ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে তিন পক্ষের কে কী পেল
- আপডেট সময় : ১১:০৪:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
- / 181

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ১২ দিন ধরে চলা যুদ্ধের পর ঘোষিত যুদ্ধবিরতি বিশ্বজুড়ে আপাত স্বস্তি এনে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ অভিযানের মাধ্যমে ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালানোর পর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
যুদ্ধবিরতির ঠিক আগে ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে আঘাত হানে। মনে করা হয়েছিল, এটি ছিল তেহরানের শেষ মুহূর্তের একপ্রকার প্রতীকী শক্তি প্রদর্শন। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পরেও ইরান আবারও হামলা চালায়। তবে ইসরায়েলের নতুন হামলার খবর মেলেনি, যদিও হুমকি রয়েছে।
পুরো যুদ্ধই ছিল নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ, বিশেষ করে শেষ ১২ ঘণ্টায়। গত সপ্তাহেই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র দুই সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এর মাত্র দুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমান ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ফলে পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা বহুগুণ বেড়ে যায়। এরপর সোমবার ইরান কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেদ সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এতে আশঙ্কা তৈরি হয় যে, এই আঞ্চলিক যুদ্ধ হয়তো আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে। তবে নাটকীয়ভাবে এর পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তেল আবিব ও তেহরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই যুদ্ধবিরতির ফলে এখন তিন পক্ষই—যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েল—নিজ নিজ জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারাই জয়ী হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা অনেকটাই ধ্বংস করেছে। ইসরায়েল দাবি করছে, তারা তেহরানকে যথেষ্ট দুর্বল করে দিয়েছে। অন্যদিকে ইরান বলছে, তারা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পিছু হটেনি।
আধুনিক যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘ঘরোয়া বার্তা’ বা নিজ দেশের জনগণের কাছে নিজেকে বিজয়ী হিসেবে তুলে ধরা। এই তিন দেশের প্রচারযন্ত্র এখন সেই কাজেই ব্যস্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে অর্জন
যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে কথা বলে এসেছে। কিন্তু গত রবিবার এই অবস্থান পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। তখনই বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে “মধ্যপ্রাচ্যের দাঙ্গাবাজ” বলে আখ্যা দিয়ে সতর্ক করেন, ইরান “শান্তি না চাইলে” পরবর্তী হামলাগুলো হবে “আরও ভয়ঙ্কর ও অনেক সহজ”। তিনি দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো “সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস” হয়ে গেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা গেছে সাইটগুলো “অত্যন্ত গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত” হয়েছে।
তবে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকেরা জানতেন, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়। কেবল কূটনৈতিক দিক থেকে নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও ট্রাম্পের জন্য এটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ তিনি আগেও বারবার যুক্তরাষ্ট্রকে “চিরস্থায়ী যুদ্ধে” জড়ানোয় তার পূর্বসূরিদের সমালোচনা করেছেন।
ট্রাম্প বুঝতেন, ইরানের জন্য এমন একটি প্রস্থানের পথ রাখা দরকার, যাতে তারা সংঘাত থেকে সরে আসতে পারে। কিন্তু দেশের জনগণের কাছে তাদের অবস্থান যেন দুর্বল না দেখায়।
আর এই কারণেই, ইরান যখন পূর্ব সতর্কতা দিয়ে কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালায়, তখন ট্রাম্প পাল্টা জবাব না দিয়ে বরং যুদ্ধ থামানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ট্রাম্প পরে এক পোস্টে লেখেন, “আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, কোনও আমেরিকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এবং ক্ষয়ক্ষতিও খুব সামান্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের (ইরানের) সব ক্ষোভ হয়তো এখন বের হয়ে গেছে। আশা করি আর কোনও ঘৃণার ঘটনা ঘটবে না।”
তিনি ইরানকে “আগে থেকে জানিয়ে দেওয়ার” জন্য ধন্যবাদও জানান।
এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প এখন একজন শান্তির দূত হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারছেন। যদিও কয়েকদিন আগেই তার বোমা হামলা নিয়ে দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।
সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের কেউ নিহত হয়নি। তারা তাদের সামরিক সক্ষমতা শক্তভাবে দেখিয়েছে এবং এখন শান্তি প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও নিচ্ছে। সব মিলিয়ে এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘জয়-জয়’ অবস্থা।
ইসরায়েলের আত্মবিশ্বাস ও বাহাদুরির বার্তা
যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট বিমান হামলার ঠিক আগের সপ্তাহে, ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে তাদের আকাশসীমায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় টার্গেট করে হামলা চালায় এবং তেহরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেয়।
একইসঙ্গে, ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের হত্যা করে। এর মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী শাদমানি অন্যতম। ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন আরও দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা—ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ কাজেমি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মোহাকেও।
ইরানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এই বিমান হামলা। এটি আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী সেনাশক্তি হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল, যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে যুক্ত করা। দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতকে কেবল “ইরান বনাম ইসরায়েল” হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে এবং সরাসরি অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক ছিল।
‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’-এর মাত্র ৯ দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছিলেন, “ইসরায়েলের অভিযান একতরফা, যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িত নয়।” কিন্তু এর কিছুদিন পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পাল্টে ফেলেন। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হুঁশিয়ারি দেন এবং ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে একই পক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা শুধু তেহরান নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই এ বার্তা পৌঁছে দেয় যে, ওয়াশিংটন তেল আবিবের পাশে অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই বার্তা কেবল আন্তর্জাতিকভাবে নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে। কারণ আগামী বছর ইসরায়েলে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
ইরানের ‘প্রতিরোধ ন্যারেটিভ’
যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার পর ইরান এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। একদিকে প্রতিশোধ নেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায়, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ হলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। তাদের এমন একটি প্রতিক্রিয়া দেখাতে হতো, যাতে সম্মান রক্ষা হয়, আবার যুদ্ধ আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে না পড়ে।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, আয়াতোল্লাহ আলি খামেনি বাংকার থেকে নির্দেশ দেন যে, প্রতিশোধ নিতে হবে। তবে তা সীমিত পরিসরে। এজন্য বেছে নেওয়া হয় কাতারে অবস্থিত আল-উদেদ সামরিক ঘাঁটি।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি হিসেবে ধরা হয় এটিকে। ইরানি কর্মকর্তারা মনে করেন, এই ঘাঁটি থেকেই ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ সমন্বয় করা হয়েছিল। তাছাড়া কাতার ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই এটি ছিল কৌশলগতভাবে একটি ভালো লক্ষ্যবস্তু।
বিস্ময়করভাবে ইরান হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে একপ্রকার পূর্ব সতর্কবার্তা পাঠায়। এই বার্তার পর কাতার তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রও হামলার জায়গা ফাঁকা করে দেয়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “ইরান আমাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করার জবাবে যে দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা আমাদের অনুমিতই ছিল এবং আমরা সফলভাবে তা প্রতিহত করেছি।” তিনি ইরানকে আগাম জানিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান।
আগাম সতর্কতা ছিল একটি স্পষ্ট বার্তা। তেহরান শক্তি প্রদর্শন করতে চাইলেও তারা যুদ্ধের নতুন চক্র শুরু করতে চায়নি। ইরান জানতো, তাদের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিক নিহত হলে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হামলায় নামবে। কিন্তু কোনও হতাহতের ঘটনা না ঘটায় ট্রাম্পের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ফলে ইরানও নিজেকে সরিয়ে নেয়।
ইসরায়েলের দিকেও ইরান যুদ্ধবিরতির ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে থাকে। তবে এগুলোতে কেউ নিহত হয়নি। এইভাবে ইরান একদিকে আত্মসমর্পণ না করেই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে।
সব ভালো? হয়তো পুরোটা নয়
মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধবিরতি বিশ্বশক্তিগুলোর জন্য স্বস্তির খবর। তারা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। তবে এই শান্তি এখনও অত্যন্ত নাজুক। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তেহরান এই দাবি অস্বীকার করেছে।
এই সংঘাত আরও একটি বিষয় পরিষ্কার করেছে—ইরান এখন আরও বেশি পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়ানোর যৌক্তিকতা পাচ্ছে। পশ্চিমা শক্তিগুলো স্বীকার করেছে, তারা নিশ্চিত নয় ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদের বর্তমান অবস্থা কী।
ফলে যুদ্ধবিরতি বিশ্বকে স্বস্তি দিলেও বহু প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। বিশ্ব এখন চায়, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরুক এবং কূটনৈতিকভাবে একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক।





















