আমি ‘সরকারীপুকুর’ বলছি : জাগো বাহে কোনঠে সবাই
- আপডেট সময় : ০৬:১১:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
- / 479

এক.
আমার নাম পুকুর। আমি পানিবর্তী একটি জলাশয়। আমার ইংরেজী নাম নিশ্চয় আপনাদের জানা আছে ; আমাকে আন্তর্জাতিক ভাষায় pond বলা হয়। আমার পরিচয় বলতে এভাবেই দিতে পারি যে, আমি স্থানীয় পানির ক্ষুদ্র জলাশয়। যা আয়তনে হ্রদের চেয়ে ছোট। আমি দুইভাবেই সৃষ্ট- প্রাকৃতিক ভাবেও আমাদের জন্ম আবার সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব মানুষ দ্বারাও সৃষ্ট। যদিও দুই প্রকারের পুকুরই প্রধানত মানুষের কল্যাণে তৈরী। তবে এটা বলা যায়-মানবসৃষ্ট পুকুরগুলো বাংলাদেশে মূলত মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করার জন্য মাটি কেটে তৈরী করা হয়।
আমি মায়ের মতো। মা যেমন সন্তানকে বুকে আগলে রাখে, আমিও আমার বুকে পানি ধরে রাখি। মা যেমন যাপিত জীবনে নিজের চেয়ে সন্তানের সুখ-দূ:খে আনন্দ,বেদনা অনুভব করে। আমিও বন্যা-খরায় প্রকৃতি-মানুষের কল্যাণে আনন্দ বা দূ:খ নিয়ে কাজ করি। আমার পেটে মাছ হয়, মিঠা পানি পান করে মানুষ,জীব-জন্তু,পাখ-পাখালি। পেটের ভিতরে পুকুরের আরেকটি সমাজ, সংসার আছে; সেখানে বাস করে অগণিত ছোট ছোট প্রাণী, সবুজ লতাপাতা,উর্বর মাটি,বালি ইত্যাদি।
পানি ব্যবহার করেন কৃষক-কৃষাণি,পথচারি,পশুপাখি। গ্রীষ্মের দাবদাহে পাখিরা যখন ঠোট ডুবিয়ে পানি পান করে,ভাদ্রমাসে কৃষক যখন তার হালের বলদটি আমার একপাড়ে নামিয়ে আদর করে ঢলিয়ে গা থেকে কাদামাটি সরিয়ে গোসল দেয়,আর গরুটি যখন নাক উচু করে সাঁতরিয়ে অপারে উঠে ,তখনকার ভালোলাগার মূহুর্তের মুগ্ধতা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।মায়েদের তো দেবার শেষ নেই;মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিলিয়ে দেয়াই মাদের মানবিক ধর্ম।আমি কি তার ব্যতিক্রম হতে পারি!ফলত :আমি সানন্দে,নিরবে তাই করি।
দুই.
মানুষের মতো পুকুরেরও ডাকনাম আছে, ভাবতেই ভালো লাগে। গ্রামে-গঞ্জে আমাকে অনেকে ‘পুস্কুরুণী’ বলেও ডাকে। শুনতে খুব মধুর লাগে। এক্ষেত্রে কবি-সাহিত্যিকরা আরও এগিয়ে আছেন। তাদের উপমায় আছে অনেক বিশেষণ- শান্তপুকুর, বদ্ধপুকুর,। ‘নিঝুম সন্ধায় হঠাৎ একটি শোলমাছ আদার ধরতে একহাত লাফিয়ে উঠল;আমি আৎকে ওঠলাম,।অথবা ‘ক্ষুর্ধার্ত মাছরাঙ্গা পাখি ভাদ্রমাসের দুপুরে পুকুরে দাড়িয়ে থাকা বাঁশের কঞ্চির উপর বসে যেভাবে নিবন্ধ চোখে চেয়ে থাকে, ঠিক সেভাবে আবুল স্কুল ফেরত প্রিয়তমা পারুলকে দেখছে।’ ইত্যাদি কত উপমা।
রাজনীতিবিদরা তো অতিকথা আওড়াতে আমাকে ব্যবহারে পরম তৃপ্তিপান-‘সরকারী দল সবখানে ‘পুকুরচুরি’ করছে’, আবার,সরকারী দল বিরোধীদলকে গায়েল করতে বলে- ‘বিগত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে সবগুলো মন্ত্রনালয়ে রীতিমতো ‘পুকুরচুরি’ করেছে। অর্থাৎ আমি নগন্য পুকুর মানুষের জন্য সবখানে আছি-মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের ভালোবাসায়।মানুষের উপমায়।
তিন.
গত ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখ থেকে আমরা, বিয়ানীবাজারের সকল পুকুরদের মন ভালো নেই। যদিও আধুনিকতা, সভ্যতার ছোঁয়ায় প্রতিনিয়ত আমাদেরকে আপনারা ভরাট করে হত্যা করছেন। আধুনিকতা, সুশিক্ষা, সভ্যতার দোহাই দিয়ে প্রতিদিনই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে নিরীহ পুকুরের প্রতি অমানবিক ব্যবহার চলছে।আমাদের মন ভীষণ খারাপ করেছে সিলেট বিয়ানীবাজারের একটি সরকারী পুকুর ভরাট এর সংবাদ প্রকাশের পর। আজ আমিই বিয়ানীবাজারের ‘সরকারীপুকুর’।আপনাদের সামনে দূ:খ-কষ্ট-যাতনা-মিনতি নিয়ে দাড়িয়েছি:
বহু ঐতিহ্যের ধারক-বাহক বিয়ানীবাজার এর অন্যতম বড় পুকুরটি শত বছরের প্রাচীন পুকুর।এই অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা,সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ইতিহাস এর আলোকউজ্জল দিক সিলেট বিভাগ সহ বাংলাদেশে উচ্চারিত। আমি এই বিয়ানীবাজার এর সরকারীপুকুর,এই প্রসংঙ্গে এখন যেতে চাচ্ছিনা। তবে দুটি কথা স্বরণে নিয়ে বলতে চাই- বিয়ানীবাজার অঞ্চল একটি মানবিক অঞ্চল-ও বটে। ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে দেখা যাবে, এই অঞ্চলে, অতীতে যেমন উচ্চবর্ণের হিন্দুধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা চরমে ছিল,আবার,তৃণমূল মানুষরা, বিশেষ করে কৃষিকাজে গোটা অর্থনীতিতে অন্যতম চালিকা শক্তিতে নেতৃত্বেও ছিল।
সমাজকে আলোকিত করতে জায়গা সম্পত্তি,অর্থকড়ি সব দশহাতে বিলিয়েও দিয়েছেন এমন সমাজ হিতৈষীরা এখানে অমর হয়ে আছেন। ৪৭ এর দেশ ভাগের দুর্বলতাকে পুঁজিকরে অনেক মুসলমান- ‘সোনার চেয়েও দামী জমি’ দখল করে তথাকথিত মালিক হয়েছেন। শত্রুসম্পত্তি অনেক চুর-বাটপারকে কোটিপতি বানিয়েছে,গায়ে মুজিবকোট পরিয়ে রাজনৈতিক ভাবে পূনর্বাসিত করা ইত্যাদি নিকট অতীতের অন্ধকার ইতিহাস হলেও বিয়ানীবাজার অঞ্চলের অনেকগুলো কৃর্তিমান ইতিহাস দেশ-বিদেশে উজ্জল হয়ে আছে।
আমাদের অঞ্চলকে ‘পঞ্চখন্ড’ বলা হয়। আরেকটি আলো ঝলমল নাম আছে আমাদের; ইতিহাসে- বিয়ানীবাজারকে কালের ‘নবদ্বীপ’ বলা হয়। এইসব দ্বীপ্তিমান নাম এমনি এমনি হয়নি- শত বছরের শিক্ষা, অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক অগ্রসমান ‘আলোকবৃষ্টি’ উৎসমূলে একহতে পেরেছিল বলেই আমাদের নাম দেশ বিদেশে উচ্চারিত ও প্রসংশিত। আমি গর্বিত সেই অঞ্চলে ‘পুকুর’ হিসাবে আমার জন্ম বলে।
এইসব সময়কে ধারণ করে বিয়ানীবাজার সরকারী পুকুর তা দেখে,শুনে আসছে শত বছর থেকে। ব্রিটিশ আমলে আমার জন্ম এবং এযাবৎ আমি আপনাদের সেবা ও অবহেলা দুটো নিয়েই ঠিকে আছি।
আমারও ভাষা আছে,তবে আক্ষরিক অর্থে মানুষের মতো নয়। আমি এ্যাক্ট বা রিএ্যাক্টও করি। মানবিক বোধে,আমাকে আপন করে নিয়ে ভাবলে, আমি এবং আমার প্রকৃতির ভাষা অনেকে যে ভালো বুঝেন তাও জানি হলফ করে।
চার.
একদা বিয়ানীবাজার শহরটি টিলাময় সবুজ বনজঙ্গল বেষ্টিত ছিল। মানবিক মানুষগুলোর সাথে আমি হেটেছি কালের পথ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অনেক আগে বিয়ানীবাজার হাসপাতালের অগণন মানুষের পানির প্রধান অবলম্বন ছিলাম-আমি ‘সরকারী পুকুর’। বাজারের সকল ব্যবসায়ীদের পানির প্রয়োজন মিটানো হতো আমার জলে। সোনা-রুপা তৈরীর কয়লা ধোয়া হতো, ধোপার কাপড়, কাঁচামাল, হাড়ি-পাতিল সহ ব্যবসায়ীদের পানির প্রয়োজন মিটানো হতো আমার জলে। মানুষের গোসল তো ছিলই। মাছেরও আধার ছিল আমার বুকে।
মানুষের কল্যাণের জন্যই তো মানবিক মানুষগুলো পুকুর তৈরী করেন। আমার পুকুর পাড় মানুষ তার দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত রাখতো।সূর্যের আলোয় পানির নাচনে আমি সরব থাকতাম- এভাবেই ছিল মানুষের সাথে আমার আতিথেয়তা।
ধীরে ধীরে আমার সাথে, আমার প্রতিবেশীদের আত্মীয়তা কিছুটা ভাটা পড়তে লাগল। কিছু বাস্তব কারণও ছিল-স্বাধীন দেশে মানুষের সম্ভাবনার দিকগুলো উন্মোচিত হওয়ায় শিক্ষা,বাণিজ্য ও বিদেশমূখীতায় বিয়ানীবাজার থেকে অসংখ্যজনকে দূরে যেতে হয়েছে। বস্তুত: সেটা ছিল আমার নি:সঙ্গতাবোধের একটা হৃর্দিক আচড় ।
তবে প্রায় এক দশক পরেই আমি মূলত ধাক্কাটা খাই। আমার গায়ে মানুষের লুলোপ দৃষ্টিপড়ে। যারা আমার প্রতিবেশী ছিল,যারা নিয়ত আমার সেবাগ্রহণ করেছে ও আমাকে ব্যবহার করেছে,নিজেদেরকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে; তারাই ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করতে লাগল!
পিঁপড়া যেমন খাবারের অন্বেষণে আশপাশে হন্যে হয়ে ঘুরে, আমার চারপাশে, আমার ছায়ায় বেড়ে উঠা মানুষজন আমার পুকুরপাড় গ্রাস করতে উদ্যোত হয়। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি ক্ষমতার অপব্যবহার, পেশীশক্তির দাপট, আঞ্চলিক রাজনীতির বিভৎস রুপ।যার কাছে মানুষ বিচার চাইবে,যাদের বাহ্যিক রুপ ভালো মানুষের আদলে, যাদেরকে সাধারণ মানুষ সামাজিকভাবে ‘আদবি-বিচারি’ মানুষ ভাবে; তারাই এই দখল দারিত্বে সামনের সারিতে আছেন।
পাচ.
পিঁপড়ার অনেক গুণ আছে-তারা কাজগুলো সম্মিলিতভাবে করে এবং সবগুলো কাজই তাদের সম্মিলিত ভালোর জন্য করে। যেমন-বৃষ্টির দিনে খাবার সংগ্রহের জন্য তারা মাটির নিচে নিরাপদ আবাস বানায় এবং নিজের চেয়ে তেইশ গুণ বেশী ওজন এক একটি পিঁপড়া বহন করতে পারলেও খাবার সংগ্রহ এবং নিরাপদ আবাস তৈরীতে সবাই সম্মিলিতভাবেই কাজ করে।
আমি ‘সরকারী পুকুর’, আশ্চর্যভাবে কিছু আশরাফুল মাখলুকাতের আমার প্রতি তাদের ব্যবহার দেখলাম- সম্পূর্ণ উল্টো। পুকুর এর আশপাশের ভূমি খেকোরা সবাই তলে তলে এক হয়ে মানুষের সেবার বিরুদ্ধে গেল। আমার চারপাশ তারা দখল করে নিল।
আমি তো কারো উপকার ছাড়া ক্ষতি করি না। অপকার করা আমাকে ধর্মে ও স্বভাবে নাই।তাহলে মানুষ কেন পিপড়ার চেয়ে নিকৃষ্ট হলো!সেই থেকেই শুরু আমাকে তিলে তিলে গভীর পরিকল্পনা মাফিক গ্রাস করার স্বড়য়ন্ত্র।
প্রায় ষাট শতকের বেশী আয়তনের এই আমি (সরকারীপুকুর) কী অপরাধ করেছি বিয়ানীবাজার এর মানুষের কাছে, জানিনা। তবে আমি জানি, আমার আশপাশ প্রতিদিন একটু একটু করে ভরাট হচ্ছে- দোকানদার তার দোকান পরিস্কার করে আমার একপাশে আবর্জনা ফেলে ভরাচ্ছেন।আশেপাশের আবর্জনা গুলোতে আমার হৃদপিণ্ডের একপাশ ভড়াট হয়ে গেছে। তৃণমূল মানুষ আমাকে ‘পানির বিনে পয়সার আঁধার’ বলে সন্বোধন করে।পঞ্চখন্ডের বিয়ানীবাজার শহর ও প্রকৃতি আমাকে ‘মা’ বলে ডাকে ; সেই মায়ের বুকে দাঁড়িয়ে পেশাব করেন!
এই নিদারুণ সময়ে,আমি চেয়ে চেয়ে দেখি- নানা অভিধায় আখ্যায়িত যেমন-আধুনিক বিয়ানীবাজার পৌরশহর, ডিজিটাল শহর বা সাংস্কৃতিক শহরকে।আমি ‘বিয়ানীবাজার সরকারী পুকুর’, অর্ধেক হৃদপিন্ড নিয়ে স্বচ্ছ দেখি- শত বছরের ঐতিহ্যবাহি আমার প্রিয় পঞ্চখন্ড কে ।বুকে ধারণ করা- জ্ঞানের আলোয় ভরা ‘নবদ্বীপ’কে। ‘বিহান’ বেলার অতি মানবিক বিয়ানীবাজারকে।
কোন কিছু মিলাতে পারিনা। যোগ,বিয়োগ,জ্যামিতি,ভার্চুয়াল আলগারিদম কোন কিছুতেই তো হিসাব মিলেনা! তবে স্পষ্টত, অগণন তৃণমূল মানুষের চোখ ও মুখে বোবাকান্না দেখি।
সাথে সাথে আমার চোখে ভাসে- অরুণ-বরুণ-ছলিম-করিম-আবুল,চাচা,দাদা-কাকা-বড়দা’দের মুখ। তাঁরা বাজারে চায়ের দোকান দিয়েছেন,বারোমাসি সবজি-তরকারী বিক্রি করেছেন।আম ,কাঠাল,কমলা,আনারস ইত্যাদি আড়তের মতো ব্যবসা করেছেন। কখনও বাজারকে অপরিচ্ছন্ন রাখেননি,আমার বুকে এসব ফেলা তো তাদের কাছে ‘লক্ষীর ঘরে আগুন’- দেবার মতো ছিল।
তাঁদের গায়ে তেমন দামী পোশাকও ছিলনা। আজকের মতো বাহারী পোশাক তো নয়-ই। লুঙ্গি-ধুতির কাপড়ে পকেটও ছিলনা।
অথচ আজকের এই স্মার্ট সময়টা দেখুন,-….এমনকি ,মুখায়ব মুছে টিস্যুটি যত্নে রাখার জায়গা প্যান্ট,পায়জমায় রেখেই তৈরী হয়েছে মূলত পরিচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থার চিন্তাকে মাথায় রেখে।বাস্তব নির্মমতা হচ্ছে-এইসব পোষাক পরেই বর্তমানে সুশীল ও সাধারণরা টিস্যু থেকে শুরু করে অব্যবহৃত সবকিছু রাস্তায় ফেলে দিব্যি লজ্জাহীন চলেন!
আমি এমনিতেই আগ্রাসন, অবহেলা,অমানবিকতায় মৃত প্রায়। এখন আমার হৃদপিন্ডে শেষ পেরেক মারা হচ্ছে। আমার বুকে নাকি জেলা প্রশাসক এর অর্থায়নে বহুতল ভবন তুলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বাচনিকভাবে বলা হচ্ছে- পুকুরটিকে রেখেই নাকি ভবন তৈরী করা হবে! এবং আশপাশের দোকান মালিকদের পূনর্বাসনের আওতায় রাখা হবে!
ছয়.
মানুষকে আধ্যাত্মিক অর্থে-‘আটকুঠুরী নয় দরজা’- বিশিষ্ট বলা হলেও সাধারণভাবে পা-থেকে মাথা পর্যন্তই মানুষের শারীরিক কাঠামো।আমাদের হাত-পা বা শরীরের যেকোন জায়গায় আঘাত পেলে আমরা এই নিদৃষ্ট জায়গার কথা উল্লেখ করে বলি-(হাত বা পায়ে) ব্যাথা পেয়েছি। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, এই ব্যাথাটা আসলে প্রথম বুঝে মস্তিস্ক’র একটি অংশের বিশেষ কোষগুলো। তো,আমি শত বছরের সরকারী পুকুর, ব্রিটিশ আমলে আমার জন্ম। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো কেটে( অতীতেও করা হয়েছে, এখন আবার নতুনভাবে কেটেকুটে) কীভাবে আমার শুধু হৃদপিন্ডকে বাঁচিয়ে রাখবেন?
আগেই জোরালো ,স্পষ্টভাবে বলেছি, আপনাদের প্রকৃতি ও সমাজে আমাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করা হয়।এই জায়গায় আমারও অহংকারবোধ আছে। অর্থাৎ গর্ব করে বলতে পারি যে, আমি,ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত। যাকে আপনারাই নাম দিয়েছেন ‘সরকারী পুকুর’। কোনভাবেই আমি ‘গরীব’ নই। আমি জন্মগতভাবেই পরিচিত। আমার ‘বংশ- পরিচয়’ নিয়েই জন্ম লাভ করেছি। আমার আয়তন ,পরিধি,উদ্দেশ্য সবকিছু বর্তমান সময়ের কারো দয়া বা সহমর্মীতায় পাওয়া নয়। এগুলো রাষ্ট্রের সকল নথিপত্রে ষ্পষ্ট আছে।
আরেকটি কথা বলতে চাই-সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্মে, অনলাইন পোর্টাল ও সংবাদপত্রে দেখলাম, বলা হচ্ছে,‘পুকুরটি ভরাট করা হবে না’। পুকুর পাড়ে ভবন হচ্ছে।
আমি জানতে চাই, কোন অধ্যাদেশে পুকুরকে শুধু জলাশয়ের ভেতরের অংশকে বুঝায়? পাড়বিহীন জলাশয় কি পুকুর হয়? আমার নির্ধারিত স্থান-চারপাড় নিয়েই আমি পুকুর। আপনাদের দেয়া নাম-বিয়ানীবাজার সরকারী পুকুর।
আমার পাড়ের একদিকে সুরম্য দালান তুললে আমি কি আর পুকুর থাকি। আমার হাত-পা কেটে, এমনকি হৃদপিন্ডের অর্ধেক বাদ দিয়ে আমাকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখবেন? এসব কারা করছেন? কার জন্য করছেন? পরিবেশ ও মানুষের জন্য আত্নঘাতি কাজটি কাকে সুবিধা দিচ্ছে? আমাকে দখলমুক্ত করা বা আরেকটি পুকুর নির্মাণের চেয়ে আমার বুকে ভবনের আগ্রহের বিষয়টি কি জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজ? আমাকে হত্যা না করে আর কি কোন জায়গা নেই ভবন তৈরী করার?
আমার মতো মানবিক সেবাদানকারীকে নিয়ে এতো ষড়যন্ত্র ই-বা কেন? আমি কারও চোখে যেমন ছালি দেইনি, তেমনি ভাঙা পায়েও আমি কুড়াল মারিনি। সে ক্ষমতাও পুকুর হিসাবে তো আমার নেই।
বিনয়ে আরও একটি প্রশ্ন রাখতে চাই- আমার দোষটা আসলে কোথায়? আমি তো স্রোতস্বিনী নদী নই। অথবা তরল প্রাকৃতিক সম্পদ এর উপরে দাড়িয়ে নেই যে, এটাকে অধিগ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রের বৃহত্তর প্রয়োজনে।
দূ:খবোধ থেকে মোটাদাগে দুটি প্রশ্ন আমার মনে উকি দিচ্ছে-১) আমি সরকারী পুকুর কি বিয়ানীবাজার এর জন্য অপয়া? ২)সরকারী পুকুর জনগণের কোন কোন ক্ষতি করছে?
সাত.
প্রবাসী অধ্যুষিত বিয়ানীবাজার শহরটি বলতে গেলে বাংলাদেশের অনুন্নত জেলা সদরের চেয়েও ভৌত অবকাঠামো ও পরিবেশগতভাবে উন্নত। বিয়ানীবাজারে বেশ কয়েকটি সুরম্য আধুনিক শপিং সেন্টার ও দালান আছে।কয়েক হাজার দোকানপাট আছে, যেগুলোতে ব্যবসায়ীক প্রাণচাঞ্চল্যে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের আনাগোনা থাকে।
বিনয়ে জানতে চাই, তাদের কি পানির দরকার পড়ে না, বা ভবিষ্যতেও পড়বেনা? দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে বিয়ানীবাজারে ফায়ার ষ্টেশন স্থাপিত হয়েছে।বাজারে যদি আগুন লাগে,পানি কোথায় পাবেন?
সহজভাবে যদি দেখি, ফায়ার সার্ভিসে আছে -বিশেষায়িত একটি ট্যাংক ভর্তি পানির গাড়ি, অগ্নিনির্বাপক ইক্যুইপমেন্টস ও প্রশিক্ষিত রেসকিউ কর্মীদল।বিয়ানীবাজার পৌর শহরের আশপাশে কি কোন জলাধার আছে? বারোপালের দীঘিতে তো মাছ চাষ চলছে!ফায়ার সার্ভিসের বড় ধরনের প্রয়োজনে, অর্থাৎ বিপদে কোথায় থেকে দ্রুত পানি সংগ্রহ করবে পাবে?
আপনারাই তো প্রবাদ তৈরী করেছেন-‘পানির আরেক নাম জীবন!’ আমি তো এই ‘জীবন’কে আষ্টেপিষ্ঠে,নিদারুণ কষ্ঠে, বিনে পয়সায় বুধে ধরে রাখছি।
মানবিকতা চর্চায় বিয়ানীবাজারে অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে। বিয়ানীবাজারে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক ব্যবসায়ী শ্রমিক প্রতিদিন যাওয়া- আসা করেন। আচ্ছা,কোন অতি সাধারণ শ্রমিক প্রচন্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে যদি একটু পানিতে গা ভিজাতে চায় ‘মানবিক শহর’,‘সাংস্কৃতিক শহর’, ‘কালের পঞ্চখন্ড – নবদ্বীপে’? আমি ‘সরকারীপুকুর’ ছাড়া কি আর কোন সরকারী জলাধার আছে?
একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য উল্লেখ করতে চাই-১৯৯৫ সালের প্রকাশিত জরিপের তথ্যানুযায়ী – বিয়ানীবাজার উপজেলার মোট আয়তন প্রায় ২৫১ বর্গ কিলোমিটার। হেক্টর হিসাবে ২৫,০৭২। এর মধ্যে জলাশয় ৬ বর্গ কিলোমিটার এবং নদী ৫ বর্গ কিলোমিটার।১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন মিলে ছোট-বড় মোট পুকুরের সংখ্যা ২৫৮৭টি। এর মধ্যে মজাপুকুর ১,১১১টি।সিংহভাগ পুকুর বসতবাড়ি তে অবস্থিত। প্রবাসী অধ্যুষিত বিয়ানীবাজার ১৪৯ মৌজায় ও ১৮৩টি গ্রামে জনসংখ্যা ২ লক্ষ ১০ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক শতকরা হার প্রায় ২.৫২ ভাগ। উপজেলায় জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৭১১ জন। কৃষক পরিবারের সংখ্যা ৩২ হাজার। উপজেলার মোট আয়তনের হিসেবে মাথাপিছু ১ বিঘা জমিও ভাগে পড়েনা।(তথ্যসূত্র:বিয়ানীবাজার পরিক্রমা; সম্পাদনা-খালেদ জাফরী। এবং জলঢুপ: ইতিহাস ঐতিহ্য- সম্পাদনা; আনোয়ারুল ইসলাম অভি।)
আট.
বাংলাদেশ স্বাধীনের পরবর্তী সময়ে বিয়ানীবাজারে জনস্বার্থে একটি পুকুর খনন করা হয়েছে এমন উদাহনণ নেই। বরং পুকুর স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা ভরাট হয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বারোপাল এর দীঘি থেকে থানা পর্যন্ত এই অল্প জায়গায় বারোটি পুকুর ছিল। সরকারী,শত্রুসম্পত্তি বা জবরদখলকারীদের অধীনে। যা বিভিন্ন উপায়ে ব্যক্তি মালিকানায় নিয়ে ভরাট করা হয়েছে।
এখন ‘নলকূপের যুগ বা পানির সংস্থান নলকুপ ভালোভাবে করছে’ এই খোঁড়া যুক্তি জনপ্রতিনিধিদের কণ্ঠে যখন প্রচারিত হয়, তখন বুঝতে বাকী থাকে না তারা, জনসম্পৃকতা ছেড়ে কতটা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের বিরাজনীতিতে জড়িয়ে আছে।
আমাদের বিয়ানীবাজারে সেরাদের ছড়াছড়ি।রাজনৈতিক লেবাসে, জনসেবায় এতো সেরা খেতাব অর্জনকারী সম্ভবত বাংলাদেশের কোন উপজেলায় খুঁজে পাওয়া যাবে না!
ইউরোপ,আমেরিকা,কানাডা,মধ্যপ্রাচ্যে এই অঞ্চলের মানুষের সংখ্যা অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের চাইতে বেশী সন্দেহ নেই।বাংলাদেশে বিয়ানীবাজার-ই একমাত্র উপজেলা যেখানে, বাংলাদেশের প্রায় সবকটি বেসরকারী ব্যাংকের শাখা রয়েছে।
বিয়ানীবাজারে কাঁচা ও ছনের ছাইনির ঘর এর শতকরা হার কত হবে? অর্থনৈতিক বিবেচনায় নিলে এনিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি ইতিবাচক ফিচার প্রতিবেদন হতে পারে!
ইট-পাথর-মার্বেল এর সুরম্য দালানগুলো বলে দেয়- বিয়ানীবাজার অর্থনৈতিকভাবে যেমন মজবুত তেমনি নান্দনিকতা চর্চায়ও আমরা অনেক এগিয়ে আছি।অর্থাৎ শিক্ষা,সংস্কৃতি,অর্থনীতি,সামাজিক সৃজনশীল চিন্তা- চেতনায় আমরা আলোর পথে হাটছি।
এতো গুণের অঞ্চলে তাহলে আমি নগন্য ‘সরকারীপুকুর’ কেন তুচ্ছ লোভ-লালসার স্বীকার? অসম্ভব ভালো মানুষের ভূমিতে আমাকে কেন হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে? এর পিছনে মীরজাফর-ঘটেসী,খন্দকার মোস্তাক এর প্রেতাত্বা কারা? আর বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধঁবে-ই বা কে?
আমি নিরীহ সরকারীপুকুর,এইসব উচ্চারিত প্রশ্নগুলো বিয়ানীবাজারবাসীর কাছে রাখছি। হে রাজনীতিবিদ, সুশীল পেশাজীবি,শ্রমজীবী, ছাত্র,কবি, লেখক, সাহিত্যিক,তৃণমূল জনমানুষ: আমি আপনাদের বিয়ানীবাজারের শতবছরের ‘সরকারীপুকুর’- দয়া করে আমাকে বাঁচান।
আমার মন বলছে- সামান্য কয়েকজন স্বার্থান্বেষী ছাড়া সবাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। আমাকে ভালোবাসেন বলেই নয়, আপনারা জানেন – এই পুকুরটি সামাজিক ঐতিহ্যের বড় একটি অংশ।মানবিক সম্প্রীতির প্রতীক।আমার পুকুর পাড়ে যে পাইলিং হচ্ছে,তা নিশ্চয় আপনাদের শরীরেও বিঁধছে। আপনার সাথে আমার আত্নার সম্পর্ক। একই আলো -হাওয়ায় আমরা পিঠাপিঠি বড় হয়েছি। আমার বিশ্বাস,আমার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দখল হলে,আপনার মনও তাদের আগ্রাসনে পড়ে।
আমি নগণ্য সরকারীপুকুর বাঁচলে মানবাধিকার বাঁচে। তৃণমূল মানুষের মুখে হাসি ফুটে। আসুন জাগি।জাগিয়ে তুলতে প্রেরণা দেই। প্রতিবাদী কণ্ঠে কোরাস হোক- “জাগো বাহে কুনঠে সবাই…”
দশ.
আগামীকালের সোনালী ভোরের জন্য স্বপ্ন দেখে চলুন ঘুমাতে যাই।আমি প্রকৃতির মা। মায়েদের স্বপ্ন বৃথা যায় না। আমরা সংসদ,সচিবালয়,জেলা, উপজেলা ও পৌরসভার দায়িত্ব যাদের হাতে দিয়েছি অগণন জনগণ,তারা সবাই মানবিক,সমাজবান্ধব,লাখো মানুষের সুন্দর আগামীর প্রত্যয়টিকে জাগিয়ে রাখতে কাজ করবেন অবিরাম-আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই।
আসুন চোখ বুজে স্বপটি দেখি: “আপনি(মা অথবা বাবা), আপনার প্রিয় প্রজন্মকে নিয়ে সকালে বিয়ানীবাজার শহরে হাটতে বেড়িয়েছেন- সুন্দর পরিপাটি রাস্তা, পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ইতিমধ্যে শহরটি পরিকার করে ফেলেছে। রাস্তায় কোন ভাঙ্গা চুড়া, খানা খন্দ নেই। প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে এর একটি আবহগন্ধ আছে শহরেই!
মেইন রোড়ের বড় গাছগুলোতে পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছেন।গাছে,দোকান ভবনে কোন বিলবোর্ড নেই। দোকানপাট ও স্থাপনার নিরাপত্তায় মোড়ে মোড়ে সিসি ক্যামেরা লাগানো।আপনার সন্তান উত্তরবাজার এসে ঠিক আমার সামনে অর্থাৎ সরকারীপুকুর এর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার উচ্ছল চোখ আমার দিকে নিবন্ধ। মুখে মন ভালো করা হাসি। আমার বুক ভরে আছে মিঠা পানিতে। পূর্বদিকের ভোরের সূর্যের আলো এসে পড়ছে আমার স্বচ্ছ পানিতে।ছোটমাছ,বড়মাছ এদিক- ওদিক দৌড়াচ্ছে।
অনেকের সাথে দেখা হলো- আপনার মতো পুকুর পাড়ে তাঁরাও এসেছেন বেড়াতে। প্রবাস থেকে দেশে বেড়াতে আসা কয়েকজনের সাথেও দেখা হয়ে গেল।সবাই সকালে পুকুর পাড়ে হাটতে এসেছেন।সবাই মুগ্ধ, আমাকে দেখে, প্রশংসার ফুলঝুরি সবটুকু যাচ্ছে নির্বাচিত পরিবেশবাদী, জনপ্রতিনিধি, সরকারী- বেসরকারী কর্মকর্তাদের ঝুলিতে।যাবে ই-না কেন- তাদের সমন্বিত উদ্যোগেই তো প্রকৃতি ও জনবান্ধব অনুকরণীয় কাজটি করা সম্ভব হয়েছে।
আমি সরকারীপুকুর আরও স্বপ্ন দেখি,আমার চারপাড় পাকা করে দেয়া হয়েছে। সুন্দর সিড়ি করে দেয়া হয়েছে চারদিক।যাতে,যে কেউ আমাকে নিরাপদে ব্যবহার করতে পারে।হাটা-চলাচলের জায়গায় কয়েকটি বসার বেঞ্চি,উপরে ছাতা দেয়া আছে।ফলের গাছও লাগানো আছে, এমন পরিপাটি যে, সকালের হাটা -হাটি ছাড়াও দিনের বেলায় এখানে বসে জিইয়ে নিতে পারবেন যে কেউ।
অনেকে ইতিমধ্যে পানিতে নেমে গেছেন গোসল এর জন্য। গায়ে পানি মেখেই ঘন্টা দুই পর দিনের রুটিন কাজে বেরুবেন।
ইতিমধ্যে,সূর্যের প্রখরতা বেড়েছে।আপনার ছেলে যেতে চাইছে না, সে পুকুরে মানুষের গোসল করা দেখতে চায়। সরপুটি,তেলাপিয়া,টেংরা মাছ গুলোর অবাদ খেলা আরও কিছু সময় দেখতে চায়।আবারও দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েই তাকে নিয়ে বাড়ী ফিরছেন।
আমার শেষ প্রান্তে এসেই আপনার চোখে ভাসল একটি সাইনবোর্ড- ‘সরকারী পুকুর, বিয়ানীবাজার, জনসাধারণের ব্যবহারে উন্মোক্ত।পানিতে ময়লা-পলিথিন ব্যাগ ইত্যাদি ফেলবেন না। জনস্বার্থে ব্যবহার করুন-পরিবেশ বান্ধব থাকুন। রাষ্ট্রিয় সম্পত্তি ধংস বা বিনষ্ট করা দন্ডনীয় অপরাধ। জনস্বার্থে-কর্তৃপক্ষ।”
অনুলেখক: আনোয়ারুল ইসলাম অভি: কবি, সাংবাদিক, লন্ডন।১২ জুলাই,২০২৫
প্রথম প্রকাশ : সাপ্তাহিক দিবালোক,২৬ ডিসেম্বর,২০১৭



















