কৃষিজমি কমছে, বাড়ছে না চাল উৎপাদন
- আপডেট সময় : ১২:০৮:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫
- / 340
দেশে জনসংখ্যা বাড়লেও অনুপাতে বাড়ছে না খাদ্যশস্যের উৎপাদন। কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস, উচ্চফলনশীল জাতের ঘাটতি, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে তুলনায় কৃষকের আয় না বাড়ার মতো একাধিক কারণ কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে কৃষি খাত এক ধরনের স্থবিরতার মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধাক্কা লাগার আশঙ্কা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ধান চাষ হয়েছিল ১ কোটি ১৭ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টরে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও কমে ১ কোটি ১৪ লাখ হেক্টরে নেমে এসেছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে আবাদি জমি কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। এই সময়ে হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন বেড়েছে ৪ শতাংশ, আর চালের মোট উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দুই ও তিনফসলি জমি ক্রমেই আবাসন, শিল্প ও অন্যান্য অকৃষি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে—যা বিদ্যমান আইন অনুযায়ী অনুমোদনহীন। আইনের প্রয়োগ না থাকায় এ চর্চা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাদের মতে, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না করলে উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা, ফলে কৃষি খাত দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলমের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৮-২০১৯ মেয়াদে প্রতি বছর গড়ে ০.২১ শতাংশ হারে কৃষিজমি হ্রাস পেয়েছে, যা ১৯৯৬-২০০৮ সময়ে ছিল ০.৭৪ শতাংশ এবং ১৯৮৪-১৯৯৬ সময়কালে ছিল ০.৯৭ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদে গড় হারে কৃষিজমির পতন ০.৩৫ শতাংশ।
তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী কৃষিজমি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। নদীভাঙন, ইটভাটা ও অবকাঠামো নির্মাণে প্রচুর জমি হারাচ্ছি। রাস্তার পাশে বা সরকারি বাংলোগুলোতে সবজি চাষের মতো উদ্যোগ নিতে হবে।”
উত্তরের জেলা দিনাজপুরকে বলা হয় দেশের শস্যভাণ্ডার। এ জেলার অধিকাংশ জমি দুই বা তিন ফসলি হলেও আবাসন, ইটভাটা ও কলকারখানার দখলে হারাচ্ছে কৃষিজমি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, গত ছয় বছরে জেলায় আবাদি জমি কমেছে ৩ হাজার ২৩২ হেক্টর।
এ প্রবণতা কেবল দিনাজপুরেই নয়, সারা দেশেই লক্ষ করা যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বসবাস ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক কার্যক্রম বেড়েছে, যার ফলে রাস্তা, প্রকল্প ও অন্যান্য সরকারি উদ্যোগে কৃষিজমি অধিগ্রহণও হচ্ছে। যদিও তিনফসলি জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (গবেষণা) মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলু বলেন, “আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। যে কেউ কৃষিজমিতে গড়ে তুলছে বাড়ি-কলকারখানা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, কৃষিজমি হ্রাসের বড় কারণ হলো দেশের ৯০ শতাংশ ভূমি কোনো পরিকল্পনার আওতায় নেই। রাজউকের প্রধান পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, “সারাদেশে ভূমি ব্যবহারের একটি জাতীয় পরিকল্পনা (ন্যাশনাল ফিজিক্যাল প্ল্যান) জরুরি। এতে জানা যাবে কোথায় জমি কমবে বা কীভাবে রক্ষা করা যাবে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে বলে জানালেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফাহমিদা পারভীন। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
এদিকে কৃষি উৎপাদনে লাভ কমে যাওয়ায় কৃষক দিন দিন নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বিআইডিএস-এর গবেষণায় দেখা গেছে, গত সাত বছরে কৃষি উৎপাদনের ব্যয় বেড়েছে ৩.৫ শতাংশ, কিন্তু কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে মাত্র ১.৩১ শতাংশ। একই সঙ্গে মাটির উর্বরতাও কমছে প্রতি বছর ০.৪৪ শতাংশ হারে।
আলুর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আগের বছরের ভালো দামের প্রভাবে এবারে আবাদ বেড়েছে ১২ শতাংশ। কিন্তু ফলন ভালো হওয়ায় মৌসুমের শুরুতেই দাম পড়ে গেছে। ফলে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু ১৩-১৪ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, যেখানে খরচ হয়েছে ১৫ টাকা।
ফুলকপি চাষিরাও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। মানিকগঞ্জের এক কৃষক জানান, খরচ হয়েছে ১০ টাকার বেশি, অথচ বিক্রি করতে হয়েছে ২-৩ টাকায়। কেউ কেউ কপি খেতে ফেলে দিয়েছেন, কেউ আবার গরুকে খাওয়াচ্ছেন।
এই অবস্থায় কৃষকেরা বারবার একই পণ্য আবাদ করতে নিরুৎসাহিত হন। ফলে এক বছর পণ্যের দাম পড়ে গেলে পরের বছর সেই পণ্যের ঘাটতি হয় এবং বাজারে আবারও মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। অথচ কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ এবং জাতীয় কৃষি বিপণন নীতিতে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর নয়।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উচিত কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা। দাম বাড়লে যে তৎপরতা দেখা যায়, দাম কমলে তা থাকে না। ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “দাম পড়ে গেলে সরকার ন্যূনতম মূল্য ঘোষণা করতে পারে, কিংবা নগদ সহায়তা দিতে পারে।”
চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধিও এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারছে না। বিবিএস-এর তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৩৩ শতাংশ, অথচ কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, গত তিন অর্থবছরে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের নিচে ছিল।
২০২০-২১ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন, ২০২১-২২ সালে তা বেড়ে ৩ কোটি ৮৯ লাখ টনে পৌঁছায় (প্রবৃদ্ধি ০.৭৮%)। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র ০.২৬% বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টনে। লক্ষ্যমাত্রা প্রতিবারই অর্জিত হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদন ব্যয় বাড়া ও ধানের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ার কারণে কৃষকরা ধানচাষ থেকে সরে গিয়ে বিকল্প ফসলে ঝুঁকছেন বা কৃষি পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, “আমরা নগদ অর্থ দিয়ে হয়তো সব সমাধান করতে পারব না, তবে কৃষকের স্বার্থরক্ষায় নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। সারাদেশে ১০০টি মিনি কোল্ড স্টোরেজ তৈরি হচ্ছে। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য স্বল্পমূল্যে ঘর বানানোর ব্যবস্থাও নিচ্ছি। আলুর রপ্তানি নিয়েও কাজ চলছে। শাকসবজি সংরক্ষণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।”



















