কুমিল্লার মুরাদনগরে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে তোলপাড়, বিস্তারিত কী জানা গেল?
- আপডেট সময় : ১২:৫০:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
- / 296

বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের একটি গ্রামে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে প্রধান অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে ঘটনার ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেবার অভিযোগে আরও চার জনকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুরাদনগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী ঘটনাটি বৃহস্পতিবারের হলেও এটি ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় শনিবার। এরপর এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপরই মূল অভিযুক্তের রাজনৈতিক পরিচয়ের সূত্র ধরে নানামুখী প্রচারও দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে।
শনিবার গভীর রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড পাতায় কুমিল্লা জেলা পুলিশের একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানানো হয়।
শনিবার দিবাগত রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি জায়গায় ওই ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল সমাবেশ হয়েছে। ঘটনার তীব্র নিন্দা ও জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
ওদিকে ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষের সাথে কথা বলে নানা ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে।
ঘটনার শিকার নারী কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যেখানে তিনি জানিয়েছেন ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি খারাপ উদ্দেশ্যেই তার বাসায় ঢুকে তাকে অত্যাচার করেছেন।’
‘তার সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তির আগে থেকেই যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিলো’- এমন ধরনের যে প্রচার সামাজিক মাধ্যমে একটি পক্ষ করছে- তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে ওই ব্যক্তির সাথে তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পর্কিত যোগাযোগ ছিল।
এদিকে ঢাকায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রধান আসামিসহ যারা ছবি ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করেছে তার দায়িত্বহীন অপরাধমূলক কাজ করেছে। সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আসল ঘটনা কী?
কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খাঁন সাংবাদিকদের বলেছেন, ভিকটিম বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসার পর এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় কিছু লোকজন তখন ঘরের ভেতর ঢুকে ওই ব্যক্তিকে (মামলায় অভিযুক্ত) মারধর করে। এক পর্যায়ে ওই ব্যক্তি পালিয়ে যায়। এরপর ভিকটিমের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এটি যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি, তাদের আটক করা হয়েছে।
মূলত শনিবার দুপুর থেকেই এ ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হতে শুরু করে এবং অনেকেই এটিকে ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীকে ধর্ষণ’ হিসেবে উল্লেখ করে ভিডিওটি শেয়ার করেন।
ভিডিওতে ওই নারীকে বিবস্ত্র করে আক্রমণ করতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলে তখন বেশ কয়েকজনকে দেখা গেছে ওই ভিডিওতে। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ নিয়ে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ শুরু হয় সামাজিক মাধ্যমে। অনেকে এই ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্ঠান্তমূলক বিচার দাবি করেন।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক কিছু পেজ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তির পোস্ট থেকে ঘটনার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএনপির স্থানীয় নেতা উল্লেখ করে প্রচার শুরু করলে বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে তা প্রত্যাখ্যান করে দাবি করা হয় যে, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি বরং স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন’।
আবার এ ঘটনার জন্য দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দিকে ইঙ্গিত করে অনেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনা করে নানা পোস্ট দেন। ওদিকে আরেকটি পক্ষ ঘটনাটিকে ‘পরকীয়া সম্পর্কের জের’ হিসেবে প্রচার চালাতে শুরু করেন।
এমন নানামুখী প্রচার ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং দোষারোপের মধ্যে আজ ভোরে মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতারের তথ্য দেয় পুলিশ।
রবিবার সকাল পৌনে নয়টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব কুমিল্লা পুলিশ সুপারের দেয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, ঘটনার মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, “গত বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে মুরাদনগরের একটি গ্রামে একজন প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ করার অভিযোগে ফজর আলী এলাকার লোকজনের হাতে আটক ও প্রহৃত হন। পরবর্তীতে ফজর আলী পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কিছু লোক তাৎক্ষণিকভাবে ভিকটিমের ভিডিও ধারণ করে এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়,” ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
এতে আরও জানানো হয় যে, ভিকটিমের লিখিত এজাহারের ভিত্তিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে। এই ঘটনায় মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঘটনার ভিডিও ধারণ করে যারা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খাঁন পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, “আটককৃতদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় মোট ৫ জনকে আটক করা হয়েছে। তদন্তে আরও কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে”।
মামলায় যা বলা হয়েছে
পুলিশ সুপার জানিয়েছেন ঘটনার ভিকটিম নিজেই মুরাদনগর থানায় মামলা করেছেন। এ ঘটনায় মুরাদনগর থানায় দায়ের করা মামলায় ঘটনার শিকার নারী তাকে হেনস্থার বিবরণ দিয়ে একজনকেই আসামি করেছেন।
অভিযোগে তিনি বলেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি তার বাবার বাড়ির এলাকারই বাসিন্দা এবং তিনি যখনই স্বামীর বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে বেড়াতে আসেন তখন বিভিন্ন সময় তাকে ওই ব্যক্তি উত্যক্ত করে আসছিলো।
এবারেও তিনি তার বাবার বাড়িতে আসার পর থেকে তাকে উত্যক্ত করা হয়েছিলো বলে ওই নারী মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন।
সবশেষ গত বৃহস্পতিবার ওই ব্যক্তি কৌশলে তার ঘরে প্রবেশ করে গলায় ছুরি ধরে এবং এক পর্যায়ে খুনের ভয় দেখিয়ে তাকে ধর্ষণ করে।
এরপর ওই ব্যক্তি বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি চিৎকার শুরু করলে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে এসে ওই ব্যক্তিকে আটক করে মারধর করে বলে তিনি এজাহারে অভিযোগ করেন।
মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান বলছেন, এজাহারের ভিত্তিতে আসামিদের আটকের পাশাপাশি তদন্ত শুরু করেছেন তারা।
মামলার মূল অভিযুক্তকে আটকের পর হাসপাতালে রাখা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। অন্যদিকে ভিডিও করে তা ছড়ানোর অভিযোগে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের আজই আদালতে তোলার কথা জানিয়েছে মুরাদনগর থানা পুলিশ।
এদিকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা দ্রুত, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এ ঘটনাটি শুধু একটি ভয়াবহ অপরাধ নয় বরং নারীর প্রতি উদ্দেশ্য প্রণোদিত আক্রমণ এবং বিদ্বেষের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ, যা বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের মৌলিক ভিত্তিকে লঙ্ঘন করে।”



















