আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কে, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
- আপডেট সময় : ০৯:৫৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
- / 258

আধুনিক ইরানের ইতিহাসে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি হচ্ছেন সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা। ১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি ইরানের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের সঙ্গেই যুক্ত নন, বরং আন্তর্জাতিক পরিসরেও ইরানের অবস্থান রূপান্তর করেছেন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।
শৈশব, শিক্ষা ও বিপ্লব-পূর্ব জীবন
আলি খামেনির জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৯ এপ্রিল, ইরানের মাশহাদ শহরের একটি ধর্মীয় পরিবারে। শৈশব থেকেই তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় মনোযোগী ছিলেন এবং মাশহাদ ও ইরাকের নাজাফ শহরের বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি কওম শহরে স্থায়ী হন এবং সেখানে আয়াতুল্লাহ হুসাইন বুরুজেরদি ও আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির অধীনে অধ্যয়ন করেন।
ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির সরকারের বিরুদ্ধে গোপন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এর জেরে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হন এবং সাভাকের হাতে নির্যাতনের শিকার হন।
বিপ্লব-পরবর্তী উত্থান
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে। এই সময় খামেনি দ্রুত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার কেন্দ্রে উঠে আসেন। তিনি ইসলামি বিপ্লবী পরিষদের সদস্য, উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১ সালে এক হত্যাচেষ্টায় তিনি গুরুতর আহত হন। একটি মসজিদে বক্তব্য দেওয়ার সময় একটি টেপ রেকর্ডারে রাখা বিস্ফোরকে তার ডান হাত স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়।
সেই বছরের আগস্টে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলি রাজায়ী ও প্রধানমন্ত্রী জাভাদ বাহোনার নিহত হওয়ার পর খামেনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হন।
সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব গ্রহণ
১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যু ইরানের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ হয়ে ওঠে। তার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত আয়াতুল্লাহ মনতাজেরিকে শেষ মুহূর্তে বাদ দেওয়া হয়। এমন এক পরিস্থিতিতে খামেনি সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্বে আসেন—যদিও তখন তিনি ছিলেন কেবল ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ পদমর্যাদার একজন মধ্যমপন্থী আলেম। তিনি নিজেই বলেছিলেন, “আমি একজন ক্ষুদ্র মৌলভী, এই দায়িত্বের জন্য নিজেকে উপযুক্ত মনে করি না।”
পরে সংবিধানে পরিবর্তন এনে সর্বোচ্চ ধর্মীয় মর্যাদার পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে খামেনির নেতৃত্বকে বৈধতা দেওয়া হয়।
শাসনকাল: দ্বৈত নেতৃত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্য
শুরুতে প্রেসিডেন্ট হাশেমি রফসানজানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করলেও সময়ের ব্যবধানে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে মোহাম্মদ খাতামির সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা খামেনির রক্ষণশীল অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।
২০০৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচন ছিল তার শাসনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনে মাহমুদ আহমাদিনেজাদের বিজয়ের বিরুদ্ধে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং খামেনির বিরুদ্ধেও সরাসরি স্লোগান তোলে।
২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর হিজাব ইস্যু ঘিরে আবারও দেশজুড়ে বিশাল আন্দোলন শুরু হয়, যেখানে বহু মানুষ নিহত হন এবং খামেনির পদত্যাগের দাবি উঠে। তবে তিনি এই বিক্ষোভকে ‘বাইরের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
পারমাণবিক চুক্তি ও পশ্চিমা বিশ্ব
২০১৩ সালে হাসান রুহানি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর খামেনি কিছুটা নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির আলোচনায় সম্মতি দেন। ২০১৫ সালে ছয় পরাশক্তির সঙ্গে বহুল আলোচিত যৌথ কর্মপরিকল্পনা স্বাক্ষরিত হয়। তবে ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে সরিয়ে নেওয়ায় খামেনি এটিকে ‘আমেরিকার প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেন।
মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত অবস্থান ও প্রতিরোধ অক্ষ
খামেনির অন্যতম কৌশলগত অর্জন ছিল ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ গঠন। এর আওতায় তিনি সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সামরিক ও আদর্শিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কাসেম সোলাইমানির নেতৃত্বাধীন কুদস বাহিনী ছিল এই কৌশলের মূল চালক।
এই প্রতিরোধ কাঠামোর মাধ্যমে খামেনি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ‘কৌশলগত গভীরতা’ তৈরি করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে এগিয়ে যান।
ইসরায়েল প্রসঙ্গে অবস্থান
খামেনির দৃষ্টিতে ইসরায়েল একটি ‘অবৈধ রাষ্ট্র’। তিনি রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেন।
দীর্ঘদিন ছায়াযুদ্ধের পর ২০২৪ সালের ১৩ এপ্রিল ইরান একযোগে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলে হামলা চালায়—যা ছিল এক নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতা, এবং খামেনির প্রতিরোধমূলক কৌশলের সরাসরি প্রকাশ।
উত্তরসূরি কে হবেন?
৮৫ বছর বয়সী খামেনির বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় করে এখন তার উত্তরসূরি নিয়ে জল্পনা তীব্রতর হয়েছে। অনেকে মনে করেন, তার ছেলে মোজতবা খামেনি উত্তরসূরি হতে পারেন। আবার কারও মতে, সদ্য প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির দিকেও ইঙ্গিত ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)–এর অবস্থান এই প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই























