলা হাই কোর্টে যায়। শুনানি শুরু হয় ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর। তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে থাকায় আইনগতভাবে পলাতক হওয়ায় তিনি আপিল করতে পারেননি।

২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর শুনানি শেষ হয় এবং ১ ডিসেম্বর হাই কোর্ট আসামিদের খালাসের রায় দেয়।

রাষ্ট্রপক্ষ সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। ২০২৫ সালের জুলাই-আগস্টে শুনানি শেষে ৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়— আসামিদের খালাস বহাল।

নিউজটি শেয়ার করুন

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা

তারেক, বাবরসহ সব আসামির খালাসের রায় বহাল
‘নিহতদের আত্মার সুবিচার নিশ্চিতে স্বাধীন তদন্ত প্রয়োজন’ রায় থেকে বাদ

আপডেট সময় : ০২:০৪:১০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীবিরোধী সমাবেশে ২১ বছর আগে চালানো গ্রেনেড হামলার বহুল আলোচিত মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামির খালাস বহাল রেখেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারকের আপিল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণা করে।

হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ সংশোধন

খালাসের রায় বহাল রাখলেও হাই কোর্টের রায়ের একটি অংশ সংশোধন করেছে আপিল বিভাগ। হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছিল, ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঠিক ও স্বাধীন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্ট সেই অংশ চূড়ান্ত রায়ে বাদ দিয়েছে।

আলোচিত হামলার পটভূমি

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে চালানো গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হয়। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তোলে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে ২০১২ সালে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলায় অংশ নেয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি)-এর জঙ্গিরা, যারা বিদেশি জঙ্গিদের সহযোগিতা নেয়। তদন্তে উঠে আসে, তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’ ছিল এই ষড়যন্ত্রের পেছনে। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয় পাকিস্তান থেকে।

জজ আদালতের রায়

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জজ আদালত বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল।

২০১৮ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন মন্তব্য করেছিলেন, “‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ এই হামলা ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা।” তিনি আরও বলেন, “রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ থাকবেই। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করা গ্রহণযোগ্য নয়।”

হাই কোর্টের রায়

দণ্ডিত আসামিরা আপিল করেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আবেদন ‘ডেথ রেফারেন্স’ আকারে হাই কোর্টে যায়।

২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর হাই কোর্টের বেঞ্চ (বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেন) আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আবেদন খারিজ করে দেয়। আপিল না করা আসামিরাও খালাস পান।

হাই কোর্ট মন্তব্য করে, পুনঃতদন্তের আদেশ ছিল ‘আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’, আর সম্পূরক অভিযোগপত্রও ছিল ‘অবৈধ’। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল—
“সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করার ভিত্তি অবৈধ এবং আইনের বিচারে তা টেকে না।”

জনমতের প্রশ্ন

হাই কোর্টের রায়ের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তোলেন— গ্রেনেড হামলায় নিহত ২৪ জনের পরিবার কি তবে সুবিচার থেকে বঞ্চিত হবে?

১৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৭৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ২১ আগস্টের হামলা দেশের ইতিহাসে ‘একটি জঘন্য ও মর্মান্তিক’ ঘটনা। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমান।

রায়ে বলা হয়, “নিহতদের আত্মার প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে সঠিক ও স্বাধীন তদন্ত প্রয়োজন, যা এখনো এই মামলায় অনুপস্থিত। এজন্য মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত, যাতে দক্ষ সংস্থার মাধ্যমে পুনরায় তদন্ত করা যায়।”

তবে আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে হাই কোর্টের এই অংশ বাদ দেয়।

রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের অবস্থান

রাষ্ট্রপক্ষ চেয়েছিল জজ আদালতের দেওয়া সাজার রায় বহাল রাখতে। অন্যদিকে আসামিপক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে হাই কোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখার আবেদন করে। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের আবেদনই নাকচ হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্যাহ আল মাহমুদ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবু সাদাত মো. সায়েম ভূঞা ও সাদিয়া আফরিন। আসামিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।

কী ঘটেছিল সেদিন?

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল। মাঝখানে ট্রাক এনে মঞ্চ বানানো হয়েছিল।

শেখ হাসিনা ভাষণ শেষে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে গুলির শব্দ।

রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে শত শত জুতো-স্যান্ডেল, রক্তাক্ত দেহ, আহতদের আর্তনাদ। আহতদের বাঁচাতে এগিয়ে গেলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। অভিযোগ ওঠে, পুলিশ আলামত নষ্ট করতে তৎপর হয়।

ঘটনাস্থলেই মারা যান ১৬ জন। আইভী রহমান হাসপাতালে ৫৮ ঘণ্টা লড়াই করে মারা যান। পরে আরও অনেকে মারা যান— সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।

মঞ্চে নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। তবে গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মামলা বৃত্তান্ত

পরদিন মতিঝিল থানার এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ মামলা করেন। তদন্তে ধাপে ধাপে পুলিশের ব্যর্থতা ও গড়িমসি স্পষ্ট হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন তদন্তে জানা যায়, নোয়াখালীর জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তি’ ছিল সাজানো নাটক।

২০০৮ সালে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবির দুটি অভিযোগপত্র দেন— হত্যার মামলা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা। ২২ জনকে আসামি করা হয়। একই বছরের অক্টোবরে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে তা মঞ্জুর হয়। সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ ২০১১ সালে আরও ৩০ জনকে যুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন, যেখানে তারেক রহমানসহ বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নাম আসে।

মুফতি হান্নান আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হামলায় তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতা এবং পরিকল্পনা-বাস্তবায়নের বিস্তারিত তুলে ধরে।

২০১২ সালে সম্পূরক আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জন সাক্ষ্য দেন। আসামিদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন ২০ জন।

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর জজ আদালত ৪৯ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়। এর মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড।

কার কী সাজা হয়েছিল?

১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড

  • সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর

  • সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু

  • হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ

  • এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম

  • এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী

  • হুজি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন

  • আরও কয়েকজন জঙ্গি ও সহযোগী

১৯ জনের যাবজ্জীবন

  • বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান

  • সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী

  • সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ

  • আরও কয়েকজন হুজি নেতা ও বিএনপি নেতাকর্মী

১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড

  • সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী

  • পুলিশের বিশেষ সুপার রুহুল আমিন

  • সিআইডির কর্মকর্তা মুন্সি আতিকুর রহমান ও আব্দুর রশীদ

  • সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা

  • সাবেক আইজিপি শহিদুল হক

  • খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক

  • আরও কয়েকজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা

হাই কোর্টে অগ্রগতি

২০১৮ সালের রায়ের দেড় মাস পর মামলা হাই কোর্টে যায়। শুনানি শুরু হয় ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর। তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে থাকায় আইনগতভাবে পলাতক হওয়ায় তিনি আপিল করতে পারেননি।

২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর শুনানি শেষ হয় এবং ১ ডিসেম্বর হাই কোর্ট আসামিদের খালাসের রায় দেয়।

রাষ্ট্রপক্ষ সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। ২০২৫ সালের জুলাই-আগস্টে শুনানি শেষে ৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়— আসামিদের খালাস বহাল।