গোপালগঞ্জে যারা মারা গেলেন তারা কোন দলের?
তারা পেশায় দোকানি, কর্মচারী, রাজমিস্ত্রি ও রিকশাচালক
- আপডেট সময় : ০২:৪৪:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫
- / 218

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘিরে যারা মারা গেছেন তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিহতরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে পরিবারগুলো দাবি করেছে।
সরকারি হিসেবে যে পাঁচ জনের মুত্যুর তথ্য দেওয়া হয়েছে তারা সবাই ছিলেন শ্র্রমজীবী মানুষ।
গোপালগঞ্জে নিহত পাঁচজনের মধ্যে দুজন দোকানি, একজন দোকান কর্মচারী, একজন রাজমিস্ত্রি ও একজন রিকশাচালক।
নিহত পাঁচজন হলেন মুঠোফোনের যন্ত্রাংশের দোকানি সোহেল মোল্লা (৩৫), পোশাক দোকানি দীপ্ত সাহা (২৫), সিরামিকপণ্যের দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদার (১৭), রাজমিস্ত্রি রমজান কাজী (১৮) ও রিকশাচালক রমজান আলী। । এর মধ্যে দীপ্ত সাহাকে নিজেদের কর্মী দাবি করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আরেকজন মারা গেছেন। সহিংসতার ঘটনায় এ নিয়ে সরকারি হিসেবে পাঁচজন মারা গেলেন। গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সী (৩২) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) দিবাগত রাত দুইটার দিকে মারা গেছেন।
গত বুধবার (১৬ মার্চ) গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ মঞ্চে হামলা ও সমাবেশ শেষে নেতাদের গাড়ি বহরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলার হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় নিহত হন, গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গিপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪)। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৯ জন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ দুজন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁরা হলেন, সুমন বিশ্বাস (৩০) ও আব্বাস আলী (৩০)। নিহতদের পোস্ট মর্টেমের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পোস্ট মর্টেম ছাড়াই দাফন/সৎকার করা হয়েছে।
রমজান আলী ছিলেন রিকশাচালক
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে রমজান আলী মুন্সীর বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর থানাপাড়ায়। তিনি মৃত আকবর মুন্সীর ছেলে। রমজান আলী রিকশাচালক ছিলেন। আহত অবস্থায় রমজান মুন্সীকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন তাঁর ভাই হীরা মুন্সী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর ভাই রিকশাচালক। ঘটনার দিন গত বুধবার দুপুরে গোপালগঞ্জ সদর এলাকায় সিনেমা হলের পাশেই রিকশা থেকে যাত্রী নামিয়ে ফেরার পথে তিনি সহিংসতার মধ্যে পড়েন এবং গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে এবং পরে অবস্থার অবনতি হলে ওই দিনই দিবাগত রাত ২ টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ আলম বলেন, রমজান মুন্সীর মরদেহ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রাখা হয়েছে।
‘ভিডিও করছিলেন সোহেল’
গোপালগঞ্জ শহরের পূর্ব মিয়াপাড়ায় ভাড়া বাসায় মা-বাবা, স্ত্রী এবং চার ও দুই বছর বয়সী দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতেন সোহেল মোল্লা। গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। গোপালগঞ্জ শহরের চৌরঙ্গীর কেরামত উদ্দিন প্লাজায় মুঠোফোনের যন্ত্রাংশের দোকান আছে তাঁর। তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান।
তাঁর মা লাইলি বেগম বিলাপ করে বলেন, ‘আমাগো বাড়ি গোপালগঞ্জ হইতে পারে। আমরা তো কোনো রাজনীতি করি না। তার কেন এই হইল?’
সোহেলের স্ত্রী নিশি বেগম বলেন, তাঁর স্বামী কোনো রাজনীতি করতেন না। ছেলে হত্যার বিচার চান সোহেলের ষাটোর্ধ্ব বাবা ইদ্রিস আলী। তাঁদের ভাষ্য, বুধবার বাসা থেকে বের হয়ে দোকানে যান সোহেল। দুপুরে সংঘর্ষ শুরু হলে তিনি মুঠোফোনে ঘটনার ভিডিও ধারণ করছিলেন।
সোহেলের মামা জাহিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, তাঁর ভাগনের লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি এবং হাসপাতাল থেকে মৃত্যুসনদ দেওয়া হয়নি। গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। দাফন শেষে পরিবারের সদস্যরা আবার শহরের বাসায় চলে আসেন।
ইমনের টাকায় চলত সংসার
নিহত ইমন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার গ্রামের আজাদ তালুকদারের ছেলে। সন্তান হারানো শোকে কথা বলতে পারছিলেন না ইমনের মা রোকসানা বেগম।
উপস্থিত লোকজনের সান্ত্বনায় এক পর্যায়ে রোকসানা বলে ওঠেন, ‘আমার বাপে (ইমন) সংসারটা টানত। এখন আমার চারটে-পাঁচটা ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচার পথ নাই।’
প্রতিবেশী রাজু তালুকদার জানান, ইমনেরা দুই বোন ও তিন ভাই। বড় ভাই অসুস্থ। একটা বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট বোন আর ভাইটা পড়াশোনা করে, ইমনই খরচ চালাত। ওর বাবা অসুস্থ। এ নিয়েই কখনো কখনো ভ্যান চালান। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে একদম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ছেলের জানাজায় পর্যন্ত থাকেননি। বাড়ি থেকে কোথায় যেন চলে গেছেন, কেউ জানে না।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ইমন বেলা ১১টার দিকে বাড়ির উদ্দেশে দোকান থেকে বের হয়। কিন্তু সে বাড়ি না গিয়ে সংঘর্ষস্থলে যায়। স্থানীয় লোকজন তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেন। বুধবার সকালে পৌর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
রমজানও ছিলেন প্রধান উপার্জনক্ষম
রমজান গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বান্ধাবাড়ী ইউনিয়নের হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে। কামরুল কাজী ২০ বছর আগে গোপালগঞ্জে চলে আসেন। পরিবার নিয়ে তিনি গোপালগঞ্জের বিসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। গতকাল বেলা দুইটার দিকে সেখানে কথা হয়।
রমজানের মামা কলিম মুন্সি বলেন, ‘আমার ভাগনে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নয়। তার বাবা প্রতিবন্ধী, এক বেলা ভ্যান চালায়। রমজানের রাজমিস্ত্রির টাকায়ই সংসার চলত। ভিডিওতে দেখলাম ভাগনেকে গুলি করে মেরেছে। লাশও ময়নাতদন্ত করাতে পারলাম না।’
‘দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপ্ত’
দীপ্ত সাহা গোপালগঞ্জের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে। বুধবার রাতে গোপালগঞ্জ পৌর মহাশ্মশানে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
দীপ্ত সাহার ভাই সঞ্জয় সাহা জানান, ‘আমরা দুই ভাই পোশাক ব্যবসায়ী। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। প্রতিদিনের মতো আমার ভাই দোকানে যায়। শহরের অবস্থা খারাপ দেখে দোকান বন্ধ করে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তাড়া খেয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে গেলে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজ মসজিদের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়। তার পেটের ডান পাশে গুলি লেগে বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।’
ছেলের পোশাক ধরে স্মৃতিচারণা করে কেঁদে কেঁদে দীপ্তর মা বিভা রানী সাহা বলেন, ‘আমার ছেলেকে এনে দিতে পারবে? যদি না–ই দিতে পারো তাহলে কথা বলে কী লাভ? কী অপরাধ করেছে আমার ছেলে?’
পুলিশের মামলায় আসামি ৪৭৫, ধরপাকড় চলছে
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ মঞ্চ ও গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেছে পুলিশ। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে এ মামলা করে পুলিশ। এতে অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
শুক্রবার (১৮ জুলাই) গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনিসুর রহমান মামলার তথ্য নিশ্চিত করেন। বৃহস্পতিবার রাতে বিভিন্ন এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযানে প্রায় ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে সংঘাত-সহিংসতায় যে পাঁচজন নিহত হয়েছেন তাদের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
সহিংসতার ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বুধবার রাত ৮টা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করে সরকার। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে আজ (শুক্রবার) বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল রয়েছে।


















