চট্টগ্রামের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়া নিয়ে বিতর্ক: কী জানা যাচ্ছে
- আপডেট সময় : ০২:২১:৪৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
- / 232

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি কোম্পানির কাছে ব্যবস্থাপনার জন্য হস্তান্তর করা হবে কি না—এই বিষয়ে বিতর্ক আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এই প্রস্তাবের বিরোধিতায় অনেকে সরব হয়েছেন এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুবাইভিত্তিক একটি বিদেশি কোম্পানিকে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেই উদ্যোগই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আবারও গতি পেয়েছে বলে জানা গেছে—এ খবর সামনে আসার পর আবারও বিতর্ক শুরু হয়েছে।
তবে পিপিপি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখনো এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চলছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে এক লিখিত জবাবে জানানো হয়, “নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালটি পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমীক্ষা পরিচালিত হচ্ছে। সমীক্ষায় প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতেই সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।”
অন্যদিকে সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিদেশি কোম্পানির কাছে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হস্তান্তরের বিষয়ে সরকার নেতিবাচক অবস্থানে নেই। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তার মতে, দায়িত্ব হস্তান্তর হলেও বন্দরের কর্মচারীদের চাকরি বা অন্য কোনো সমস্যা হবে না। রিপোর্ট করেছেন বিবিসি নিউজ বাংলা’র রাকিব হাসনাত।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে যাচ্ছে কি সত্যিই টার্মিনালটি?
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকেই ধারণা করা হচ্ছে যে, এনসিটির দায়িত্ব একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতেই যাচ্ছে।
বন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ডিপি ওয়ার্ল্ড নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে সরকার-সরকার (জিটুজি) অংশীদারিত্বে টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।
আগের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা চূড়ান্ত হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আলোচনা ফের শুরু হয়েছে।
এনসিটি চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড়, যেখানে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানো যায়। এছাড়া এখানে স্বয়ংক্রিয় ক্রেন থাকায় দ্রুত কন্টেইনার ওঠানো-নামানোর সুবিধাও রয়েছে।
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এই টার্মিনালে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় তিন লাখ কন্টেইনার বেশি ওঠানামা করেছে।
গত বুধবার চট্টগ্রাম গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস টার্মিনালটি পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর। এই হৃদপিণ্ডকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। তাই বিশ্বসেরা বন্দর ব্যবস্থাপকদের ডাকতে বলেছি।”
তিনি আরও বলেন, “বারবার অনুরোধ করছি—এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করো। না হলে ভবিষ্যতে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।”
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “আমরা বিশ্বের অভিজ্ঞ বন্দর ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলছি—যাদের প্রতিষ্ঠিত রেকর্ড আছে। কোনো সাধারণ কোম্পানি নয়, যারা ৭০–৮০টি বন্দর পরিচালনা করছে। আমাদের লক্ষ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ করা।”
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সরকারের নির্বাহী বিভাগ, আর বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকবে পিপিপি কর্তৃপক্ষের ওপর। ইতোমধ্যে তারা কয়েক দফা বৈঠক করেছে বলেও জানা গেছে।
এসব কারণে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, সরকার ধীরে ধীরে দুবাইভিত্তিক কোম্পানিটির কাছে টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হস্তান্তরের পথে এগোচ্ছে।
বিতর্ক ও বিরোধিতার পেছনের কারণ
বর্তমানে এনসিটি ব্যবস্থাপনায় রয়েছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং টার্মিনালটি আধুনিক সরঞ্জামেও সমৃদ্ধ।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য মো. জাফর আলম বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বন্দর পরিচালনা এখন বৈশ্বিক প্রবণতা। তবে তিনি বলেন, “যেসব টার্মিনালে কার্যক্রম শুরু হয়নি, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ যৌক্তিক। কিন্তু এনসিটি পুরোদমে চালু থাকা একটি টার্মিনাল—এখানে বিদেশিরা কী বিনিয়োগ করবে, আর তা বন্দরের দক্ষতা কতটা বাড়াবে, সেটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ৭০ শতাংশ কন্টেইনার ঢাকায় যায় এবং সেখানে পণ্য খালাস হয়ে আবার বন্দরে ফেরত আসে। তাই বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিলে তাদের যেন বন্দর থেকে দিরাশ্রম পর্যন্ত একটি নির্ধারিত কন্টেইনার করিডর এবং দিরাশ্রমে একটি ডিপো নির্মাণে বিনিয়োগ করতে হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
তিনি বলেন, “শুধু কন্টেইনার হ্যান্ডলিং নয়, দ্রুততা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দরে বিদেশি প্রতিষ্ঠান আনার দুটি মূল উদ্দেশ্য—বিনিয়োগ আকর্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি। তবে এনসিটিতে neither নতুন বিনিয়োগের সুযোগ আছে, না সম্প্রসারণের, কারণ নিকটেই রয়েছে নৌঘাঁটি।
অন্যদিকে বে টার্মিনাল ও লালদিয়ার চরে নতুন জেটি ও অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ থাকায় সেখানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে আপত্তি নেই। পতেঙ্গা টার্মিনালের দায়িত্ব সৌদি প্রতিষ্ঠানের হাতে যাওয়াতেও তেমন বিরোধিতা হয়নি।
বার্থ অপারেটরদের সংগঠনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেন, সরকার সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে তা যেন উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক হয়, সেটি দেখতে হবে।
তিনি বলেন, “নিউমুরিং ভালো পারফর্ম করছে। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষও দক্ষ হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে বিদেশিরা দায়িত্ব হস্তান্তর করলে অভ্যন্তরীণভাবে চালাতে হলে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।”
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের অনেক শ্রমিক-কর্মচারী ও অপারেটর ইতোমধ্যেই এই হস্তান্তরের বিরোধিতা করে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ করেছে।
‘দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও’ কমিটির সদস্য শাহাদত হোসেন সেলিম বলেন, সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে না সরে এলে তারা প্রতিবাদ কর্মসূচি দেবেন।
তিনি বলেন, “২০ বছর আগে ৭০০ কোটি টাকায় তৈরি এই টার্মিনাল এখন সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। কেউ এখন পর্যন্ত বিদেশি অপারেটরের প্রয়োজন অনুভব করেননি। এটি হয় অহংকারের বহিঃপ্রকাশ, নয়তো লোকদেখানো পদক্ষেপ। বরং বে টার্মিনাল বা লালদিয়ার চর বিদেশি কোম্পানির জন্য বেশি উপযোগী।”
বিদেশি কোম্পানিকে বন্দরের দায়িত্ব দেওয়ার প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তাদের বক্তব্য, “দেশীয় অর্থে গড়ে ওঠা একটি কার্যকর টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রহস্যজনক ও চক্রান্তমূলক।”
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “বন্দরের দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দিলে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে, আর অন্তর্বর্তী সরকারের এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত নয়। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে, দেশীয় ব্যবস্থাপনায় এটি লাভজনকভাবেই চলছে। তাহলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কেন? এর সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও জড়িত। সরকারের উচিত হবে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।”


















