আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গড়ে ওঠা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এবার বাজেট সংসদের বাইরে থেকে উপস্থাপিত হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। আগামী ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট টেলিভিশনের মাধ্যমে ঘোষণা করবেন। এরপর বাজেটটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদিত হবে।
বাজেট ঘোষণা রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বিটিভিসহ বিভিন্ন বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে সম্প্রচার করা হবে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের এটি হবে প্রথম বাজেট, যার সম্ভাব্য আকার সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০০৮ সালে সংসদের বাইরে বাজেট দেওয়া হয়েছিল, তখন ক্ষমতায় ছিল সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
সাধারণত সংসদে বাজেট উপস্থাপন বৃহস্পতিবার হয়ে থাকে, কিন্তু এবার ২ জুন পড়েছে সোমবারে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ৯ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ২০০৮-০৯ অর্থবছরের বাজেটও সোমবারে উপস্থাপন করেছিলেন, বাজেটের আকার ছিল ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা।
সংসদে বাজেট ঘোষণার প্রক্রিয়া কেমন?
বাজেট উপস্থাপনের আগে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সরকারের আর্থিক বিবরণী, অর্থবিল ও সম্পূরক বাজেটের অনুমোদন নেওয়া হয়। এরপর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে তা সংসদে উপস্থাপন করা হয়। সাধারণত রাষ্ট্রপতি বাজেট ঘোষণার সময় সংসদে উপস্থিত থাকেন।
ব্রিফকেসের প্রচলন কি এবারও থাকবে?
বাজেট ঘোষণার দিনে অর্থমন্ত্রী সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংসদে ঢোকেন, হাতে থাকে ব্রিফকেস। সংসদে না হওয়ায় এবার সেই ঐতিহ্যবাহী ব্রিফকেস দেখা যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণায়ও অর্থমন্ত্রীর হাতে থাকে ব্রিফকেস। এতে থাকে ছাপানো বক্তৃতা, যেখানে থাকে বাজেটের হিসাব। শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে এই রেওয়াজের শুরু হয়েছিল। ব্রিফকেসের ভেতর থাকা বাজেটের তথ্য যেন আগেই ফাঁস না হয়, সেই জন্যই এই প্রচলন।
ব্রিটেনে প্রথম বাজেট ব্রিফকেস ব্যবহার শুরু হয় ১৮ শতকে। ১৮৬০ সালে অর্থমন্ত্রী উইলিয়াম ই গ্ল্যাডস্টোন লাল স্যুটকেসে বাজেট নথি নিয়ে আসেন। সেই ব্যাগে রানির মুখের ছাপ ছিল। ‘বাজেট’ শব্দটিও এসেছে ফরাসি শব্দ ‘ব্যুজেট (বোগেট)’ থেকে, অর্থাৎ থলে বা ব্যাগ। আগে থলেতে করেই বাজেটের হিসাব আনা হতো।
অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে বলা হয়েছে, ষোড়শ শতকে ‘বাজেট খোলার’ অর্থ ছিল গোপন কোনো কিছু প্রকাশ করা। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ২০২১ সালে ব্রিফকেসের বদলে ট্যাবলেট থেকে বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাজেট উপস্থাপনের নজির আছে, তবে অর্থমন্ত্রীর সামনে ছাপানো নথি থাকতোই।
এবার অর্থ উপদেষ্টার কাছে ব্রিফকেস থাকবে কিনা তা ২ জুন বোঝা যাবে।
একটি রেওয়াজ মানবেন অর্থ উপদেষ্টা
আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরে আবুল মাল আবদুল মুহিত দশবার, আ হ ম মুস্তফা কামাল পাঁচবার এবং আবুল হাসান মাহমুদ আলী একবার সংসদে বাজেট দিয়েছিলেন। সেই সময়ে বাজেট সংসদে উত্থাপিত হয়ে মাসব্যাপী আলোচনার মধ্য দিয়ে পাস হতো। সংবিধান অনুযায়ী জুনের ৩০ তারিখের মধ্যে বাজেট অনুমোদিত হতে হতো।
এবার সংসদ না থাকায় কোনো আলোচনার সুযোগ থাকছে না। বাজেট উপস্থাপন শেষে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে তা কার্যকর হবে। তবে রেওয়াজ মেনে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেটের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
এবারের বাজেটের মূল দিক
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এবারের বাজেট হবে বাস্তবমুখী, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে লক্ষ্য রেখে। অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, “বাজেট হবে সমতা ও কল্যাণমুখী, তবে দীর্ঘমেয়াদি বাজেটের ম্যান্ডেট আমাদের নেই। ৫০ থেকে ৬০ পাতার মধ্যে বাজেট বক্তৃতা হবে এবং এটি বাস্তবমুখী হবে।”
করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো এবং করজাল বিস্তারের প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, “ক্যাশলেস সোসাইটি ও ফেসলেস ট্যাক্স সিস্টেমের প্রয়োজন। কর অফিসারের মুখোমুখি হওয়া যেন কেউকে করতে না হয়।”
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজস্ব আয়ের নতুন উৎস না থাকায় বাজেটের আকার বড় করা হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা কমানো হবে।
এছাড়া উচ্চাভিলাষী না হয়ে বাজেটকে বাস্তবসম্মত রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা থাকছে। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাজেট ঘাটতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পাঁচ শতাংশের নিচে রাখা হবে। আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরে কর আদায়ের লক্ষ্য কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, “বাজেটের আকার ছোট রাখা উচিত, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে ঘাটতি কমিয়ে মূল্যস্ফীতিতে নজর দেওয়া সম্ভব।” পাশাপাশি তিনি বলেছেন, “অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।”
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, “মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার তা বুঝতে পেরেছে, কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি। রাজস্ব বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যদিও সেটা কঠিন চ্যালেঞ্জ।”
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সংশোধন করে তা সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হচ্ছে। এটি চূড়ান্ত হলে, স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাজেটের আকার আগের বছরের তুলনায় ছোট হতে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।



















