আহতদের দেখার নামে উপদেষ্টা, বিএনপি, জামায়াত নেতাদের মহড়া
বার্ন ইনস্টিটিউটের ভেতরে-বাইরে বিশৃঙ্খলা
- আপডেট সময় : ০২:৪২:১৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫
- / 208

ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে; আহত ও দগ্ধ হয়েছেন দেড় শতাধিক। ঢাকায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন ৫১ জন ।
আহতদের দেখার নামে হাসপাতালটিতে ভিড় করেন সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। সে সময় সেখানে তার সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের বড় ধরনের ভিড় তৈরি হয়। সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বাদে ৮জন উপদেষ্টা ও রাজনীতিকরা পরিদর্শনে গেলে হাসপাতালটির ভেতরে-বাইরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে হাসপাতালে ভিড় করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন সরকারের উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক নেতারা। চিকিৎসকরা জোড় অনুরোধ করলেও নেতাদের হাসপাতাল পরিদর্শন ঠেকানো যায়নি।
উপদেষ্টা, নেতাদের হাসপাতালে কী কাজ– আহতদের স্বজন এবং সাধারণ মানুষ এ প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, নিজেদের রাজনৈতিক প্রচারের জন্য সংবেদনশীল সময়ে হাসপাতালে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন নেতারা। উত্তরায় উদ্ধার তৎপরতার সময়ও ভিড় করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। তারা এবং উৎসুক জনতার ভিড়ে অ্যাম্বুলেন্সের গতি কমে যাচ্ছিল।
সোমবার দুপুরের দুর্ঘটনায় দগ্ধ শিশু শিক্ষার্থীদের বেলা ৩টার দিক থেকেই অ্যাম্বুলেন্সে একে একে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজসংলগ্ন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেখানে যান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও মাহফুজ আলম। উপদেষ্টাদের গাড়ি, প্রটোকল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িতে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভিড় আরও বেড়ে যায়। উপদেষ্টাদের সঙ্গে ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সাইদুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তবে দেখা যায়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমকে। ভিড়ের চাপে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি উপদেষ্টারা। তাদের প্রটোকল এবং তাদের সঙ্গে থাকা লোকজনের ভিড়ে হাসপাতালের ভেতরে- বাইরে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সাইদুর রহমান কথা বলার সময় বিশৃঙ্খলা দেখা যায়।
নেতাকর্মীর বহর নিয়ে আহতদের দেখতে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। এমন সংকটের সময় রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়ের সমালোচনা করেন রক্ত দিতে আসা সাধারণ মানুষ ও স্বজনরা।
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জামায়াতের আমির এলে তাঁকে ঘিরে ধরা সংবাদকর্মী, ইউটিউবার, কনটেন্ট ক্রিয়েটরের ভিড়ে হাসপাতালের প্রবেশপথ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। শফিকুর রহমানকে হাত নাড়িয়ে উপস্থিত ব্যক্তিদের সম্ভাষণ করতে দেখা যায়। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ শতাধিক নেতাকর্মী ছিলেন দলীয় প্রধানের সঙ্গে। তাদের ভিড়ে অ্যাম্বুলেন্সের পথ আটকে যায়। কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাসহ শফিকুর রহমান হাসপাতালের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের শয্যাপাশে যান।
জামায়াতের আমিরের পর আসেন মির্জা ফখরুল। বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে ছিলেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিনসহ শতাধিক নেতাকর্মী। তাদের ভিড়ে অ্যাম্বুলেন্স আটকে গেলে মির্জা ফখরুল নিজেই পথ করে দেন। পরে তিনি কয়েকজন নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে যান। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীও নেতাকর্মীর বহর নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে যান। এ সময়ে এক নারী চিকিৎসক হাতজোড় করে অনুরোধ করেন ভিড় না করতে। এরপর রিজভী, এ্যানীসহ চারজন হাসপাতালের ভেতরে যান।
হাসপাতালে উপস্থিত স্বজনরা রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতির সমালোচনা করেন। সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এসব ঘটনার ভিডিও দিয়ে সমালোচনা করছেন। হাসপাতালে ভিড় না করতে অনুরোধ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও। তিনি বলেন, ‘আহতদের শরীরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি নেই। আমরা ভিড় করলে, আমাদের শরীর থেকে কী রোগ তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে, এটি বলা মুশকিল। তাই দূরে থেকে দোয়া করুন সবাই।’
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. মারুফ আলম চৌধুরী ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আপনারা যত বেশি আসবেন, সংক্রমণ ঝুঁকি তত বাড়বে। শিশুদের ভালোবাসার কারণেই দয়া করে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া আসবেন না। আজ রক্তের প্রয়োজন নেই।’
প্লাস্টিক সার্জন ডা. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকি হচ্ছে সংক্রমণ। তাই কোনো অবস্থাতেই রোগীর কাছে জীবাণু প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়া যাওয়া যাবে না।’
গুরুতর আহতদের অনেকের জন্য রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে। রক্ত দানের জন্য স্বেচ্ছ্বাসেবী অনেক সংগঠন রক্ত দানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, এ মুহূর্তে রক্তের প্রয়োজন নেই। তবে যারা রক্ত দিতে ইচ্ছুক, তাদের নিবন্ধন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। রক্তের প্রয়োজন হলে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হবে।
রাজনৈতিক নেতাদের এই সদলবলে হাসপাতাল মহড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
সাংবাদিক খালেদ আহমদ লিখেছেন, ‘হে মানবতাবাদী রাজনীতিবিদরা। আমাদের সন্তানদের জীবন বাঁচানোর চিকিৎসার সময় আপনারা দয়া করে ১০০ হাত দূরে থাকুন। চিকিৎসার সুযোগ দিন। দূরে দাড়িয়ে দোয়া করুন। সাহায্য করুন।’
সাংবাদিক মবিন খান লিখেছেন, ‘আহতদের দেখতে বার্ন ইনস্টিটিউটে গেছে উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ড. আসিফ নজরুল, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মাহফুজ আলম ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাহেবান!
সঙ্গে গেছে ওর সকল প্রোটোকল।
আনন্দ!
খালি জানতে চাই উপদেষ্টা সাবেরা কয়জনরে সুস্থ করে বাড়ি পাঠাইছেন?
নাকি গোরস্তানে পাঠাইছেন তারা?
গোরস্তানেই পাঠানোর কথা। কিন্তু উপদেষ্টা সাবেরা যতদিন মন্ত্রীর চেয়ারে বসে থাকবেন ততদিন তারা এইটা বুঝবেন না।
‘উপদেষ্টা, নেতাদের হাসপাতালে কী কাজ– আহতদের স্বজন এবং সাধারণ মানুষ এ প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, নিজেদের রাজনৈতিক প্রচারের জন্য সংবেদনশীল সময়ে হাসপাতালে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন নেতারা। উত্তরায় উদ্ধার তৎপরতার সময়ও ভিড় করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। তারা এবং উৎসুক জনতার ভিড়ে অ্যাম্বুলেন্সের গতি কমে যাচ্ছিল।’
জাভেদ রাসিন লিখেছেন, ‘বার্ন ইউনিটে আমি গিয়েছিলাম কিছু করতে পারি কিনা সেটার জন্য, কোনভাবে সাহায্য করতে পারি কিনা। কিন্তু গিয়েই দেখি সেখানে গুনে গুনে আটজন উপদেষ্টা উপস্থিত, সাথে তাদের প্রটোকল, মিডিয়া, উৎসুক জনতা।
বিরক্ত হয়ে গেলাম, নিজেদের লোক খুঁজে বের করলাম, কিছু করা যায় কিনা বললাম। অভিভাবক বা যারা স্বজন আছেন তাদের অন্তত পানির ব্যবস্থা করার কথা বলাম।
কয়েকজন অভিভাবককে আসতে দেখলাম এর মাঝে। তাদের কান্নায় পরিবেশ এমন ভারি হয়ে গেল, নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি।
এরপরেই দেখলাম এক বাম নেতা, যার কর্মী নেই দশজন, তিনিও দশ পনেরো জন লোকের প্রটোকল নিয়ে হাজির। কয়েকজন লোক নিয়ে মিডিয়ার সামনে বক্তৃতা দেয়া শুরু করলেন। এরপর এলেন আমীর। ভলান্টিয়ার ভাইরা ও হাসপাতালের লোকজন মিডিয়া আর নেতাদের বের করে দিলেন গালাগালি করে।
আমি দেখলাম করার কিছু নেই, কোনভাবে সাহায্য করতে পারছি না। বের হয়ে এলাম। রাস্তায় শুনলাম, রাস্তা আটকে কারা যেন বিক্ষোভ করছে। রাস্তা জ্যাম। মিডিয়ায় আরো কিছু দলের ছবি দেখলাম যারা লাশ দেখার রাজনীতি করতে গেছেন।
আল্লাহ তাদের হেদায়াত দান করুক। বাচ্চাগুলোর জন্য কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। আল্লাহ তাদের জান্নাতের ফুল বানিয়ে দিক। যারা হাসপাতালে আছে তাদের দ্রুত সুস্থতা দান করুক। আল্লাহ তুমি মালিক, রহম করো।’


















