জুলাই সনদ বাস্তবায়ন : আট মাসে যা হয়নি, তা কি সম্ভব সাত দিনে?
- আপডেট সময় : ১২:২৯:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর ২০২৫
- / 89
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্য দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
তবে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন— যে ঐকমত্য আট মাসের সংলাপেও সম্ভব হয়নি, তা মাত্র সাত দিনে অর্জন করা কতটা বাস্তবসম্মত?
একই সঙ্গে কে আলোচনার ডাক দেবে, আর কে সাড়া দেবে— সেই প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে।
বেশির ভাগ বিশ্লেষকের মতে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারেরই নিতে হবে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে মূলত দুই ধরনের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে— এক, সনদ বাস্তবায়নের ধাপ; দুই, গণভোটের সময়।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল চাইছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হোক, এবং নির্বাচিত সংসদই যেন জুলাই সনদের বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল বলছে, গণভোট নভেম্বরেই করতে হবে এবং সনদের বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে প্রধান উপদেষ্টার হাত ধরে।
দলগুলোর এমন অবস্থানের মধ্যে গত মঙ্গলবার ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ জমা দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই; শুধু বলা হয়েছে, সংসদ নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিনই গণভোট হতে পারে।
এর পরদিন সোমবার সরকার গণভোট প্রসঙ্গে দলগুলোকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানায়।
কে কাকে ডাকবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের তো একটা দায়িত্ব আছে। আপনি যদি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা আলাপ করে ঠিক করবে, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার কেন?
“এতদিন ঐকমত্য কমিশন রেফারির ভূমিকা রেখেছে। এখন কমিশনের কাজ শেষ, তাই রেফারির দায়িত্ব নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকেই।”
তিনি আরও বলেন, “এখন প্রশ্ন হলো— দলগুলো নিজেরা বসবে কীভাবে? কে কাকে ডাকবে, কারা কোথায় বসবে? এখানে সমন্বয় দরকার, আর সেই কাজটাই সরকারের।”
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানের মতে, দলগুলো এখন নিজেরা বসে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবে না; তাই সরকারকেই আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা হয়তো পারত, যদি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরই বিষয়টি শুরু হতো। এখন তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, আর সেই দূরত্ব কমাতে রেফারি দরকার— অন্তর্বর্তী সরকারই সে ভূমিকা রাখছে।”
সরকারের এক সপ্তাহের আশা
সোমবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, গণভোটের সময় ও বিষয়বস্তু এবং জুলাই সনদের ভিন্ন মতগুলো নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের আলোকে দ্রুত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে পরিষদ।
তিনি বলেন, “এসব বিষয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানানো হয়েছে— তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেবে।”
তবে ‘ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা’ কীভাবে মিলবে, তা পরিষ্কার করেননি তিনি।
‘এখনও ঐকমত্য সম্ভব’
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, “ঐকমত্যই তো উদ্দেশ্য। প্রধান উপদেষ্টা আবারও দলগুলোর জন্য সুযোগ রেখেছেন। তারা যদি আলোচনায় বসে কিছুটা সহমত হয়, তাহলে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে— এটা ইতিবাচক।”
তার মতে, “দলগুলো নিজেরা বসে একটা সাধারণ জায়গায় আসার চেষ্টা করতে পারে। অনেক বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে; নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলে এখনও ঐক্য সম্ভব।”
বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন মনে করেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া কঠিন, কারণ দ্বিমত ও ভিন্নমত রয়েছে। এখন সরকারকেই আলোচনায় বসাতে হবে; ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদও শেষ।”
তিনি বলেন, “ঐকমত্য কমিশন ডাকলে আমরা নাও বসতে পারি। এখন সরকার থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।”
মুশতাক হোসেন আরও বলেন, “কে উদ্যোগ নেবে— বিএনপি না জামায়াত? ডাকলে সবাই আসবে, এমন সম্ভাবনা কম। হয়তো আলাদা আলাদা দলে আলোচনা হবে।”
তিনি মন্তব্য করেন, “জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থেকেই আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। ঐকমত্য কমিশন ভালো কাজ করলেও বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে জটিলতা তৈরি করেছে। এখন সমাধানের বল রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”
তার মতে, সরকার যদি উদ্যোগ না নেয়, তেমন অগ্রগতি হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “এ কাজগুলো শুরু থেকেই করা উচিত ছিল। দলগুলো নিজেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে না; শেষ পর্যন্ত সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
তিনি যোগ করেন, “দলগুলোকে দায়িত্ব দেওয়ার সময়টা অনেক দেরিতে এসেছে। গণভোট কবে হবে, শেষ পর্যন্ত সেটি সরকারকেই ঠিক করতে হবে।”
তবে দলগুলোকে এক সপ্তাহ সময় দেওয়াকে কৌশলগত পদক্ষেপ বলে মনে করছেন তিনি।
“গণভোটের প্রশ্নে দলগুলো এখন ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে না। কৌশলগতভাবে প্রধান উপদেষ্টা ঠিক করেছেন— আগে দলগুলোকে সম্পৃক্ত করে দেখবেন, তারা ব্যর্থ হলে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে; এতে সবাই মেনে নেবে। সেক্ষেত্রে একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হতে পারে,” বলেন সাব্বির আহমেদ।
নাগরিকদের সচেতনতা জরুরি
অধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, “গণভোট দেবে নাগরিকরা। তাই তাদের স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে— জুলাই সনদে কী আছে, এবং তারা কোন বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “সব দলকে আলোচনায় আনা হয়নি; যেসব দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, সেখানেও ঐকমত্য হয়নি— এটা হতাশাজনক।”
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে হবে নাকি আগেই হবে— এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতসহ কয়েকটি দলের মতভেদ দেখা দিয়েছে।
বিএনপি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের কিছু সুপারিশকে ‘প্রতারণামূলক’ বলে অবিলম্বে সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।
গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে ‘সংকট তৈরির’ অভিযোগ আনেন।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চাইছে, প্রধান উপদেষ্টা নিজেই ‘রেফারির’ ভূমিকা পালন করুন এবং নভেম্বরেই গণভোটের আয়োজন করা হোক।
এনসিপি একে সংস্কার প্রক্রিয়া বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “দলগুলোর দীর্ঘ আলোচনার পর ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ দিয়েছে, কিন্তু সরকার এখনো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ দেয়নি। বরং এখন আবার রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে দায়িত্ব ঠেলে দিয়ে গাছাড়া মনোভাব দেখানো হচ্ছে— যা সংস্কার প্রক্রিয়া বানচালের ইঙ্গিত দেয়।”



















