জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কেনো ঐকমত হচ্ছে না, বাধা জামায়াত-এনসিপি?
- আপডেট সময় : ০১:০৭:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
- / 72
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর করতে রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জরুরি বৈঠকেও ‘সংকট’ কাটেনি।
রাষ্ট্র সংস্কারের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা সম্বলিত জাতীয় সনদ কীভাবে কার্যকর হবে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হবে কি না, এবং সংস্কার বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত ভিন্নমতের সুরাহা কীভাবে হবে—এসব বিষয় নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়ে গেছে।
বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে অনুষ্ঠিত জরুরি বৈঠকে দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট হলেও মতভেদ দূর হওয়ার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা নতুন করে ‘সংকটের’ কথা উল্লেখ করেন।
জুলাই সনদ স্বাক্ষরে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি ‘শর্ত’ দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চায় জামায়াত, আর বিএনপি একসঙ্গে দুই নির্বাচন আয়োজনকে বাধা মনে করছে না।
এনসিপি ও বামধারার চারটি দল সংস্কার সংক্রান্ত ভিন্নমতের নিষ্পত্তি কীভাবে হবে—তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এছাড়া সনদ বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ বা আদেশ জারির বিষয়টিও এনসিপি সামনে এনেছে।
বাম ধারার চার দল জানিয়েছে, তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। এমন অবস্থায়ও ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ স্বাক্ষর নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় দলিলটি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। তার আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কমিশন ৩২টি রাজনৈতিক দল ও একটি জোটের কাছে জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া পাঠায়।
কিন্তু এর দুই দিন পর হঠাৎ করেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জরুরি বৈঠক ডাকেন কমিশনের প্রধান। এর আগে দুপুরে তিনি কমিশনের সদস্যদের সঙ্গেও আলাপ করেন।
বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে শুরু হওয়া বৈঠক চলে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা, যা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় একই বছরের অক্টোবরে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসব কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়ার পর সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন–সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশে ঐকমত্যে পৌঁছাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু হয়।
দীর্ঘ সংলাপ ও আলোচনার পর ঐকমত্য কমিশন রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ১৭টি বিষয়ে ৮৪ দফা নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করে। বাকি ৬৭টি বিষয়ে কিছু দল ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে।
জাতীয় সনদের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৪৭টি সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে, আর বাকি ৩৭টি আইন, বিধি বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য বলে উল্লেখ করেছে কমিশন।
৪০ পৃষ্ঠার এই দলিলে সনদের পটভূমি, সংস্কার প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার উল্লেখের পর স্বাক্ষরের স্থান রাখা হয়েছে।
সনদ স্বাক্ষরের পর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।
এর মধ্যেই হঠাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই জরুরি বৈঠকে ‘সংকটের’ বিষয়টি সামনে আসে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সিপিবি সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহীল কাফি রতন, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা, এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ ৩১টি দল ও জোটের নেতা।
‘সনদের সাথে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই’
ঐকমত্য বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন, “আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং ভোট যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়—সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
“এই নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে জুলাই সনদের সম্পর্ক কী? আমি মনে করি, জুলাই সনদের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।”
বিএনপি নেতা আরও বলেন, “সংস্কার সারা জাতি চায়, আমরাও চাই। যেই দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদেরকে এটা বাস্তবায়ন করতেই হবে। গণভোটের কথাও আমরা বলেছি।”
তিনি যোগ করেন, “আমরা সবাই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। যে সব বিষয়ে ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে, তা স্পষ্টভাবে দফাওয়ারি উল্লেখ থাকবে। আলোচনার উদ্দেশ্যই ছিল এই ভিন্নমতগুলো স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা।
“গণভোটের মাধ্যমে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে, যাতে জুলাই সনদের সব প্রস্তাব ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়।”
নির্বাচনের আগে গণভোটের শর্ত জামায়াতের
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “গণভোট কখন হবে, এ নিয়েই আমাদের ভেতরে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে।
“আমরা বলেছি, গণভোট সংস্কার কমিশনের জন্য—এটা আলাদা বিষয়, আর জাতীয় নির্বাচন আরেকটি বিষয়। গণভোটে কিছু দিক আছে, যেগুলো হ্যাঁ/না ভোটে নির্ধারিত হলে নির্বাচনী আচরণবিধিতে প্রভাব ফেলবে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি গণভোট নির্বাচনের দিনেই হয়, তবে উচ্চকক্ষের প্রশ্ন ঝুলে থাকবে। তাই আমরা নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছি।”
শুক্রবারের অনুষ্ঠানে সনদে স্বাক্ষর করবেন কি না জানতে চাইলে তাহের বলেন, “মাত্র একদিন বাকি আছে, ওইদিন গেলেই ইনশাল্লাহ দেখে ফেলবেন।”
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মতিউর রহমান আকন্দও নভেম্বরে গণভোটের দাবিতে অবস্থান জানান।
‘জুলাই সনদ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে’
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদ স্বাক্ষর করতে কিছু শর্ত দিয়েছেন তারা, যা একদিনেই পূরণ সম্ভব।
তিনি বলেন, “আমরা চাই, সনদ বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার করেই স্বাক্ষরের দিকে এগোনো হোক। জাতিকে অস্পষ্ট রেখে কোনো উদ্যোগ সফল হবে না।”
আখতার হোসেন আরও বলেন, “আমরা দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে জুলাই সনদের দিকে এগিয়েছি, কিন্তু শেষ মুহূর্তের কিছু বিষয় শঙ্কা তৈরি করেছে। নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হয়নি—এগুলোর বাস্তবায়নের পথরেখা পরিষ্কার হওয়া দরকার।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন, প্রধান উপদেষ্টা সরকার প্রধান হিসেবে একটি ‘সংবিধানিক বা সংস্কার আদেশ’ জারি করবেন, যার মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন হবে।
‘সনদে স্বাক্ষর করবো না’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণফোরাম, বাসদ ও বাসদ মার্কসবাদী—এই চার দল জানিয়েছে, তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, “রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাদ দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা, নোট অব ডিসেন্টের অস্পষ্টতা—সব মিলিয়ে আমরা সনদে স্বাক্ষর করবো না। বিস্তারিত জানাতে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করবো।”
‘উৎসবের’ আশাবাদ প্রধান উপদেষ্টার
রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতা সত্ত্বেও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, শুক্রবার উৎসবমুখর পরিবেশে জুলাই সনদে স্বাক্ষর সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে স্বাক্ষরিত এই সনদের কলম ইতিহাস জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে।”
একইসঙ্গে তিনি ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন।
বৈঠকের সভাপতির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত রাজনৈতিক নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এটা বাংলাদেশের ও সমসাময়িক রাজনীতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা।”
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “জুলাই সনদ স্বাক্ষর নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, তা সঠিক নয়। আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন, এবং আমরা আশাবাদী—একটি আনন্দঘন পরিবেশে এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।”

















