ঢাকা ০৯:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে আরও ৩০ দেশের নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা খাঁচা থেকে বের হওয়া সিংহী আড়াই ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না কুকুরছানা হত্যা মামলায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে ২ বছরের শিশু খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিতে ঢাকায় আসছেন জুবাইদা যুক্তরাজ্যের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী!

কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়াদের টার্গেট, অপহরণকারী চক্র সক্রিয়
পাহাড়ে আস্তানায় বন্দিশালা, একজনের তথ্যে ৮৩ জন উদ্ধার

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ১২:০২:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / 161

পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ৮৩ জনকে উদ্ধার করেছে র‍্যাব-বিজিবি

অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পান্টি গ্রামের রেজাউল করিম ঘুরতে গিয়েছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফে। তিনি উঠেছিলেন স্থানীয় হোটেল আল করমে। সেখান থেকে ৭ সেপ্টেম্বর তাকে অপহরণ করে মো. আমিন নামের এক ব্যক্তি, যিনি হোটেলটির সাবেক ম্যানেজার। পরে আমিন তাকে ৫০ হাজার টাকায় মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়। তারা আবার আরেক দলে বিক্রি করে। শেষ পর্যন্ত টেকনাফের বাহারছড়া কচ্ছপিয়ার গভীর পাহাড়ে একটি আস্তানায় আটকে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন চালানো হয়।

রেজাউল জানান, টেকনাফ পৌর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের ঝরনা চত্বর থেকে কয়েকজন লোক হঠাৎ করে তাকে অপহরণ করে। পরে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, অপহরণের শিকার হয়েছেন। পাহাড়ি আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হলে ৫০ হাজার টাকায় মানব পাচারকারীদের কাছে তাকে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে ১৩ দিন ধরে চলতে থাকে অমানবিক নির্যাতন। গত শনিবার তাকে আবার ৬০ হাজার টাকায় আরেক দলে বিক্রি করা হয়। নতুন দলটি তাকে আরেক পাহাড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি দৌড়ে পালিয়ে পাহাড় বেয়ে নেমে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত বিজিবির কাছে আশ্রয় নিয়ে নিরাপদে ফেরেন।

রেজাউলের তথ্যেই ৮৩ জন উদ্ধার
রেজাউলের দেওয়া তথ্যে যৌথ অভিযান চালিয়ে র‍্যাব-বিজিবি কচ্ছপিয়ার পাহাড় থেকে নারী-শিশুসহ আরও ৮৩ জনকে উদ্ধার করে। তাদের সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচারের পরিকল্পনা ছিল। এ সময় অস্ত্র ও গুলিসহ তিন মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সোমবার টেকনাফ-২ বিজিবির সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান ও র‍্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান।

পাহাড়ের আস্তানা বর্ণনা করতে গিয়ে রেজাউল করিম বলেন, “চোখ খুলতেই দেখি চারপাশে শত শত মানুষ বন্দি। পাহাড়ের ভেতরে গড়ে উঠেছে এক অন্ধকার রাজ্য, যেখানে টাকার মূল্য আছে, কিন্তু মানুষের জীবনের নয়। সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় নির্যাতন। পাচারকারীরা আমার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। একইভাবে অন্যদেরও নির্যাতন করে। পরিবারের কাছে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হতো। না দিলে অন্য পাচারকারীর কাছে বিক্রি করা হতো। আমি পালানোর দিনও আস্তানায় ২৫০ জনের মতো বন্দি ছিল।”

তিনি আরও জানান, “হোটেল আল করমের ম্যানেজার আমিনই আমাকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। পর্যটকরা নিয়মিত অপহরণের শিকার হচ্ছে। এখনও শতাধিক মানুষ ওই আস্তানায় বন্দি আছে। তাদেরও উদ্ধার করা প্রয়োজন।”

হোটেল মালিকের বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেল আল করমের মালিক মোহাম্মদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “এটি আমাদের পারিবারিক হোটেল। ১০ বছরের জন্য অন্যদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আমিনকে দুই বছর আগে বাদ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে সে আমাদের হোটেলের কেউ নয়।”

অন্য ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা
একই আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া টেকনাফের নয়াপাড়ার আয়েশা খাতুন বলেন, “পরিচিত এক নারীর সঙ্গে বেড়াতে এসে অপহরণের শিকার হই। আমাকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে পাহাড়ে আটকে রাখা হয়। গাদাগাদি করে একটি ঝুপড়িতে রাখা হয়েছিল। ছয় দিন অমানবিক কষ্ট সহ্য করেছি। বিজিবি না এলে হয়তো আমরা মারা যেতাম।”

মুন্সীগঞ্জের অমিত হাসান ও মানিক মিয়াও অপহরণের শিকার হন। কক্সবাজারের এক বাসিন্দার আমন্ত্রণে ঘুরতে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাদের। থাইল্যান্ডে পাচারের জন্য পাহাড়ি আস্তানায় বন্দি রাখা হয়। ২০ দিন পর বিজিবি-র‍্যাব অভিযানে তারা উদ্ধার হন।

বিজিবি-র‍্যাব জানায়, উদ্ধার হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে চারজনকে জোরপূর্বক অপহরণ করা হয়েছিল, বাকিদের বিভিন্ন প্রলোভনে সেখানে আনা হয়। অনেকে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডে চাকরির লোভে, কেউ কেউ বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে সেখানে যান। উদ্ধার হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে ৬৬ জনই রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা।

রোহিঙ্গা যুবকদের অভিজ্ঞতা
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ এনাম (২২) ও আমিন বাহার (২৪) জানান, ক্যাম্পের খারাপ পরিস্থিতির কারণে মালয়েশিয়া যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। দালালের মাধ্যমে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা বলেন, “মালয়েশিয়ায় পৌঁছালে ছয় লাখ টাকা দিতে হবে—এমন শর্তে আমরা রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু দালাল আমাদের পাহাড়ে আটকে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। যারা টাকা দিয়েছিল তাদের আলাদা করে রাখা হতো।”

নিউজটি শেয়ার করুন

কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়াদের টার্গেট, অপহরণকারী চক্র সক্রিয়
পাহাড়ে আস্তানায় বন্দিশালা, একজনের তথ্যে ৮৩ জন উদ্ধার

আপডেট সময় : ১২:০২:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পান্টি গ্রামের রেজাউল করিম ঘুরতে গিয়েছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফে। তিনি উঠেছিলেন স্থানীয় হোটেল আল করমে। সেখান থেকে ৭ সেপ্টেম্বর তাকে অপহরণ করে মো. আমিন নামের এক ব্যক্তি, যিনি হোটেলটির সাবেক ম্যানেজার। পরে আমিন তাকে ৫০ হাজার টাকায় মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়। তারা আবার আরেক দলে বিক্রি করে। শেষ পর্যন্ত টেকনাফের বাহারছড়া কচ্ছপিয়ার গভীর পাহাড়ে একটি আস্তানায় আটকে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন চালানো হয়।

রেজাউল জানান, টেকনাফ পৌর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের ঝরনা চত্বর থেকে কয়েকজন লোক হঠাৎ করে তাকে অপহরণ করে। পরে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, অপহরণের শিকার হয়েছেন। পাহাড়ি আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হলে ৫০ হাজার টাকায় মানব পাচারকারীদের কাছে তাকে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে ১৩ দিন ধরে চলতে থাকে অমানবিক নির্যাতন। গত শনিবার তাকে আবার ৬০ হাজার টাকায় আরেক দলে বিক্রি করা হয়। নতুন দলটি তাকে আরেক পাহাড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি দৌড়ে পালিয়ে পাহাড় বেয়ে নেমে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত বিজিবির কাছে আশ্রয় নিয়ে নিরাপদে ফেরেন।

রেজাউলের তথ্যেই ৮৩ জন উদ্ধার
রেজাউলের দেওয়া তথ্যে যৌথ অভিযান চালিয়ে র‍্যাব-বিজিবি কচ্ছপিয়ার পাহাড় থেকে নারী-শিশুসহ আরও ৮৩ জনকে উদ্ধার করে। তাদের সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচারের পরিকল্পনা ছিল। এ সময় অস্ত্র ও গুলিসহ তিন মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সোমবার টেকনাফ-২ বিজিবির সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান ও র‍্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান।

পাহাড়ের আস্তানা বর্ণনা করতে গিয়ে রেজাউল করিম বলেন, “চোখ খুলতেই দেখি চারপাশে শত শত মানুষ বন্দি। পাহাড়ের ভেতরে গড়ে উঠেছে এক অন্ধকার রাজ্য, যেখানে টাকার মূল্য আছে, কিন্তু মানুষের জীবনের নয়। সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় নির্যাতন। পাচারকারীরা আমার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। একইভাবে অন্যদেরও নির্যাতন করে। পরিবারের কাছে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হতো। না দিলে অন্য পাচারকারীর কাছে বিক্রি করা হতো। আমি পালানোর দিনও আস্তানায় ২৫০ জনের মতো বন্দি ছিল।”

তিনি আরও জানান, “হোটেল আল করমের ম্যানেজার আমিনই আমাকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। পর্যটকরা নিয়মিত অপহরণের শিকার হচ্ছে। এখনও শতাধিক মানুষ ওই আস্তানায় বন্দি আছে। তাদেরও উদ্ধার করা প্রয়োজন।”

হোটেল মালিকের বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেল আল করমের মালিক মোহাম্মদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “এটি আমাদের পারিবারিক হোটেল। ১০ বছরের জন্য অন্যদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আমিনকে দুই বছর আগে বাদ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে সে আমাদের হোটেলের কেউ নয়।”

অন্য ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা
একই আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া টেকনাফের নয়াপাড়ার আয়েশা খাতুন বলেন, “পরিচিত এক নারীর সঙ্গে বেড়াতে এসে অপহরণের শিকার হই। আমাকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে পাহাড়ে আটকে রাখা হয়। গাদাগাদি করে একটি ঝুপড়িতে রাখা হয়েছিল। ছয় দিন অমানবিক কষ্ট সহ্য করেছি। বিজিবি না এলে হয়তো আমরা মারা যেতাম।”

মুন্সীগঞ্জের অমিত হাসান ও মানিক মিয়াও অপহরণের শিকার হন। কক্সবাজারের এক বাসিন্দার আমন্ত্রণে ঘুরতে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাদের। থাইল্যান্ডে পাচারের জন্য পাহাড়ি আস্তানায় বন্দি রাখা হয়। ২০ দিন পর বিজিবি-র‍্যাব অভিযানে তারা উদ্ধার হন।

বিজিবি-র‍্যাব জানায়, উদ্ধার হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে চারজনকে জোরপূর্বক অপহরণ করা হয়েছিল, বাকিদের বিভিন্ন প্রলোভনে সেখানে আনা হয়। অনেকে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডে চাকরির লোভে, কেউ কেউ বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে সেখানে যান। উদ্ধার হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে ৬৬ জনই রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা।

রোহিঙ্গা যুবকদের অভিজ্ঞতা
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ এনাম (২২) ও আমিন বাহার (২৪) জানান, ক্যাম্পের খারাপ পরিস্থিতির কারণে মালয়েশিয়া যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। দালালের মাধ্যমে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা বলেন, “মালয়েশিয়ায় পৌঁছালে ছয় লাখ টাকা দিতে হবে—এমন শর্তে আমরা রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু দালাল আমাদের পাহাড়ে আটকে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। যারা টাকা দিয়েছিল তাদের আলাদা করে রাখা হতো।”